কলকাতাতে বহু সংখ্যক কিশোরের মধ্যে বিগত ১০ বৎসরে টাইপ-২ ডায়াবেটিস বা অ্যাডাল্ট ডায়াবেটিসের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা পূর্বের ১০ বৎসরের রিপোর্টের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস এইরকম ভাবে কিশোরদের মধ্যে ডায়াবেটিস বৃদ্ধির প্রবণতার হার যদি বৃদ্ধি পায় তাহলে শহরের মোট কিশোর জনসংখ্যার প্রায় ২ শতাংশ আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত হবে বলে আশঙ্কা। শহরের কিছু এনজিও ও কিছু প্রখ্যাত এন্ডোক্রিনোলজিস্ট এর মতে, আগামী পাঁচ বৎসরে এই রোগ শহরে প্রায় মহামারির আকার ধারণ করতে চলেছে, যদি এই পরিমাণ বৃদ্ধির হার বজায় থাকে। এর জন্য তারা অবশ্যই কিশোরদের মধ্যে ডেলিভারি অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে ফাস্ট ফুড খাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন। আসলে এই অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে ফাস্ট ফুড ভক্ষণ করাকে আজকের প্রজন্ম আভিজাত্য বলে মনে করছে, সেই খাদ্যই তাদের প্রাত্যহিক জীবনকে কীভাবে সর্বনাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে এটা তারা বুঝতে চাইছে না।
যেখানে শহরের মোট জনসংখ্যার ১২% ডায়াবেটিস আক্রান্ত বলে মনে করা হচ্ছে, সেখানে এই ব্যাপারটি যে এই শতকরা হিসাবে গভীর প্রভাব ফেলবে তা বলাই বাহুল্য। কিশোরদের মধ্যে এই রোগের বিস্তারের প্রবণতা যে আধুনিক শহুরে জীবনে মানুষের স্বাস্থ্যের প্রতি গভীর প্রভাব ফেলছে তা এক কথায় অনস্বীকার্য, বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস উপলক্ষ্যে একজন বিশেষজ্ঞ এই কথা বলেন।
খুবই হাস্যকর হলেও এই ব্যাপারটি সত্য যে, কলকাতায় এই একই দিনে ‘রসগোল্লা দিবস’ উদযাপিত হয়েছে। এটা সত্যিই দুঃখজনক যে, আমাদের মধ্যে অনেকেরই এখনও সচেতনতা আসে নি যে ডায়াবেটিস একটি নিঃশব্দ ঘাতক। একজন মেডিক্যাল এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ডঃ কৌশিক বিশ্বাস বলেছেন “আমরা আগে কিশোর বয়সে ডায়াবেটিসের কথা চিন্তাই করতে পারতাম না, কিন্তু এখন ২০ বছরের নীচের ছেলেমেয়েদের মধ্যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে”। এটা খুবই চিন্তার বিষয় যে আমাদের যুবসম্প্রদায়ের অসংযত খাদ্যগ্রহণ ও জীবনযাপনের জন্য এই রোগ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। শুধুমাত্র স্থূলত্ব রোগই নয় অনেক ক্ষেত্রে তাদের খাদ্য নির্বাচনেও খুব অজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছে, যে কারণে তারা খুব কম বয়সে ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। সচেতনতার অভাব যে আমাদের যুব সম্প্রদায়কে একটি ভয়ংকর পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য যা কিনা তাদের অকাল ডায়াবেটিসের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে যা থেকে তাদের জীবনকাল কমে যাবে এটা নিশ্চিত”।
অ্যাপোলো হাসপাতালের একজন বরিষ্ঠ শিশু বিশেষজ্ঞ এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ডঃ সুব্রত রায় বলেছেন, “বর্তমানে ১৬ বৎসরের নীচে কিশোরদের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত। তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই টাইপ-২ ডায়াবেটিস রয়েছে।বিগত ২০ বৎসরে দ্রুত নগরায়নের ফলে মানুষের জীবনযাপনের মধ্যে বিপুল পরিবর্তন নিয়ে এয়েছে, যেখানে বাচ্চাদের মধ্যে শারীরিক কসরত করার পরিমাণ অনেকটা কমে গিয়েছে, এবং তাদের খাদ্যাভ্যাস একটা বাজে দিকে মোড় নিয়েছে। ফাস্ট ফুড বর্তমানে কমবেশি সব মানুষই খেয়ে থাকে, যেখানে প্রথাগত বাঙ্গালী বা ভারতীয় খাদ্য যুবসম্প্রদায়ের কাছে ব্রাত্য। বর্তমানে বিভিন্ন খাদ্য সরবরাহকারী অ্যাপ এর ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে ফাস্টফুড খাওয়ার প্রবণতা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে যা কিনা অস্বাস্থ্যকর।তিনি আর বলেন কিশোর টাইপ-২ রোগাক্রান্ত ব্যক্তি খুব অপুষ্টিকর ভাবে বেড়ে উঠছে, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যগ্রহণের ফলে তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে। আমাদের এখন থেকেই এই সমস্ত খাদ্যের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গরে তুলতে হবে, এবং সরকারের খাদ্যদপ্তর ও স্বাস্থ্যদপ্তর থেকেও এই বিষয়ে কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত”।
ডায়াবেটিস অ্যাওয়ারনেস এন্ড ইউ (DAY), একটি এনজিও এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করে চলেছে। তারা সম্যক আলোচনার জন্য পশ্চিমবঙ্গের কমিশন ফর প্রোটেকশন অব চাইল্ড রাইটস এর দপ্তরেও গিয়েছিলেন এবং এই ভয়ংকর বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছেন। এই ব্যবস্থা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে নেওয়া একান্তই জরুরী কারণ রাজ্য হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ডায়াবেটিস এর ক্ষেত্রে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেকটাই বেশি। ডঃ দে আর বলেন, “সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের পূর্বাঞ্চল ও সমগ্র দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়া ডায়াবেটিস প্রবণ অঞ্চল। আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্যাভ্যাসের দিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সারা ভারতে কলকাতার খদ্যসম্ভার অত্যন্ত নিম্নমানের রুচির সাক্ষ্য বহন করছে।
অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা সমস্ত জনসাধারণকে প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে টানা হাঁটার উপদেশ দিয়েছেন এবং তার সাথে গ্রহণ করতে বলেছেন ক্যালোরি সমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাদ্য। একজন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট বলেছেন, “আমাদের এই রোগের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়াই করতে হবে, নয়তো আগামী পনোরো বৎসরে প্রতি ৩ জন বাচ্চার মধ্যে একজন ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত হবে”।
- প্রদীপ পাল