আমাদের কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে গরুর ব্যবহার অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কম খরচের একটি উল্লেখযোগ্য জৈব উপাদান (Organic Farming) কমে যায়। ট্রাকটর বা পাওয়ার টিলার দ্বারা চাষের সময় জমির কেঁচো, ব্যাঙ, সাপ সবই মারা পড়ে পালানোর পথ পায় না। জমিতে চাষের গভীরতা কম হয় বিশেষ করে ধান চাষে হাজার হাজার বছর এই চাষের ফলে মাটির উৎপাদিকা শক্তি নষ্ট হয়নি বা উৎপাদনশীলতাও কমেনি। এটাই হল জৈব কৃষি। রাসায়নিক কৃষির মতো এখানে ফসলকে খাবার যোগান দেওয়া হয় না, বরং মাটিকে খাবার দেওয়া হয়। মাটিতে প্রয়োগ করা জৈব পদার্থ মাটিতে বসবাসকারী কৃষকের বন্ধু কেঁচো, উপকারী জীবানু, পরভোজি মাটির কৃমি ইত্যাদির সংখ্যা বাড়ে এবং এগুলি উদ্ভিদকে খাবার যোগান দেয়। মাটির পি এইচ প্রশম করে ৭ এর কাছাকাছি আসে। প্রথম দিকে ১-২ বছর ফলন কম হবে, মাটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় আসার সুযোগ দিতে হবে। যাতে মাটির জৈবিক সত্তা ফিরে আসে। একজন কৃষককে পুরোজমি রাতারাতি জৈব কৃষিতে রুপান্তরিত করার প্রয়োজন নেই। ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে।
জৈব কৃষির ধাপগুলি হল নিম্নরূপ -
(ক) মাটির প্রশম করন ও মাটির খাদ্য:
রাসায়নিক কৃষির জমির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব বেড়ে যায়, উদ্ভিদ খাদ্যের যোগান ঠিক হয় না। তাই মাটিকে প্রশম করতে হবে। বিঘা প্রতি বছরে একবার ফসফেট দ্রবীভূতকারী জীবানু সহ ২০ কেজি রক ফসফেট, ৮০০-১০০০ কেজি গোবর সার, ২-৩ বার তরল সার, ধান মিলের কালো তুষের ছাই (বিঘা প্রতি ৫০ কেজি), কচুরিপানার খোল কম্পোস্ট ইত্যাদি।
(খ) বীজ নির্বাচন:
এমন বীজ সংগ্রহ করতে হবে যাতে বীজ ঐ অঞ্চলে উৎপাদন করা সম্ভব হয়। বীজ পারস্পরিক বিনিময় করতে হবে। বীজ একবার সংগ্রহ করলে সারা জীবন ওই বীজ চলে যাবে। অনেক দেশজ ফলের স্বাদ ভালো। ১৮৮০ সালে ইংরেজের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তামিলনাড়ুর সালেম ও থাঞ্জাভূর জেলায় ধানের ফলন ছিল বিঘা প্রতি ২৫-৩০ মণ/হেক্টর। বেশী উৎপাদনক্ষম অনেক দেশজ ফলনের জাত আছে যেমন ধানের ক্ষেত্রে কেরালাসুন্দরী, বহুরুপী, কেশবসাল, বউরানী ইত্যাদি। গোবর সার দিয়ে এর ফলন হয় বিঘা প্রতি ১৫-১৮ মণ। দেশী ধানের খড়ের ভালো দাম পাওয়া যায়। অনেক দেশজ উচ্চফলনশীল ফসল আছে যেগুলোতে রোগ ও পোকা কম লাগে। যেমন লাল ও গাছ ঢ্যাঁড়শ, মালদার নবাব গঞ্জের বেগুন, সাদা ডিম ও কুলি বেগুন।
(গ) চাষ পদ্ধতি :
একক ফসলের চাষ করা যাবেনা। দুতিন রকম ফসল বিভিন্ন লাইনে বুনে মিশ্র ফসলের চাষ করা প্রয়োজন। পুরো জমির ফসল একবারে উঠবেনা। যে লাইনের ফসল উঠবে চাষ করে বা খুপি করে সেই লাইনে উপযুক্ত ফসল লাগাতে হবে। জঙ্গলে বিভিন্ন উদ্ভিদ একই সাথে বেড়ে ওঠে , প্রায় গায় গায় লেগে থাকে । রোগ পোকা থাকে না , বৃদ্ধিও ভালো হয়। সেই ভাবে বিভিন্ন রকম ফসল একসঙ্গে চাষ করলে ফসলে রোগ ও পোকার উপদ্রব কম হয় এবং মোট উৎপাদন বেশী হয়। একই গোত্রের ফসল এক সঙ্গে চাষ করা যাবে না। যেমন বেগুন ও টমাটো। কারন দুই ফসলের রোগ ও পোকা একই এবং আক্রমণ বেশী হবে। সম দৈর্ঘ্যের শিকড় যুক্ত ফসল এক সাথে চাষ করা যাবে না, দুটি ফসলই মাটির একই স্তর থেকে খাদ্য টানবে ফলে খাদ্যের প্রতিযোগিতা বাড়বে।
কয়েকটি সাথি ফসলের নমুনা -
বেগুন ও টমাটোর সাথী ফসল –
বরবটি/মটর/সয়াবীন/গাজর/পিঁয়াজ, রসুন। (বেগুন ও টমাটো এক সাথে নয়)।
ভুট্টা +সয়াবীন/বাদাম/কলাই/অড়হড়। তিল+পাট/মেস্তা। করলা+লংকা। ছোলা+তিসি। টমাটো+বাঁধাকপি/রসুন/গাঁদা।
অড়হর+মুগ/বাদাম/বাজরা। তিল+কলা। মিষ্টি আলু+ভুট্টা+তুলো। মাচায় পটল+নিচে লংকা।
ভুট্টা+মুগ/বরবটি/শাঁকালু/শীম। সরিষা+গম+ছোলা। জোয়ার+ভুট্টা। টক ঢ্যাড়শ+অড়হর।
সুপারি/নারকোল+পেয়ারা/লেবু। পেঁপেঁ/কলা+আনারস। কলা+আনারস। আম(চারা অবস্থায়)+ বিভিন্ন সবজি/ডাল শস্য
আম(বড় অবস্থায়)+হলুদ/আদা। কলা+লংকা/তিল/বরবটি।
বেগুনের/পান বোরোজের জমির চারপাশে ঢ্যাঁড়শ/কলাগাছ লাগালে সাদামাছির আক্রমণ কমে।
সুঁয়োযুক্ত ধান যেমন সুঁয়োকলমা, তুলাইপাঞ্জী ইত্যাদ ধান জমির চারপাশে লাগালে ধান কাটার সময় গরু ও ছাগলের উপদ্রব কমে। জমির চারপাশে তিল লাগালে গরু ও ছাগলের উপদ্রব কমে।
গভীর জল যেখানে জমে না এবং যেখানে জল নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সেখানে ১২-১৫ দিনের ধান চারা এক কলি (একটি চারা) করে ১০ ইঞ্চি * ১০ ইঞ্চি দূরত্বে লাগালে বীজের খরচ বাচে এবং ফলন ভালো হয়। বহু দেশী ধানের ফলন যথেষ্ট ভালো এবং সুগন্ধি ধানের ফলন কম হলেও চাহিদা বেশী, দামও ভালো পাওয়া যায়। ধান মাছ ব্যবস্থাপনায় কৃষকের লাভ হয়। সেই ভাবে দেশী মুড়ির চাল, সরু ধানের চাষে খরচ কম হয়।
দক্ষিন ২৪ পরগনায় আলে ঢ্যাড়শ + শীম (সামান্য দেরীতে লাগিয়ে আগা ছেটে রাখা হয় যাতে ঢ্যাড়শ গাছের ক্ষতি না হয়। কয়েক মাস পর থেকে শীমের বৃদ্ধি হতে থাকে, ছাটা হয় না। ঢ্যাঁড়শ উঠে যাওয়ার পর শীমে ফুল আসার সময় হয়। একই পরিচর্যায় দুটি ফসল হল।
বাঁধাকপির চারিদিকে বা আট লাইন অন্তর অন্তর সরিষা দু লাইন করে লাগাতে হবে। বাঁধাকপি লাগানোর ১৫ দিন আগে। জাব পোকা , করাত মাছি হীরকপৃষ্ঠ মথ সবার আগে সরিষাতে আক্রমণ করবে এবং মূল ফসল বাঁধাকপি রক্ষা পাবে।
টমাটোর সাদা মাছি ঠেকাতে চারিদিকে শশা লাগানো হয়। ফসলের চারিদিকে তুলসি, চাকুন্দে, আকন্দ, বাসক, ভাট ইত্যাদি থাকলে পোকা বিতারকের কাজ করে। এই রকম প্রমানিত বহু সাথী ফসলের উদাহরণ আছে। সব জমিতে একই ফসল প্রযোজ্য হবে তা নয়, পরিবেশ ও পরিস্থিতি আনুযায়ী করতে হবে।
জলমগ্ন ধানের জমিতে রাসায়নিক সার ও কৃষিবিষ না ঢুকলে সহজেই মাছ জন্মায়। আগে সাড়ে চার মাস সময়ে এক বিঘা ধান জমি থেকে প্রায় ৩০-৪০ কেজি মাছ পাওয়া যেত। ধানের সঙ্গে সহজ লভ্য প্রোটিন হিসাবে মাছটাও সহজে মিলে যেত, ধানের ফলন কম হলেও পুষিয়ে যেত। সেই অবস্থা আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এখন কম করে এক বিঘা জমিতে ২০ কেজি মাছ হলে, ৬০ টাকা কেজি হিসাবে ১২০০ টাকা আর্থিক মূল্য হয় যা শুধু ধান চাষ করে পাওয়া যায় না। শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে যাতে একই জমিতে একই রকম ফসল বারবার না চাষ করা হয়।
বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মাটিকে রোদ খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। মাটির রস সংরক্ষণ বড় কথা। গ্রীষ্মকালে জমিতে আচ্ছাদন ফসলের যেমন মুগের চাষ করা। এই সময় রাসায়নিক কৃষির মত গভীর চাষ করতে হবে না। এতে মাটির রস উঠে যাবে।
জমির আগাছা সম্পূর্ণ নির্মূল না করা, কিছু আগাছা রেখে দিতে হবে, এগুলিই শত্রু ও বন্ধু পোকার আশ্রয়স্থল। বছরের কোন না কোন সময়ে অবশ্যই ডাল শস্য চাষ করতে হবে, এতে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া মাচায় চাষ ও সুসমন্বিত চাষ ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে।