নিউ দিল্লিঃ দির্ঘ ৪৮ বছর পর ইন্টারন্যাশেনাল ডেইরি ফারমিং সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল ভারতে।আজ ভারত দুগ্ধ শিল্পে সাফল্যের চুরান্তে রয়েছে। কিন্তু কয়েক দশক আগেও ভারতের চিত্রটা ছিল একদম ভিন্ন।
সালটা ১৯৪৯। তখনও ইংরেজদের দ্বারা ক্রমাগত শোষিত হচ্ছে দেশের কৃষক সমাজ । যখন দেশের অধিকাংশ কৃষক দুবেলা দুমুঠো খেতে পারছে না,ঠিক তখনই গুজরাটের আনন্দ শহরে, এক দুধ সমবায় সমিতিতে কাজ শুরু করেন ২৮ বছরের এক যুবক।ধীরে ধীরে হয়ে উঠলেন কৃষকদের মাসিহা।বদলে দিলেন গোটা দেশের চেহারা।দেশে আনলেন এক ‘আমুল’ পরিবর্তন।যা পরবর্তিকালে শ্বেত বিপ্লবের আকার নেয়।তিনি ভার্গিস কুরিয়েন।
১৯২১ সালের ২৬ নভেম্বর কেরালার এক খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম কুরিয়েনের । পদার্থ বিদ্যায় বি.এসসি ডিগ্রি কমপ্লিট করার পর সরকারী বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা চলে যান, মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পরার জন্য। পড়াশোনা শেষ করে, ভারতে ফিরে আসেন ডঃ কুরিয়েন।ভারতে ফিরে,চুক্তি অনুযায়ী গুজরাটের কয়রা জেলার আনন্দ শহরে একটি দুগ্ধ সমবায় সমিতিতে কাজ শুরু করেন।
আরও পড়ুনঃ আজ জাতীয় বিজ্ঞান দিবস, কেন পালিত হয় জানেন ? জানুন এর গৌরবময় ইতিহাস
কিন্তু ডঃ কুরিয়েনের কোন ইচ্ছে ছিল না এই ছোট্ট শহরে একটি দুধের সমবায়ে কাজ করার।তিনি চেয়েছিলনে মুম্বাই গিয়ে বড় কোন কোম্পানিতে কাজ করতে ।কিন্তু সে সময় কৃষক নেতা ত্রিভুবনদাশ প্যাটালের সঙ্গে সাক্ষাত হয় ভার্গিস কুরিয়েনের।সে সময় সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলর পরামর্শে ত্রিভুবনদাশ শুরু করেছিলেন অসহযোগ আন্দোলন ।গড়ে তুলেছিলেন দুধ সমবায় আন্দোলন ।
ভারতে তখন পলসন নামে একটি কোম্পানি মাখন,দুধ বিক্রি করতো। তাদের পণ্যের মান ভালো হলেও কৃষকদের তারা দুধের সঠিক দাম দিত না।
কৃষকদের স্বার্থে ত্রিভুবনদাশের এই আন্দলোন ডঃ কুরিয়েনকে ব্যপক ভাবে প্রভাবিত করেছিল।পরবর্তীকালে ত্রিভুবনদাশের অনুরোধে আন্দোলনে যোগ দেন ডঃ কুরিয়ান।এই সমবায়ই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে আজকের "আমুল"।
ইতিমধ্যে শেষ হয় কুরিয়ানের চুক্তির মেয়াদ।মেয়াদ শেষ হতেই তিনি ব্যাগ গুছিয়ে ভারতের বাণিজ্য নগরী মুম্বইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।তখন ত্রিভুবনদাশ তাকে অনুরোধ করেন, “আর কয়েকটা দিন থেকে যান”। যাতে সমবায়টা আরও একটু মজবুত হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি,আমি ভুলতে পারি না
ঝাঁ চকচকে মুম্বই নগরীর হাতছানি থাকা স্বত্ত্বেও কৃষক নেতার অনুরোধ ফেরাতে পারেননি ভার্গিস কুরিয়েন। আর তার পরের ঘটনা, আজও ইতিহাস হয়ে রয়ে গিয়েছে। দুধ উৎপাদনে ভারতকে বিশ্বের শীর্ষস্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন শ্বেত বিপ্লবের জনক ভার্গিস কুরিয়েন।
দুধের ঘাটতি দেশ থেকে বিশ্বের বৃহত্তম দুধ উত্পাদক দেশে পরিণত করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই গঠিত হয়েছিল জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড । যা সারা দেশে দুগ্ধ সমবায় আন্দোলন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
ডঃ কুরিয়েন আনন্দ মিল্ক ইউনিয়ন লিমিটেডের একটি অন্য নাম দিতে চেয়েছিলেন যা সহজেই উচ্চারণ করা যায় । তখন সমবায়ের এক কর্মচারী "আমুল" নামটি সুপারিশ করেন।সংস্কৃত শব্দ অমূল্য থেকে আসে আমুল। নামটি মনে ধরে যায় কুরিয়েনের। এভাবেই শুরু হয় আমুলের পথচলা।
আমুল প্রথমেই কতগুলি দুগ্ধ সমবায় সমিতি গঠন করে। এই সমবায়ের কাজ ছিল দিনে দু`বার গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করা। দুধে ননির পরিমাণ অনুয়াযী কৃষকদের দুধের দাম দেওয়া হত। এরপর এই দুধ গ্রাহকদের কাছে সরবরাহ করা হতো। এই সাপ্লাই চেইনটি পুরোপুরি ড. কুরিয়েন এবং ত্রিভুবনদাশ প্যাটেল ডিজাইন করেছিলেন। ফলস্বরুপ আমুল সাফল্যের এক অন্য গল্প রচনা করে।
১৯৬৪ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে আমুলের নতুন প্লান্ট উদ্বোধনের জন্য আনন্দ শহরে আমন্ত্রণ জানানো হয়। দিনের শেষে তাঁর ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু আনন্দ পৌঁছে তিনি সমবায়ের সাফল্য দেখে সেদিন সেখানে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি ড. কুরিয়েনর পরিকল্পনা দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। দিল্লিতে ফিরে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী ড. কুরিয়েনকে সারা দেশে আমুলকে ছরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করতে বলেন । তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ ১৯৬৫ সালে ভারতে জাতীয় দুগ্ধ উন্নয়ন বোর্ড (এনডিডিবি) তৈরি হয়েছিল। ড. কুরিয়ান এনডিডিবি-এর দায়িত্ব নেন এবং সারা দেশে আমুলকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেন।
এই সময়ের মধ্যে দুধের সরবরাহ দ্রুত হারে বাড়ছিল। ভারত সহজেই শ্রীলঙ্কার মতো দুধের সবচেয়ে বড় আমদানিকারী দেশ হয়ে উঠতে পারত, যদি না সে সময় ডঃকুরিয়েন পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহন করতেন।সারা দেশে শুরু হয়‘অপারেশন ফ্লাড’। ড. কুরিয়েন এখানেও সফল হন। অপারেশন ফ্লাডের আওতায় ভারতে প্রায় এক লক্ষ সমবায় এবং ৫০ লক্ষ্য দুধ উত্পাদক কৃষক যুক্ত হয়।
ডঃ কুরিয়ানের জীবনির উপর ভিত্তি করে শ্যাম বেনেগল তৈরি করেছিলেন ‘মন্থন’ ছবিটি।কিন্তু ছবি তৈরি করার সময়, প্রযোজক পাচ্ছিলেন না শ্যাম বেনেগল ।তখন শ্যাম বেনেগলের সাহায্যে এগিয়ে আসেন ডঃ কুরিয়েন। তিনি সমস্ত কৃষকদের অনুরোধ করেন ছবির তহবিলে দু’টাকা করে জমা দিতে। কৃষকদের দেওয়া চাঁদা থেকে তৈরি হয়েছিল মন্থন ছবিটি।