রাজ্যবাসী যখন বাগদেবীর আরাধনায় রত, সেই মুহূর্তে হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুর বিধান সভা তথা আমতা ১ নং ব্লকের খোশালপুর গ্ৰাম পঞ্চায়েতের কুরিট গ্ৰামের গ্ৰামবাসী মেতে উঠেছে ৪১ তম বার্ষিক দশভূজা কাত্যায়নী দুর্গাপূজায়।
অকাল দুর্গোৎসব প্রাঙ্গনে বিশালাকৃতি সুপ্রাচীন বটবৃক্ষ। পাশেই তারাময়ী আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা গৌরচন্দ্র হাজরার সমাধি। বটগাছের তলায় মন্ত্রপূত ত্রিশূলের সামনে তিনি তন্ত্র- সাধনায় বসতেন। বুধবার সেখানেই প্রকান্ড হোমকুন্ডে চলছে হোমযজ্ঞ। মহানবমী পুজোর শেষপর্বে উচ্চারিত হচ্ছে বৈদিক মন্ত্র। একটি করে সমিধ ও ঘৃতাহুতি তে উজ্জ্বল পবিত্র হোম শিখার দীপ্তি। পোহাল নবমী নিশি। বেজেছে বিদায়ের সুর। রাত পোহালেই বিজয়া। বিসর্জনের বিষাদ। হাওড়ার আমতা কুরিট গ্ৰামের অকাল দুর্গোৎসব সাঙ্গ। তবু একটু আনন্দ নিহিত থাকছে কাত্যায়নী মেলাকে কেন্দ্র করে আর ও চারদিন। "করোনা " স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এই মেলা চলছে। পূজা ও মেলার উদ্যোক্তারা সহ স্বেচ্ছাসেবক-স্বেচ্ছাসেবিকাবৃন্দ "করোনা "সচেতনতা বার্তা দিচ্ছেন,মাক্স বিতরণ করছেন।
এদিন সকাল থেকেই মন্ডপে ভিড় উপচে পড়ছে । কুরিট সহ প্রতিবেশী বড়মহড়া,চাকপোতা,খোশালপুর,কোটালপাড়া,ছোটমহড়া,মল্লগ্ৰাম, সোমেশ্বর এমনকি হাওড়ার দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা ভিড় জমিয়েছেন। মায়ের পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছেন । শস্যের প্রার্থনার সঙ্গে মহামারী "করোনা" দূরিকরণের সঙ্গে বিশ্বশান্তির আর্জি জানিয়েছেন মহালক্ষ্মী কাত্যায়নীর কাছে । বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে হোমযজ্ঞ দেখতে ভক্তকূল আকূল হয়েছেন। দুপুর ১ নাগাদ শুরু হয়েছে হোমযজ্ঞ, মূল মন্ডপ থেকে ৫০ ফুট দূরে প্রকান্ড বটবৃক্ষ তলায়। একপাশে সাজানো ফুলের বাগান। অন্যধারে তারামায়ের মন্দির।পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ডি-২ ক্যানেল। শস্যের প্রার্থনায় এলাকাবাসীর দুভিক্ষ ঘোচাতে,দুর্দশা দূর করতে দেবী কাত্যায়নীর আবাহন করা হয়েছিল আজ থেকে ৪৯ বছর আগে কুরিট গ্ৰামে। তারপর ওই খালের জলেই খরা কেটে চাষাবাদ শুরু হয়েছিল।
শস্যহানির বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত হয়েছিল কুরিট সহ পার্শ্ববর্তী অনেক গ্ৰাম। সেই থেকেই কাত্যায়নীর আরাধনায় নিবেদিত প্রাণ উত্তম কোলে, জয়দেব কোলে,
প্রিয়তোষ কাঁড়ার ও সুকুমার বাবুরা। গ্ৰামবাসীদের ভক্তিভরে দেওয়া স্বেচ্ছাদানে তাঁরা এই পূজা করেন। পূজার ক' দিন রাস্তার ধারে দু'চারজন মেলায় আসা দর্শনার্থীদের কাছ থেকে স্বেচ্ছাদান গ্ৰহণ করেন । খুশি করে যা দিয়ে যান দর্শনার্থীরা,তা নিয়েই সন্তুষ্ট তারাময়ী আশ্রমের সদস্যরা। কয়েক দিন পরেই অন্নপূর্ণা পূজা।সেই পূজায় অন্নকূট উৎসবে গ্ৰামবাসীরা নারায়ণ সেবার আয়োজন করে এই মাঠেই । মাঠের একাধারে রয়েছে কালী মন্দির।
এই পূজা প্রসঙ্গে পূজার অন্যতম উদ্যোক্তা উত্তম কোলে বলেন, আমার পূর্বপুরুষরা যা দেখেছে তা শুনেছি যে " তারাময়ী আশ্রম" যেখানে প্রতিষ্ঠিত আজ থেকে ১৩৫ বছর আগে এই স্থানটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। শিয়াল, কুকুর সহ বিষধর সাপের আস্তানা ছিল। বড়মহড়া গ্ৰামনিবাসী তারামা ভক্ত বিশ্বনাথ হাজরা সাধনায় সিদ্ধলাভ করার জন্য ওনার গুরুদেবের সঙ্গে আলোচনা করে এই জঙ্গলে আসেন সাধনা করতে। সাধনা করার জন্য পঞ্চমুন্ডি আসনের প্রয়োজন। পঞ্চমুন্ডি আসন করার জন্য শিমুল,বেল,নিম,বট, পিপুল এই পাঁচটি গাছের যে কোন একটি গাছের নীচে আসন তৈরী করতে হয়। বিশ্বনাথ হাজরা এই জঙ্গলের একটি বট গাছ কে বেছে নেন সাধনার জন্য পঞ্চমুন্ডি আসন নির্মাণে।
পঞ্চমুন্ডির আসনের প্রতিষ্ঠার কাজ শেষ করে আসনে বসেন সাধনায় সিদ্ধলাভ করার জন্য। সাধনায় সিদ্ধলাভ করেন বিশ্বনাথ হাজরা। এরপর বিশ্বনাথ হাজরা এই জঙ্গলকে সাধনক্ষেত্র করে তারামা কে প্রতিষ্ঠা করে সাধনায় রত হন। জঙ্গল কেটে তৈরী করেন তারামা মন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির। বটবৃক্ষের তলায় পঞ্চমুন্ডির আসন তৈরী করে মন্ত্রপূত ত্রিশূলের সামনে তন্ত্র-সাধনায় বসতেন। পদ্মপাতায় মায়ের ভোগ খাওয়াতেন। তাঁর মৃত্যুর পর আস্তে আস্তে ঐ স্থানটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।কেউ মারা গেলে সামান্য জঙ্গল কেটে দাহ করা হত।
তথ্য সুত্রঃ অভিজিৎ হাজরা