পেয়ারার ফলন বছরে দুবার পাওয়া যায়, শীত ও বর্ষাকালে। শীতকাল অপেক্ষা বর্ষাকালে ফলন বেশী হয় এবং বর্ষাকালের পেয়ারার স্বাদও বেশী ভালো হয়। কিন্তু এই সময়ে রোগ পোকার আক্রমণের কারণে প্রচুর ফলন নষ্ট হয়, কখনও কালবৈশাখী ঝড়ে ফল পড়ে যায় অথবা কখন পাখীতে ঠুকরে নষ্ট করে দেয়। বার বার কৃষিবিষ প্রয়োগ করেও কোন লাভ হয়না, উপরন্তু কৃষিবিষের প্রয়োগে ফলের স্বাদ নষ্ট হয়, মাটির ক্ষতি হয়।
এই সমস্যা থেকে সমাধানের জন্য পেয়ারার আকার যখন ছোট থাকে, তখন স্পান বাউন্ড পলিপ্রোপাইলিন ফ্যাব্রিক ব্যাগ দিয়ে উদ্ভিদটির ফলগুলি ঢেকে রাখলে ফ্রুট ফ্লাই ও পাখীর আক্রমণ থেকে ফলগুলি বাচানো যায়। ফল তোলার আগের দিন এই ব্যাগ খুলে রাখতে হবে। এই ভাবে ব্যগ দিয়ে ফল ঢেকে রাখলে ফলের আকার ভালো হয় ও ফল দেখতে সুন্দর হয়, ফলে উৎকৃষ্ট মানের পেয়ারা বাজারজাত করা যায়, যার ফলে কৃষকের উপার্জন বৃদ্ধি পায়।
স্পান বাউন্ড পলিপ্রোপাইলিন ফ্যাব্রিক ব্যাগ (Spun Bound Polypropylene Fabric Bag) ব্যবহারে একদিকে যেমন অধিক পরিমানে ভিটামিন সি ও লাইকোপিন যুক্ত ফল পাওয়া যায়, তেমনি এই ফল স্বাদে ও আকারে উৎকৃষ্ট মানের হয়। এই ব্যাগ প্রথমবার ব্যবহারের পর খুলে রাখলে ৩-৪ বার ব্যবহার করা যায়।
উদ্ভিদটির আবহাওয়া, সূর্যালোক, বর্ষাকালের স্থায়িত্ব, শারীরবৃত্তীয় অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ের উপর নির্ভর করে তিনবার ফুল আসতে পারে। সারাবছর ফল নিলে ও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকলে ফলের আকার ও গুণমান হ্রাস পায়। বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক ফলন পেতে হলে নিম্নলিখিত পদ্ধতিগুলি অবলম্বন করতে হবে –
(ক)গাছের ডাল বেঁকিয়ে – খাড়া শাখাগুলিতে ফুল-ফল কম আসে। তাই বর্ষার আগে বৈশাখ-জৈষ্ঠ মাস নাগাদ খাড়া/উল্লম্ব ডালগুলি বেঁকিয়ে মাটিতে সমান্তরালভাবে রাখলে ফল বেশী সংখ্যায় আসে। গ্রাম বাংলায় এটি ম্যাসেজ করা নামে পরিচিত।
(খ) সেচের জল নিয়ন্ত্রণ করে – ফাল্গুন থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত বাগানে জল না দিলে সমস্ত পাতা ঝড়ে যায়। জৈষ্ঠ্য মাস নাগাদ সার দিয়ে জলসেচ দিলে নতুন পাতা ও ফুল আসে।
(গ) গাছের শিকড় উন্মুক্ত - ফাল্গুন থেকে বৈশাখ মাসে পেয়ারা গাছের শিকড়ের চারপাশে ৪৫-৬০ সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের মাটি খুঁড়ে উন্মুক্ত করে দিলে গাছের স্বাভাবিক পুষ্টি ব্যাহত হয়। এর পরে জৈষ্ঠ্য মাস নাগাদ সার দিয়ে জলসেচ দিলে নতুন পাতা ও ফুল আসে।
পেয়ারা গাছের রোগ ও প্রতিকার –
১) ঢলে পড়া বা শুকিয়ে যাওয়া – ছত্রাকের আক্রমণে গাছ ডগার দিক থেকে শুকিয়ে পড়ে, ঝিমিয়ে পড়ে, অনেক সময় মারা যায়। এর প্রতিকারে পরিচ্ছন্ন চাষের সাথে পটাশিয়াম ও জৈব সারের ব্যবস্থা করতে হবে। আক্রান্ত গাছে জিনেব ৬৮% + হেক্সাকোনাজোল ৪% ডব্লু পি ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
২) অ্যানথ্রাকনোজ – এই রোগে আক্রান্ত গাছের বাড়ন্ত অংশ শুকিয়ে কালো হয়ে যায় আস্তে আস্তে গোটা গাছ ও ফল কালো হয়ে যায়। প্রতিকারে থায়োফ্যানেট মিথাইল ৭০% ও ডব্লু পি ১ গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
৩) ফলের ক্যাঙ্কার রোগ – ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত এই রোগে ফলের গাছে কালো দাগ হয়, পরে দাগ গভীর হয় ও ফল নষ্ট হয়ে যায়। এর প্রতিকার পরিচ্ছন্ন চাষ ও রোগাক্রান্ত ফল পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
৪) কান্ডছিদ্রকারী পোকা – পুরানো গাছের পোকার শুককীট কান্ডের ছাল খায়, নরম অংশও খেয়ে ফেলে। গাছ দূর্বল হয়ে পড়ে, ফুল কম আসে। বেশী আক্রমণে গাছ মরে যেতে পারে। এর প্রতিকার – আলকাতরা ও ক্লোরপাইরিফস একসাথে মিশিয়ে গাছের গায়ে লেপে দিতে হবে। গাছের গায়ে গর্ত গুলো পরিষ্কার করে তাতে ১০ শতাংশ ট্রায়জোফস ৪০% ই.সি, কার্বোসালফান ২৫% ই সি প্রয়োগ করতে হবে।
৫) দয়ে পোকা – এই পোকাগুলি কান্ডের নরম অংশে, কচি পাতায় ও ফুলে দলবদ্ধভাবে থাকে ও রস চুসে খায়। আক্রান্ত গাছের রং ফ্যাকাসে হয়ে যায়। ফুল ও ফলের সংখ্যা কমে যায়।
প্রতিকার – পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষ, মাটি থেকে ২ ফুট উঁচুতে ১ ফুট চওড়া পলিথিন শক্ত করে দড়ি দিয়ে কান্ডের সাথে বেঁধে দিতে হবে।প্রয়োজনে থায়োমেথক্সাম ২৫% ডব্লু জি ০.৫ মিলি প্রতি লিটার জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
স্বপ্নম সেন
তথ্যসূত্র - রুনা নাথ