বাতাবি লেবুর বৈজ্ঞানিক নাম Citrus maxima (সাইট্রাস ম্যাক্সিমা) বা Citrus grandis (সাইট্রাস গ্র্যান্ডিস)। বাণিজ্যিকভাবে অনেকেই লেবুর চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক লোক দৈনিক গড়ে ৫০ গ্রাম বাতাবিলেবু খেলেই প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ভিটামিন সির অভাব পূরণ হয়। শিশুদের খাদ্যে দৈনিক ২০ মিলিগ্রাম এবং গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের জন্য দৈনিক ৫০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি প্রয়োজন। ভিটামিন সি স্কার্ভি রোগ প্রতিরোধ করে এবং দাঁত, মাড়ি ও পেশী মজবুত করে। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় এবং দেহের ক্ষত নিরাময়ে সহায়তা করে।
আসুন জেনে নেই বাতাবি লেবুর চাষ সম্পর্কে (Batabi Lemon Cultivation)-
উচ্চ ফলনশীল জাতটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো-
ফাল্গুন মাসে এ জাতের গাছে ফুল আসে এবং ভাদ্র-আশ্বিন (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) মাসে ফল সংগ্রহ করা যায়।
মাটি ও জলবায়ু (Soil & Climate Preparation) -
হালকা দো-আঁশ থেকে পলি দো-আঁশযুক্ত, সুনিষ্কাশিত ও জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটি বাতাবি লেবু চাষের জন্য উত্তম। তবে মধ্যম অমস্নীয় মাটিতে এটি ভালো জন্মে। বাংলাদেশের জলবায়ু বাতাবি লেবু চাষের জন্য বেশি উপযোগী।
জমি নির্বাচন ও তৈরিঃ
বাতাবি লেবুর চারা রোপণের জন্য উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে। জমি ভালোভাবে চাষ ও মই দিয়ে সমতল ও আগাছামুক্ত করে চারা রোপণের জন্য গর্ত তৈরি করতে হবে।
বংশ বিস্তারঃ
গুটি কলম, জোড় কলম ও চোখ কলমের সাহায্যে বংশবিসত্মার করা হয়। সাধারণত ৮-১০ মাস বয়সের বাতাবি লেবুর চারা বডি ও গ্রাফটিংয়ের জন্য আদিজোড় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রোপণের জন্য সোজা ও দ্রুত বৃদ্ধি সম্পন্ন চারা বা কলম রোপণ করা হয়।
রোপণ পদ্ধতি (Plantation) -
সমতল জমিতে বর্গাকার অথবা আয়তাকার পদ্ধতি অথবা পাহাড়ি জমিতে কন্টুর পদ্ধতিতে বাতাবি লেবুর চারা/কলম রোপণ করা হয়।
রোপণের সময়ঃ
মধ্য জ্যৈষ্ঠ-আশ্বিন (জুন-সেপ্টেম্বর) মাস চারা রোপণের উপযুক্ত সময়।
গর্তে সার প্রয়োগ (Fertilizer Application) -
প্রতি গর্তে জৈব সার ১০-১৫ কেজি, টিএসপি-২৫০ গ্রাম এবং এমপি ২৫০ গ্রাম প্রয়োগ করতে হয়। সারগুলো ভালো করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। বিভিন্ন বয়সের গাছের জন্য সারের মাত্রা পরবর্তী পৃষ্ঠায় দেয়া হলো।
সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ
সার একেবারে গাছের গোড়ায় না দিয়ে যতদূর পর্যনত্ম ভালোভাবে গাছের ডালপালা বিসত্মার লাভ করেছে সে এলাকার মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। উল্লেখিত সার সমান তিন কিসিত্মতে মধ্য মাঘ থেকে মধ্য ফাল্গুন (ফেব্রম্নয়ারি), মধ্য বৈশাখ থেকে মধ্য জ্যৈষ্ঠ (মে) ও মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য কার্তিক (অক্টোবর) মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
আগাছা দমন ও মাটির চটা ভেঙে দেওয়াঃ
গাছের গোড়ায় আগাছা জন্মালে তা তুলে ফেলতে হবে। কারণ এরা খাদ্য ও পানি গ্রহণে অংশীদার হয় এবং গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি অব্যাহত করে। চারা রোপণের পর প্রথম দিকে গাছের গোড়ার মাটি ঝুরঝুরে রাখলে নতুন চারা দ্রম্নত বাড়তে পারে। তাই সেচ দেয়ার পর জমিতে জো এলে হালকাভাবে কুপিয়ে জমির চটা ভেঙে দিতে হবে। এতে মাটির পানি ধারণড়্গমতা বেড়ে যাবে এবং গাছ সহজে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারবে।
জল ও সেচ নিকাশঃ
ফুল আসা ও ফল ধরার সময় পানির অভাব হলে ফল ঝরে পড়ে। চারা লাগানোর সময়, সার দেয়ার পর এবং খরার সময় ১০-১৫ দিন পরপর সেচ দিতে হবে। বাতাবি লেবু জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। বিধায় বৃষ্টিতে ও বর্ষার সময় গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমতে না পারে সেজন্য নালা করে পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে।
রোগবালাই ও দমন ব্যবস্থাঃ
গামোসিসঃ
গামোসিস বাতাবি লেবু গাছের একটি মারাত্মক রোগ। আক্রানত্ম হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই এ রোগ গাছের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে গাছের অংশবিশেষ অথবা সমপূর্ণ গাছটি মরে যায়।
রোগের লক্ষণঃ
এ রোগের আক্রমণে আক্রানত্ম অংশের বাকল থেকে প্রচুর আঠা নির্গত হয়। রোগাক্রানত্ম কাণ্ড ও বাকল বাদামি রঙের হয়ে যায় ও আঠা ফোঁটা আকারে বের হতে থাকে। আক্রানত্ম অংশে ১-৩ মিলিমিটার চওড়া ফাটল দেখা যায়।
দমন ব্যবস্থাঃ
আক্রান্ত শাখা কেটে ফেলে অথবা আক্রান্ত অংশ চেঁছে ফেলে বর্দোপেস্ট বা ম্যাক্রপ্যাঙ পেস্টের মতো করে লাগাতে হবে। গাছকে সবসময় সবল ও সতেজ রাখতে হবে। স্যাঁতসেঁতে মাটি, অতিরিক্ত সেচ এবং জলাবদ্ধতা পরিহার করতে হবে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা ও সেচের পানি গাছের কাণ্ড স্পর্শ করা থেকে বিরত রাখা ভালো।
ডাইব্যাকঃ
এ রোগের প্রধান লড়্গণ হলো গাছে ধীরে ধীরে সজিবতা হারায়, ফলন কমে যায়, গাছের পাতা ও ডগা শুকিয়ে নিচের দিকে নামে এবং পরবর্তীতে গাছ মারা যায়।
দমন ব্যবস্থাঃ
এ রোগ দমনের জন্য রোগ প্রতিরোধী জাত আদিজোড়া হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। মাটি সুনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে। সুষম সার ব্যবহার ও পানি সেচ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সুস্থ ও সবল গাছ রোপণ করতে হবে। আক্রানত্ম শাখা বা ডাল কেটে ফেলা এবং কর্তিত অংশে বর্দোপেস্ট লাগানো ভালো। আক্রানত্ম অংশে ডাইথেন এম-৪৫ (০.২%) এবং বর্দোমিশ্রণ (১%) সেপ্র করতে হবে।
পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাঃ
পাতার ছোট সুড়ঙ্গ পোকা-
এ পোকার ক্ষুদ্র কীড়াগুলো পাতার উপত্বকের ঠিক নিচে আঁকাবাঁকা সুড়ঙ্গ করে সবুজ অংশ খেয়ে ফেলে। এতে পাতা কুঁকড়ে বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে ঝরে যায়।
দমন ব্যবস্থাঃ
গাছে নতুন পাতা গজানোর সময় রগর বা রঙিয়ন বা পারফেকথিয়ন ৪০ ইসি ২ মিলিলিটার হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর সেপ্র করতে হবে। নতুন পাতা গজানোর সময় ম্যালাথিয়ন বা সুমিথিয়ন ১ মিলিলিটার হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ২ বার সেপ্র করতে হয়।
লেবুর প্রজাপতিঃ
এ পোকার কীড়া পাতা খেয়ে ফেলে। এ জন্য ফলনও গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
দমন ব্যবস্থাঃ
ডিম ও কীড়াযুক্ত পাতা সংগ্রহ করে মাটির নিচে পুঁতে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। সুমিথিয়ন ৫০ ইসি বা লিবাসিড ৫০ ইসি ২ মিলিলিটার প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১৫ দিন পরপর প্রয়োগ করে এ পোকা দমন করা যায়।
ফল সংগ্রহ ও ফলনঃ
ফলের উপরিভাগ খসখসে থেকে পরিবর্তিত হয়ে তেলতেলে ভাব এবং ফল কিছুটা হলুদে বর্ণ ধারণ করলে ফল সংগ্রহ করা যায়। গাছপ্রতি গড়ে ৫০-৫৫টি ফল পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন - ধনিয়া চাষে ফসল সংগ্রহ ও রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ (Coriander Pest Management)