'দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর...'
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজ থেকে কত বছর আগে কবিগুরু এই কথাগুলো কবিতার ছলে বলে গিয়েছিলেন। প্রাক-স্বাধীনতা যুগ অর্থাৎ রবি ঠাকুরের জীবদ্দশায়, পরিবেশ এখনের মতন দূষিত ততটাও হয়ে পড়েনি । তবুও কবির সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এই উপলব্ধি, বর্তমানে সময়ে দাঁড়িয়ে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না।পরিবেশের ভারসাম্য এই একবিংশ শতাব্দীতে ভীষণ রকমের ক্ষতিপ্রবণ জায়গায় দাঁড়িয়ে। ইট-কংক্রিটের হাইরাজ বিল্ডিং, সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলা পরিবেশ দূষণ, বনাঞ্চলের একের পর এক ধ্বংস। সব মিলিয়ে মানুষ আজ প্রয়োজনীয় শুদ্ধ অক্সিজেনটুকুও পাচ্ছে না। ধূলি-ধূসরিত শহর আজ একটু সবুজের আশায় ধুঁকছে। বর্তমানে মানুষ চায় ভীষণ রকমে উদ্ভিদের সাহচর্য। কিন্তু গাছ যদি বপন না করা হয় তাহলে মানুষের সঙ্গে গাছের আত্মিকতা তৈরি হবে কী ভাবে? এই জন্যই প্রয়োজন গাছকে ভালোবাসা, গাছের যত্ন নেওয়া। আপনি যদি ভাবেন, শহুরে হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের বাসিন্দা হয়ে কি করে হাতের নাগালে গড়ে তুলবেন একটুকরো সবুজ বাগান, তাহলে ভার্টিকাল গার্ডেনিং আপনার জন্য যথার্থ।
ভার্টিকাল গার্ডেনিং অথবা উল্লম্ব বাগান বানাতে আপনাকে বেশি পরিশ্রম করতে হবে না। সহজেই, কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে আপনি হয়ে উঠতে পারেন একটুকরো উল্লম্ব বাগানের মালিক।
উল্লম্ব বাগান বানানোর পদ্ধতি (Vertical garden making):
এই জাতীয় বাগান বানানোর পদ্ধতি, অন্যান্য বাগান বানানোর পদ্ধতি থেকে একদম আলাদা। এই পদ্ধতিতে, একের পর এক ধাপ করে, একটি গাছের উপরে আরেকটি গাছ রোপণ করে লম্বালম্বি ভাবে বাগান তৈরী করা হয়। শুনলে খটমট লাগলেও, একদমই তা নয়। একটি টবের গাছের উপর আরেকটি ছোট টবের গাছকে ঝুলিয়ে দেওয়াকেও উল্লম্ব বাগান বলা বলা যেতে পারে। বিভিন্ন ভাবে উল্লম্ব বাগান তৈরী করা যায়। ঘরের প্লাস্টিকের র্যাকে যদি মাটি ভরে লতানো গাছের চারা লাগানো যায়, দেখতে দেখতে তাও উল্লম্ব বাগানের রূপ নেবে। জানলার গ্রিলেও টবের উপর টব সাজিয়ে উলম্ব বাগান বানিয়ে তোলা যায়।
মাটি (Soil):
উল্লম্ব বাগান তৈরির জন্য, মানিপ্ল্যান্ট, এলোকেশিয়া, বটলিলি, স্পাইডারলিলি ইত্যাদি গাছ বেছে নেওয়া ভালো। এছাড়াও লঙ্কা, লালশাক, পালংশাক, লেটুস, ব্রকোলির মতন শাসব্জি দিয়েও ভার্টিকাল গার্ডেনিং করা যায়। উল্লম্ব উদ্যান গড়ে তোলার জন্য, রোদ এবং ছায়ার সঠিক সংমিশ্রণ প্রয়োজন। উল্লম্ব বাগানের মাটির উর্বর হওয়া ভীষণ ভাবে দরকার। তবে উল্লম্ব বাগানে মাটির পরিবর্তে অর্ধেক কম্পোষ্ট ও অর্ধেক কোকোডাষ্ট মিশ্রণেও গ্রোয়িং মিডিয়াও তৈরি করে নেওয়া যায়।
জল সরবরাহ (Water)
উল্লম্ব বাগানে রোপণ করা গাছের পাত্রগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আকারে ছোট হয়। ফলে জল ধরার পরিমাণও এদের কম থাকে। দরকার অনুযায়ী উল্লম্ব বাগানে তাই জল সরবরাহ করা উচিত। উল্লম্ব বাগান বানানোর পাত্র চয়নে সাবধানতা মেনে চললে ভালো। যদি বড় আকারের উল্লম্ব বাগান বানাতে হয়, তাহলে স্বয়ংক্রিয় বিন্দু সেচ পদ্ধতিতে টাইমার সেট করে জল সরবরাহ করতে হবে। টাইমার না হলে এই ক্ষেত্রে সেন্সর হলেও সেচের কাজ ব্যাহত হবে না। বৃষ্টির জলও উল্লম্ব বাগানে সেচের কাজে ব্যবহার করা যায়। সেক্ষেত্রে বর্ষার জল সংরক্ষণ করে রাখতে হবে, এবং পরে তা সেচের কাজে লাগাতে হবে
সূর্যালোক (Sunlight)
গাছ বাড়তে পারে যখন সঠিক ভাবে জল, মাটি ও প্রয়োজনীয় সূর্যের আলো পায়। উল্লম্ব বাগানের ক্ষেত্রে একটাই বড় সমস্যা, গাছগুলি একটার উপর আরেকটি থাকায়, দিনের মাঝামাঝি সময়ে সূর্যের আলো তলার দিকে গাছগুলি পর্যন্ত যেতে পারে না। এর জন্য গাছগুলিকে এমন বিশেষ স্থানে রাখতে হবে, যাতে সকালের শুরু দিকেই সেগুলি সূর্যের আলোতে বিকশিত হতে পারে।
উল্লম্ব বাগান পরিচর্যার উপায় (Caring Process):
বাড়িতে উল্লম্ব বাগান তৈরি করলে, তাতে কয়েক মাস পর পরই পর্যাপ্ত সার প্রয়োগ করা উচিত। উল্লম্ব বাগানের গাছকে ভিটামিন দিলে গাছের সবুজ অনেকাংশে বেড়ে যায়। পচে যাওয়া হলুদ পাতা নিয়ম করে কেটে ফেলতে হবে। নিয়ম মেনে উল্লম্ব বাগান গড়ে তুললে আপনারই লাভ। ঘরের শোভাও বাড়বে, মনের জীর্ণতাও সবুজের সতেজতায় দূর হবে।
উল্লম্ব বাগানের প্রয়োজনীয়তা (Necessity of Vertical Gardening):
১) ঘরে বা বারান্দায় যেখানে উল্লম্ব বাগান তৈরী করা হোক না কেন, এর ফলে জায়গার নান্দনিক শ্রী বৃদ্ধি ঘটে।
২) উল্লম্ব বাগান বাতাসে অক্সিজেনের সামঞ্জস্য বজায় রাখে। বাতাসের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে প্রাণদায়ী অক্সিজেনের বৃদ্ধি ঘটাতেও সাহায্য করে।
৩) দূষণ নিয়ন্ত্রণেও এই উল্লম্ব বাগানের জুড়ি মেলা ভার। শব্দ দূষণ ও বায়ু দূষণ, এই দুই প্রায় অপ্রতিরোধ্য দানবকে অনেকটা হলেও স্তিমিত করে।
৪) বড় বড় বিল্ডিংয়ের বাসিন্দাদের ঘরে স্বাভাবিক ভাবেই কড়া রোদ ঢোকে। উল্লম্ব বাগান এই সরাসরি আসা সূর্যের তীব্র ঝলকানি থেকে সেইসব বাসিন্দাদের বাঁচাতে সক্ষম হয়। এর সাথে ঘরে ছায়াময় পরিবেশও তৈরী করে।
৫) শুহুরে দূষণ, গাড়িঘোড়া, কলকারখানা নিঃসৃত ধূলিকণা শোষণ করে নেয় এই উল্লম্ব বাগান। ফলে বাতাসও অনেকাংশে পরিশ্রুত থাকে।
আরও পড়ুন: Village Organica-:খাঁটি দেশীয় খাদ্যসামগ্রী ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে এই ই-কমার্স