ডিজিটাল কম্পিউটারের বদলে এবার আসছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, যার সাহায্যে মোবাইল ফোন বা ই-মেলে তথ্য বা ডেটা ভরে রাখা যাবে অনেক বেশি পরিমাণে। অনেক বেশি দিন ধরে। অনেক বেশি সুরক্ষিত ভাবে। এখনকার যাবতীয় প্রযুক্তিকেই অনেক বেশি উন্নত করে তোলা যাবে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির মাধ্যমে।
ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে টাকা পাঠানোর সময়, সেনাবাহিনীর সদর দফতর থেকে জওয়ানদের কাছে জরুরি বার্তা পাঠানোর সময় ওই বার্তা তৃতীয় ব্যক্তির কানে পৌঁছলে বা চোখে পড়ে গেলেই ভয়ঙ্কর বিপদ। এই ধরনের যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে প্রয়োজন তথ্যের সুরক্ষার। যাতে সেই তথ্যের দেওয়ানেওয়াটা সীমাবদ্ধ থাকে বার্তা-প্রেরক আর প্রাপকের মধ্যে, তৃতীয় কেউ যেন সেই বার্তার সন্ধান না পায়।
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এখনও পর্যন্ত আমরা যে ধরনের কম্পিউটার ব্যবহার করে চলেছি, সেগুলোর কাজকর্মে যে একক বা ইউনিট ব্যবহৃত হয়, তার নাম ‘বাইনারি ডিজিট’। যাকে সংক্ষেপে বলা হয়, ‘বিট্স’। সেই ‘বিট্স’-কে প্রকাশ করা যায় শুধুই দু’ভাবে। তার শুধুমাত্র দু’টি মান রয়েছে। শূন্য (০) আর এক (১)।
কোনও পদার্থের যদি দু’টি অবস্থা থাকে আর সেই দু’টি অবস্থাকে যদি আলাদা ভাবে বোঝা যায়, তা হলে, তার একটি অবস্থানকে শূন্য (০) আর অন্য একটি অবস্থানকে এক (১) দিয়ে চিহ্নিত করা যেতে পারে।ওই দু’টি মান বা সংখ্যা দিয়েই আমাদের রোজকার জীবনে ব্যবহৃত যাবতীয় কম্পিউটার সব কিছুর যোগ, বিয়োগ আর গুণ, ভাগ করে। যাবতীয় তথ্যের সংরক্ষণ করে। করে বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যার সমাধানও।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলে, অণু, পরমাণু বা যে কোনও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা বা কণিকার বিভিন্ন অবস্থাকে ‘০’ এবং ‘১’ দিয়ে চিহ্নিত করা যেতে পারে, এটা যেমন ঠিক, তেমনই ঠিক, সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা বা কণিকারা একই সঙ্গে থাকতে পারে দু’টি অবস্থানে। একই সময়ে। তা ‘০’ হতে পারে, আবার একই সঙ্গে হতে পারে ‘১’।
এই ‘সুপার পজিশন প্রিন্সিপাল’-এর উপর দাঁড়িয়েই নতুন ধরনের কম্পিউটার বানিয়ে অত্যন্ত জটিল গাণিতিক ধাঁধার জট অত্যন্ত দ্রুত গতিতে খোলার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। আর তারই মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগব্যবস্থাকে অনেক বেশি সুরক্ষিত ও দ্রুততর করে তোলার স্বপ্নটা দেখতে পারছেন। কম্পিউটারের মগজ আরও জোরালো করে তোলার ভাবনাটা ভাবতে পারছেন।
সাধারণ কম্পিউটার যেমন চলে ‘বিট্স’-এর ভিত্তিতে, তেমনই সেই কোয়ান্টাম কম্পিউটার চলবে ‘কোয়ান্টাম বিটস’ বা ‘কিউবিট্স’(qubits)-এর উপর দাঁড়িয়ে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের শক্তি জনার পর বিজ্ঞানীরা আরও একটি জটিল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুরু করলেন। তা হল সুবিশাল কোনও পূর্ণ সংখ্যার (ইন্টিজার) মৌলিক গুণনীয়ক (প্রাইম ফ্যাক্টর) খুব সহজে জানিয়ে দিতে পারবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, আমাদের সাধারণ কম্পিউটারে এখনও পর্যন্ত এই গাণিতিক সমস্যার সমাধান করা প্রায় অসম্ভবই।
আজ থেকে ২৫ বছর আগে মার্কিন বিজ্ঞানী পিটার শোর দেখিয়ে দিলেন ২৫০টি অঙ্কের (ডিজিট) একটি পূর্ণ সংখ্যার মৌলিক গুণনীয়ক কোয়ান্টাম কম্পিউটার বের করে ফেলতে পারে অনেক কম সময়ে। যা আমাদের এখনকার সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারেরও কষে বের করতে সময় লাগত ততটাই, যতটা এই পৃথিবীর বয়স। ৪৫০ থেকে ৫০০ কোটি বছর!
কিন্তু পিটার শোরই প্রথম দেখিয়েছিলেন, এই সমস্যার সমাধান কোয়ান্টাম কম্পিউটার করে ফেলতে পারে ন্যায়সঙ্গত সময়েই। যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে, ‘পলিনোমিয়াল টাইম’। এই আবিষ্কার বিশ্বে সত্যি সত্যিই একটি বড় ধরনের আলোড়ন তুলে দিল।
তিন বিজ্ঞানী চার্লস বেনেট, গিল্স ব্রাসার্ড ও আর্থার একার্ট ১৯৮৪ এবং ১৯৯১ সালেই প্রথম দেখালেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্সই পারে আমাদের তথ্য সুরক্ষারসেই উদ্বেগ থেকে পুরোপুরি মুক্ত করতে।
তাঁরা দেখালেন, কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়েই এমন একটি সংকেতলিপি (কোড) বানানো সম্ভব, যা কোয়ান্টাম কম্পিউটারও ভাঙতে পারবে না। ফলে, তথ্যের আদানপ্রদান বা যোগাযোগব্যবস্থার সুরক্ষাকে অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে হবে না গুগল, আইবিএম এবং ইন্টেল-এর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলি ইতিমধ্যে ছোট মাপের কোয়ান্টাম কম্পিউটারও বানিয়ে ফেলেছে।
এই পদ্ধতিকে চিন ও ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে তথ্যের আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও কাজে লাগানোর উদ্যোগ শুরু হয়েছে। ভারতেও তার প্রস্তুতিতে নেমে পড়েছেন বিজ্ঞানী, গবেষক ও কম্পিউটার প্রযুক্তিবিদরা। সেই কর্মযজ্ঞ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, ভূবনেশ্বর, আমদাবাদ, ইলাহাবাদ (প্রয়াগরাজ)-সহ বিভিন্ন শহরে।
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
রুনা নাথ(runa@krishijagran.com)