প্রাচীনকালে আর্য উপনিবেশের বহু পূর্বে বাংলা তথা ভারতে কৃষি সভ্যতার যে শুধুমাত্র সূচনাই হয়েছিল তাই নয়, তার ঐতিহ্যও ছিল যথেষ্ট গৌরবান্বিত। সে ভাগীরথী, হুগলী, পদ্মা, মেঘনা, যমুনার জন্যেই হোক বা অধুনা লুপ্ত আসাম উপসাগরে সঞ্চিত পলিমাটি দ্বারাই হোক, অতি প্রাচীনকাল থেকেই বঙ্গদেশ কৃষির চমৎকার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। ‘রাশিয়ান ইন্সটিটিউট অফ প্ল্যান্ট জেনেটিক্স’-এর প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ড. এন আই ভ্যাভিলভ-এর কৃষি সম্বন্ধিত গাছ-গাছড়ার উৎপত্তি সংক্রান্ত জগত বিখ্যাত গ্রন্থে, আদি কৃষি-মন্ডলগুলির মানচিত্রে আমাদের বঙ্গদেশও স্থান পেয়েছে।
শিকার জীবন অবসানের পর পশুপালনের পাশাপাশি ঝুম চাষের মাধ্যমেই মানুষ প্রথম কৃষির প্রয়াস শুরু করেছিল। পণ্ডিতদের মতে, বিশ্বের সর্বত্র ঝুম চাষই আনুষ্ঠানিক কৃষির প্রারম্ভ। পূর্ব এশিয়ার লোক-সাহিত্য থেকে জানা যায়, তৎকালীন মানুষজন তাদের স্বজনদের কবর থেকে নানাপ্রকার ফসলের চারা গজিয়ে উঠতে দেখে বিস্মিত হতে শুরু করে। প্রথমে তাতে অলৌকিকত্ব আরোপ করা হলেও, পরে তারা কবরের উপরের ঝুরঝুরে মাটিকেই এর সম্ভাব্য কারণ হিসাবে চিহ্নিত করে। এরূপ আকস্মিক কিছু ঘটনাদি থেকেই মানুষের প্রথম ভূমি কর্ষণের চিন্তা মাথায় আসে।
পরবর্তী ক্ষেত্রে কালের নিয়মে মানুষ নিজের মনের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষার প্রচলন শুরু করে এবং সেখান থেকে সৃষ্টি হয় ‘ছন্দবদ্ধ মালা’ বা ‘ছড়া’ বা ‘বচন’। এই ছড়া বা গাঁথাকে মানুষ তার ছন্দগুণে অনায়াসে স্মৃতিতে বহন করে চলে। ফলে সমসাময়িক মানুষের অবর্তমানেও এই ছড়া বা বচনগুলির অকালমৃত্যু ঘটেনি, বরং বিবর্তন ঘটেছে মাত্র। বেদ-সংহিতা, পুরান, বৃহৎ সংহিতার মত নানাবিধ গ্রন্থে এইরূপ কথামালার বিবিধ উল্লেখ পাওয়া গেলেও, তার পাশাপাশি তৎকালীন এক বিদুষী খ্যাতনামা জ্যোতির্বিদ খনা কর্তৃক প্রদত্ত বচনগুলির অবদান আজও বাংলার কৃষিক্ষেত্রে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
খনা একজন অত্যন্ত জ্ঞানী, খ্যাতনামা প্রবচক ছিলেন তা স্পষ্ট হয়, তাঁর বলে যাওয়া বিভিন্ন বচনগুলির মাধ্যমে। কৃষিক্ষেত্রে সঠিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস অধুনা সময়ে ভালো ফলনের জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত হিসাবে বিবেচিত হয়। আর এই কাজটি করে থাকেন কৃষি আবহাওয়াবিদরা (Agro-meteorologist)।
বর্তমানের কৃষি-আবহাওয়া বিজ্ঞান (Agro-meteorology) ও সে সংক্রান্ত সম্যক ধারণা আজ থেকে বহু বছর পূর্বে খনা তাঁর বচনের মাধ্যমে দিয়ে গেছেন। তিনি বলে গেছেন- চৈত্র থরথর, বৈশাখে ঝড়-পাথর/ জ্যৈষ্ঠতে তারা ফুটে/ তবে জানবে বর্ষা বটে’। অর্থাৎ কোন বছর চৈত্র মাসে ঠাণ্ডা থাকলে, বৈশাখে ঝড়-বৃষ্টি হলে, জ্যৈষ্ঠ মাসে আকাশ পরিষ্কার অর্থাৎ মেঘশূন্য থাকলে সে বছর বর্ষা ভালো হয়। আবার তিনি আরো বলেছেন – ‘মেঘ হয়েছে কোদাল কাটা/ বাতাস দিচ্ছে লাটাপাটা/ কি করিস চাষা বাঁধগে আল/ আজ না হয় তো হবে কাল’- যার মানে করলে দাঁড়ায়, আকাশে কোদাল কাটা মেঘ থাকলে (কোদালি/কুড়ুলে মেঘ) বর্ষণ সন্নিকটে এবং সেক্ষেত্রে চাষীর আসন্ন চাষ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ। শুধু তাই নয়, আবহাওয়ার সঙ্গে কৃষিকাজের সম্পর্ক যে অত্যন্ত নিবিড়, তা তিনি মানতেন। তাই বিভিন্ন পংক্তির মাধ্যমে তিনি প্রাকৃতিক অবস্থানকে চিহ্নিত করে, সেই অনুযায়ী কৃষক সমাজকে সচেতন হতে বলেছেন। তেমনই এক ছড়ার উল্লেখ পাই, যেখানে তিনি বলছেন – ‘দিনে জল, রাতে তারা/ সে বছর শুখোর ধারা’ অর্থাৎ যে বছর বর্ষাকালে দিনে বৃষ্টি হয় ও রাতে মেঘ পরিষ্কার হয়ে তারা ফোটে, সে বছর শুখো (বৃষ্টি/জলের ঘাটতি) হয়। ফলত বৃষ্টি নির্ভর চাষবাস সমূহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আবার আরো একটি বচন – ‘জ্যৈষ্ঠে শুখো, আষাঢ়ে ধারা/ শয্যের ভার না সহে ধরা’ – এর মাধ্যমে তিনি বলতে চেয়েছেন জ্যৈষ্ঠ মাস শুকনো অর্থাৎ বৃষ্টিহীন থাকলে এবং আষাঢ় মাসে ভালো বৃষ্টি হলে, সে বছর ফলন খুব ভালো হয়।
কৃষিতে জলসেচ (Irrigation) –এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা, শীতকালীন বৃষ্টিপাতের অভাব, বৃষ্টিপাতের অসম বণ্টন, উচ্চ ফলনশীল শস্যের চাষ, মৃত্তিকার অসম জলধারণ ক্ষমতা, বহুফসলী চাষ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে আজ গোটা বিশ্ব জুড়ে কৃষিকার্য ও জলসেচ অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত। ভাবলে অবাক হতে হয়, আজ থেকে কত বছর আগে খনা এ প্রসঙ্গে বলে গেছেন – ‘খরা ভুঁয়ে ঢালবি জল/ সকল মাসেই পাবি ফল’, অর্থাৎ সেচ দিয়ে চাষ করলে বারো মাস ফসল পাওয়া যায়।
শুধু তাই নয়, খনা তাঁর কালজয়ী বচনে কৃষিতত্ত্ব জ্ঞান সমাজের সম্মুখে বেদ বানীর মতো উপস্থাপিত করেছেন। আম, কলা, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, পান, শশা, পটল, বেগুন, পুঁই, কচু, লাউ, কুমড়ো, হলুদ, লঙ্কা ইত্যাদি নানা প্রকার উদ্যানজাত ফসল থেকে শুরু করে ধান, যব ও বিভিন্ন শস্য ফসলের উৎপাদনের পদ্ধতিরও খোঁজ মেলে খনার বচনে। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, খনার বচনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, সেগুলি আধুনিক যুগের কৃষিতত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রথমে আসি কলা চাষ প্রসঙ্গে। খনা তাঁর বচনের মাধ্যমে চাষীবন্ধুদের কলা চাষ সম্পর্কে বিভিন্ন উপদেশ দিয়ে গেছেন, যা স্পষ্টতই বিজ্ঞানসম্মত। কলা কখন, কীভাবে রুইতে হবে, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন – ‘সাত হাতে তিন বিঘতে/ কলা লাগাবে মায়ে পুতে/ কলা লাগিয়ে না কাটবে পাত/ তাতেই কাপড় তাতেই ভাত’। যার অর্থ হল সাত হাত অন্তর তিন বিঘত (হাতের চেটো প্রসারিত করলে বৃদ্ধাঙ্গুলির ডগা থেকে কনিষ্ঠা পর্যন্ত মাপ) গর্ত করে কলা লাগাতে হবে এবং কলা পাতা না কেটে ফল অবধি অপেক্ষা করতে হবে। এতেই পর্যাপ্ত ফলন ও চাষীর শ্রীবৃদ্ধি সম্ভব।
তিনি আরো বলেছেন, ‘ভাদরে করে কলা রোপণ/ স্ববংশে মরিল রাবণ/ ডাক ছেড়ে বলে রাবণ/ কলা লাগাবে আষাঢ়-শ্রাবণ’। যার মানে করলে দাঁড়ায় কলা লাগানোর সঠিক সময় আষাঢ়-শ্রাবণ মাস অর্থাৎ বর্ষাকাল। ভাদ্র মাসে কলা রোপণ করলে বিভিন্ন রোগ ও পোকার আক্রমণে গাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
আধুনিক যুগে যে জৈব পদ্ধতিতে চাষবাসের কথা বলা হচ্ছে, তা বহুকাল আগেই মহান প্রবচক খনা বলে গেছেন। বাংলার কৃষি, কৃষি পদ্ধতি ও সর্বোপরি আবহাওয়ার গতিবিধির সাথে চাষবাসের এরূপ যোগসূত্র স্থাপনের প্রক্রিয়া আজ থেকে বহু বছর আগে বিদুষী খনা শুরু করে গেছিলেন, তা ভেবেই অবাক হতে হয়। মহান এই মনিষী তাঁর মূল্যবান বচনে মূলত অধুনা কৃষির দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক, যেমন, আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, ফসলের চাষ ও জৈব পদ্ধতিতে কৃষিকার্যের কথা বলেছেন। খনার বচনের কিছু সংকলন উদ্ধার করা গেলেও, তা পুরোপুরি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তথাপি উদ্ধারকৃত এই বচনগুলির বিশ্লেষণ করে কৃষি, পশুপালন তথা মানুষের সুস্থ-সবল ভাবে জীবনযাপন সংক্রান্ত যে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে, তা সততই অনস্বীকার্য।
স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)
প্রবন্ধ লেখক - শুভ্রজ্যোতি চ্যাটার্জ্জী
সহ লেখক - দেবমালা মুখার্জ্জী (গবেষক) এবং পার্থ চৌধুরী (সহযোগী অধ্যাপক)