জৈবসার মাটির উৎপাদনশীলতাকে দীর্ঘস্থায়ী করে। বর্তমানে চাষবাসের যা খরচ তা ভাবাই যায় না তার ওপর রোগপোকা নিয়ন্ত্রণের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কৃষকরা এই ধরনের চাষবাস করে ব্যপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। লেবার খরচ, সারের খরচ, বীজের দাম সব মিলিয়ে বর্তমানে চাষে লাভ করা কঠিন ব্যাপার। জৈব কৃষির লক্ষ্য হল মাটির জৈব পদার্থ বাড়ানো, উৎপাদিত ফসলের উৎকর্ষতা ও খাদ্যগুণ ধরে রাখা, খাদ্য ও জলে কৃষিবিষের অবশেষ কমানো, কৃষকের সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও কৃষি খরচ কমানো। সংরক্ষনশীল ও সুস্থির কৃষিই হল জৈব চাষের লক্ষ্য।
মাটিতে মিশ্র জৈবসার প্রয়োগের ফলে নিম্নলিখিত সুফলগুলি পরিলক্ষিত হয় –
১. যেকোন ধরনের মাটির ভৌত অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে মাটিকে নরম, ঝুরঝুরে করে , মাটির জল ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়, মাটির বায়ু চলাচলের পরিমাণ বাড়ায় , মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, লবণাক্ততা কমে যায়, মাটির আম্লিক বা ক্ষারিয় প্রভাব কমিয়ে মাটিকে প্রশমিত (ph – ৭.০ এর কাছাকাছি) করে।
২. উদ্ভিদের খাদ্য উপাদান সরবরাহ - মিশ্র জৈবসার মাটিতে দেওয়ার ফলে মুখ্য খাদ্য উপাদানগুলি যেমন নাইট্রোজেন, পটাশ, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম প্রভৃতি মুখ্য উপাদান এবং কতকগুলি গৌন খাদ্য উপাদানের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যার ফলে উদ্ভিদের সুসংহত বৃদ্ধি ঘটে।
৩. উদ্ভিদের জৈবিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায় – এর ফলে নাইট্রিফিকেশন ও অ্যামোনিফিকেশনের মত জৈবিক পদ্ধতিগুলি বৃদ্ধি পায়।
৪. উদ্ভিদের হরমোনের বৃদ্ধিসাধন করে: জৈব সার প্রয়োগে গাছের বৃদ্ধি হরমোন যেমন অক্সিন, হেটারোক্সিন ইত্যাদির বেশি উৎপাদনের ফলে গাছের বৃদ্ধি ভলো হয় শস্য উৎপাদন বেশি হয়।
৫. পচনশীল, অব্যবহৃত বা বর্জ্য পদার্থের সুষ্ঠু ব্যবহারের ফলে দূষণ কমে। রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে।
৬. ফসলের জলের চাহিদা কমে বা সেচের জল কম পরিমাণে লাগে।
বিভিন্ন প্রকার জৈব সারের প্রস্তুত প্রণালী :
(ক) খামার জাত সার (Farm Yard Manure) :
কৃষি খামারের বিভিন্ন প্রকার পশুপাখির মলমূত্র ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থগুলি একত্রে মিশিয়ে ও পচিয়ে যে সার প্রস্তুত করা হয়, তাকে খামারজাত সার বলে।
প্রস্তুত প্রণালী :
গোয়ালের কাছাকাছি উচু স্থানে একটি ৩ মিটার × ১.৫ মিটার × ১ মিটার আয়তনের গর্ত খুঁড়তে হবে। এরপর গর্তটিকে সমান চারভাগে ভাগ করে দিতে হবে। এরপর গর্তটিকে সমান চারভাগে ভাগ করে খামারের আবর্জনা ও পশুপাখির মলমূত্র যেকোন একটি অংশে ফেলে যেতে হবে। মাঝে মাঝে গোমূত্র ও জল ছিটিয়ে ৪০-৫০ শতাংশ আর্দ্রতা বজায় রাখতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় খামারজাত সার তৈরি করতে প্রায় তিনমাস সময় লাগে। এই সারের সঙ্গে গর্ত পিছু ৩০-৪০ কিগ্রা সিঙ্গল সুপার ফসফেট মিশিয়ে দিলে সারের গুণাগুণ ও সংরক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
(খ) কম্পোষ্ট বা আবর্জনাসার :
বিভিন্ন প্রকার নরম ও সবুজ আগাছা, ফসলের অবশিষ্টাংশ,গাছের ঝরাপাতা, তরিতরকারি, খড়কুটো, কচুরিপানা প্রভৃতি একত্রে মিশিয়ে পচিয়ে যে ধূসর বর্ণের সার তৈরি হয় তাকে কম্পোস্ট সার বলে। কম্পোস্ট সার তৈরির সময় সারের মান উন্নত করার জন্য সাধারণত সিঙ্গল সুপার ফসফেট প্রয়োগ করতে হয়। সাধারণত ৩ মিটার × ১.৫ মিটার × ১মিটার আয়তনের গর্তে ৬০ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট প্রয়োগ করা যেতে পারে।
(গ) কেঁচোসার :
একটি বড়ো কেঁচো তার শরীরের ওজনের সমপরিমাণ জৈব পদার্থ খেয়ে থাকে। কেঁচোর পৌষ্টিকনালীর মধ্যে বসবাসকারী অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া ও অ্যাকটিনোমাইসিটিস জৈব পদার্থকে দ্রুত ভেঙ্গে উদ্ভিদের গ্রহণযোগ্য অবস্থায় নিয়ে আসে।
আরও পড়ুন - Tomato Disease Control – জেনে নিন টমেটোর বিভিন্ন রোগ ও তার প্রতিকার পদ্ধতি সম্পর্কে
প্রস্তুত প্রণালী :
কেঁচোসার তৈরির জন্য ছায়াযুক্ত উঁচু জায়গার প্রয়োজন হয়। সাধারণত ২ মিটার * ১মিটার * ১ মিটার গভীর গর্ত করা হয়। একে ভার্মি বেড বলে। গর্তের তলায় পাথরকুঁচি, ভাঙা ইঁটের টুকরো বা বালি বিছিয়ে ১৫-২০ সেমি দোঁয়াশ মাটির আস্থরণ দিয়ে ১০০-১৫০ টি কেঁচো ছেড়ে দেওয়া হয়। এর উপর ৫-১০সেমি উঁচু গোবর ছড়িয়ে তার উপর ১০ সেমি শুকনো পাতা, ফসলের অবশিষ্টাংশ, খড় প্রভৃতি দেওয়া হয়। এই ভাবে ৩-৪ দিন অন্তর অর্ধপচিত খামারের আবর্জনা, সবুজ পাতা, ফসলের অবশিষ্টাংশ, ডালপালা, সবজির খোসা প্রভৃতি ৫ সেমি পুরু স্তর দেওয়া হয় যতক্ষননা ভর্তি হয়। ভার্মিবেডের উপর পুরানো চটের বস্তা চাপা দিয়ে প্রতিদিন মাঝে মাঝে জল ছিটিয়ে দেওয়া হয়।
ভার্মিবেডের সারের রঙ কালচে বাদামী হলে জল ছিটানো বন্ধ করতে হবে। প্রায় ৬ সপ্তাহে কেঁচোসার তৈরি হয়। সাধারনত এই ধরনের ভার্মিবেডে ১০-৮০ হাজার কেঁচো ও মাসে ১০ কুইন্টাল কেঁচোসার তৈরি হতে পারে। কেঁচোসারের প্রয়োগমাত্রা হচ্ছে ২ মে. টন প্রতি হেক্টরে (সেচসেবিত অঞ্চলে), বৃষ্টিনির্ভরচাষে ০.৭৫-১.০০ টন এবং খরা প্রবণ এলাকায় ০.২৫-০.৩০ টন।
আরও পড়ুন - Pointed Gourd – জেনে নিন পটলের বিভিন্ন রোগ ও তার নিরাময়ের ব্যবস্থাপনা