সারা পৃথিবীতে নানাজাতীয় শিমের চাষ হয়। বিন লিগিউম জাতের উদ্ভিদ বা তাদের বীজ। মানুষের খাদ্য হিসেবে যেসব শিম ব্যবহূত হয় সেগুলি প্রায় ১৪টি গণের অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে অন্তত ২৮টি প্রজাতির শিম বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শিমের বীজ সাধারণত বৃক্কাকার (kidney-shaped) এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ।
দেশী শিম (Country bean) দেশের সর্বত্র ফলানো শীতকালীন সবজি প্রজাতি Lablab niger। এর শুঁটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, প্রোটিন ও ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ। দেশী শিম, ফ্রেঞ্চ বিন (French bean) শিমের অন্যতম প্রজাতি Phaseolus vulgaris, স্থানীয়ভাবে নানা নামে পরিচিত।
উপকারিতা -
স্ন্যাপবিন, সালাদ বিন, গ্রীন বিন, কিডনি বিন, হ্যারিক্ট বিন ইত্যাদি সবজি হিসেবে ব্যবহার্য জাতগুলির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, আর ডাল হিসেবে ব্যবহার্যগুলি হলো ড্রাইবিন, নাভাল বিন ইত্যাদি।
শিম চাষের আধুনিক পদ্ধতি (Bean Cultivation) -
বীজ বপনের সময় : আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস বীজ বপনের উপযুক্ত সময়।
দেশী শিম প্রধানত বসতবাড়ির আশপাশে, পুকুরপাড়ে, পথের ধারে ও জমির আইলে চাষ করা হয়। তবে সারি করে চাষ করা হলে ১ মিটার দূরত্বে সারি করে প্রতি সারিতে ৫০ সেমি পর পর ৪৫ সেমি লম্বা, ৪৫ সেমি চওড়া ও ৪৫ সেমি গভীর করে মাদা তৈরি করতে হয়। তারপর প্রতি মাদার মাটির সাথে ১০ কেজি পচা গোবর, ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার ভালোভাবে মিশিয়ে মাদা ভরাট করতে হবে। বীজ বপনকালে বর্ষা থাকে, তাই মাদায় যাতে পানি না জমে সে জন্য জমির সাধারণ সমতল হতে মাদার ভরাট মাটি ৫ সেমি পরিমাণ উঁচু রাখতে হয়।
বীজ বপন (Seed sowing) -
জমিতে সার প্রয়োগের ৮-১০ দিন পর প্রতি জমিতে দুই-তিনটি বীজ ফাঁক ফাঁক করে ২.৫-৩.০ সেমি গভীরে বপন করতে হয়। চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর প্রতি মাদায় দু’টি সুস্থ ও সবল চারা রেখে বাকিগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে। বীজ বপনের আগে ২৪ ঘণ্টা জলেভিজিয়ে নিলে তাড়াতাড়ি চারা গজায়। এক শতক বা ৪০ বর্গমিটার জমিতে ৪০ গ্রাম (হেক্টরে ৫-৭ কেজি) শিম বীজের প্রয়োজন হয়।
উপরি সার প্রয়োগ :
শিমের জমিতে সার উপরি প্রয়োগের কাজ দুই কিস্তিতে করতে হয়। প্রথম কিস্তি চারা গজানোর এক মাস পর এবং দ্বিতীয় কিস্তি গাছে দুই-চারটি ফুল ধরার সময়। প্রতি কিস্তিতে মাদা প্রতি ২৫ গ্রাম ইউরিয়া ও ২৫ গ্রাম এমওপি সার গাছের গোড়ার চারদিকে (গোড়া থেকে ১০-১৫ সেমি দূরে) উপরি প্রয়োগ করে মাটির সাথে ভালো ভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের সময় মাটিতে রসের অভাব হলে ঝাঁঝরি দিয়ে পানি সেচ দিতে হবে।
মাচা দেয়া :
শিমগাছ বাওয়ার সুযোগ যত বেশি পায়, ফলন তত বেশি হয়। তাই শিমগাছ যখন ১৫-২০ সেমি লম্বা হবে তখন গাছের গোড়ার পাশে বাঁশের ডগা (কঞ্চিসহ) মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। এ ঝড়ে শিমগাছ ছড়িয়ে পড়ে ভালো ফুল ও ফল দিতে পারে। দেশীয় পদ্ধতিতেও বাঁশের মাচা বা ঝিকাগাছে অথবা ছনের ঘরের চালে শিমগাছ তুলে দেয়া যায়। এ ছাড়া বাঁশের চটা ও কঞ্চির সাহায্যে ইংরেজি ‘অ’ অরের মতো কাঠামো তৈরি করে জমিতে মাচা দিয়েও শিমগাছ থেকে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
রোপনের আগে পরে পরিচর্যা:
আষাঢ় থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত দেশী শিমের বীজ বপন করার সময়। তবে শ্রাবণ মাস উপযুক্ত সময়। যে মাসেই বীজ বপন করা হোক, অগ্রহায়ণের শেষ বা কার্তিক শুরুর আগে কোনো গাছেই ফুল ও ফল ধরে না। ব্যতিক্রম বারমাসী জাত। দেশী শিমে যেহেতু আগাম, মাঝারি ও নাবী জাত আছে, তাই জাতের সঠিক তথ্য না জেনে চাষ করলে সময়মতো ফলন পাওয়া যায় না।
দেশী শিম প্রতি সপ্তাহে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করতে হয়। জাতভেদে কার্তিক মাস থেকে শুরু করে চৈত্র মাস পর্যন্ত শিম সংগ্রহ করা যায়। ভালোভাবে পরিচর্যা করা হলে শতকপ্রতি প্রায় ৪০ কেজি শিম পাওয়া যায়। আবার শুকনো শিম বা শুঁটির বীজ সংগ্রহ করে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা যায়। প্রতি বিঘা দেশী শিম চাষের জন্য পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার টাকা খরচ হতে পারে। আগাম শিম বাজারে তুলতে পারলে প্রতি কেজি কমপক্ষে ২০ টাকা হিসেবে ১ বিঘায় উৎপাদিত প্রায় ১৩০০ কেজি শিমের দাম ২৬০০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বিঘায় প্রায় হাজার বিশেক টাকা লাভ হয়। তবে ভরা মৌসুমে সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় দাম কমে আসে এবং লাভও কমতে থাকে।
ফসল সংগ্রহ :
শিমের কচি শুঁটি, অপক্ব বীজ এবং পরিপক্ব বীজ সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত একই ফসল থেকে প্রথম দিকে গুঁটি ও শেষের দিকে বীজ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। গাছ তিন মাসের বেশি সময়ব্যাপী ফল দিতে থাকে।
ফলন : প্রতি শতকে ৩০-৪০ কেজি (হেক্টর প্রতি ৮-১০ টন) শিম পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন - জৈব পদ্ধতিতে বাঁধাকপি চাষের পদ্ধতি ও আয়ের দিশা (Organic Cabbage Cultivation)