ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতীয় উপমহাদেশে এসে আফিমের অনৈতিক ব্যবসায়ে জড়িয়ে গিয়েছিল। চেষ্টাও করেছিল, এই ব্যবসায়ে একচেটিয়া অধিকার রাখতে। চীনের সঙ্গে সংঘাতও বেধেছিল আফিমের কারণে। ঐ সূত্র ধরেই কোন এক সময়ে চীন থেকে ফেরার পথে কোন এক জাহাজের ক্যাপ্টেন বুদ্ধি করে ফেরার পথে খালি জাহাজে চীন থেকে কিছু চা নিয়ে আসে, আর ঐ চা ইংল্যান্ডের রয়াল কোর্টে সাজিয়ে সকলকে দেখানো হয়। সেই শুরু হলো চায়ের বিশ্বায়ন। তাই সারা বিশ্বে চা চালু করার জন্য ব্রিটিশদের আমরা ধন্যবাদ দিতে পারি। পোর্তুগীজরা অবশ্য এই চায়ের কথা আগেই জানতো। মার্কোপোলো যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন ঐ কালো চীনা-চায়ের সাথে তিনি পরিচিত হয়েছিলেন। সম্ভবতঃ কিছুটা চা সাথে করে নিয়েও এসেছিলেন। পরবর্তীকালে ডাচরাও ছোটো আকারে চা আমদানী করেছিলো।
যাই হোক, ব্রিটেনে চা ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। সামাজিক স্তরে চা-এর বিশেষ মর্যাদা বাড়লো, অভিজাতদের ঘরে যে কোন অনুষ্ঠানে চা পরিবেশন করা নৈমিত্তিক হলো, বাণিজ্য ও কূটনীতিক আলোচনায় চা-পান বিশেষ ভূমিকা পালন করতে লাগলো।
এই সুন্দর মনোগ্রাহী চা কিন্তু সংকটে পড়লো যখন কোন এক চীনা জেনারেল ১৮২০ সালে আফিমের চোরাচালানকারীদের দমন করতে শুরু করলেন। এই সংকট থেকে বাঁচতে চা বনিকেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে অনুরোধ করলো যেন তারা চীনা চা প্রস্তুতকারীদের সাথে যোগাযোগ রেখে ব্রিটিশ উপনিবেশ গুলির অন্যত্র চা চাষ শুরু করে, এটাই হবে একমাত্র বিকল্প সমাধান। ব্রিটিশদের পক্ষে চা কে দূরে রাখা সম্ভব নয়। চা হ'লো সামাজিক মর্যাদার অংশ।
স্কটিশ বটানিস্ট রবার্ট ফরচুন ব্রিটিশ রাজশক্তির খুব কাছের মানুষ ছিলেন। রয়াল বোটানিক গার্ডেনে কাজ করতেন। অত্যন্ত দক্ষ প্রযুক্তিবিদ ছিলেন ফরচুন। ১৮৪২ সালে তিনি চীনে যান। সাহসী এই প্রযুক্তিবিদ ১৮৪৮ সালে চীন থেকে চায়ের বীজ ও চারা সংগ্রহ করে নিয়ে এসে কলকাতায় গভর্নর জেনারেলকে দেন। সেই বীজ উপনিবেশের যেখানে সেখানে ছড়ানো হয়েছিল, দার্জিলিং তার মধ্যে একটি জায়গা। সৌভাগ্যক্রমে দার্জিলিং-এর মাটি, আবহাওয়া ঐ চায়ের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করেছিলো। চায়ের মধ্যে মনমুগ্ধকর এক স্বাদ এল, যা সবাইকে বিমোহিত করল, ধীরে ধীরে সারা বিশ্ব দার্জিলিং-এর চায়ের গন্ধে আকৃষ্ট হলো। অতি তাড়াতাড়ি দার্জিলিং চা একটি স্বতন্ত্র ব্র্যান্ড হিসেবে স্বীকৃতি পেল। দার্জিলিং ও কার্সিয়ং অঞ্চলের মাকাইবাড়ি এলাকায় প্রথম চা ফ্যাক্টরি তৈরী হ'ল ১৮৫৯ সালে। ইতিমধ্যে অষ্টাদশ শতাব্দীতে জেমস ওয়াটের বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কার শিল্প বিপ্লব ঘটিয়েছিলো । তারই সূত্র ধরে ১৮৭৮ সালে কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি মিটারগেজ ট্রেন চালু হল। তার দু-বছর পর ১৮৮০ সালে শিলিগুড়ি থেকে কার্শিয়ং টয় ট্রেন চলতে শুরু করল। দার্জিলিং-এর চা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। এ এক যুগান্তকারী ঘটনা।
ভারতে চায়ের সম্প্রসারনে ১৮৩১ সালে গভর্নর জেনারেল বেন্টিঙ্কের নেতৃত্বে “ টি কমিটি “ গঠন, ক্যাপ্টেন চার্লস আলেকজান্ডার ব্রুসের মাধ্যমে অনুসন্ধান, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চায়ের প্রসার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সৌজন্যে লন্ডনে ১৮৩৪ সালে জনগণের জন্য প্রথম চায়ের অকসন প্রথা চালু হ'ল। এতে বিনিয়গকারীরা আকৃষ্ট হয়। আসাম টি কোম্পানী অর্দ্ধ মিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ করে। এইভাবে এস্টেটের তত্বাবধানে চা বাগিচার অগ্রগতি শুরু হয়। এরপর আসামে একে একে অনেক চা কোম্পানী তৈরী হল। ১৮৬২ সালের মধ্যে আসামে ১৬০-টি টি-এস্টেট তৈরী হয়। এই গতিধারা বজায় রেখে ধীরে ধীরে কাছাড়, তরাই, ডুয়ার্স, ছোটনাগপুরে ১৮৯৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন চা কোম্পানী প্রতিষ্ঠিত হয়।
ইতিমধ্যে ব্রিটিশ রাজশক্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ক্ষমতা হ্রাস করল। আর ব্রিটিশ রাজশক্তির সরাসরি নজরদারিতে চায়ের ব্যবসা দ্রুতগতিতে এগোল। চা- এর এই রমরমাতে উত্তরে-Indian Tea Association (ITA) এবং দক্ষিণে United Planters Association (UPASI) প্রতিষ্ঠিত হল। এদের দ্বায়িত্ব হ'ল চা ব্যবসার সমস্যাগুলো বাগিচার মালিক/শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করে সমাধানের রাস্তা বের করা।
এইসব প্রচেস্টার ফলে ব্রিটিশ উপনিবেশের সর্বত্র ভারতীয় চা চীনা চা কে হটিয়ে নিজের অস্তিত্ব শক্তিশালী করল। চা প্রযুক্তিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ আরম্ভ হলো। আসামের রাস্তাঘাটের সংযোগ বাড়ায় এবং রেল যোগাযোগ ভালো হওয়ায়, ওখানে চা ব্যবসা বাড়তে লাগলো। ইতিমধ্যে স্কুল/কলেজ/হাসপাতাল তৈরী হলো। দুটো গবেষণা কেন্দ্র তৈরী হ'ল- একটা ১৯১১ সালে আসামের টোকলাই তে (TRA), অন্য টা ১৯২৪ সালে দক্ষিণ ভারতে (UPASI), এই দুটি প্রতিষ্ঠানের অবদান অনেক। দক্ষিণ ভারতে চা সম্প্রসারনে ডঃ ক্রিস্টির কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য। কলকাতা থেকে পাঠানো প্রায় ২০০০ চা এর গাছ নিয়ে তিনি নীলগিরি, কুর্গ(মাইসোর) এ কাজ করেন।
ইতিমধ্যে দার্জিলিং এর আবহাওয়া ব্রিটিশদের ভালো লাগায় অচিরেই দার্জিলিং হয়ে উঠলো গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। গভর্নরের সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হ'ল। বিদেশী স্টাইলে স্কুল, কলেজ গঠিত হলো। থাকার মতো হোটেলও বানানো হ'ল। গরমের সময়ে বহু অভিজাত মানুষ দার্জিলিং এ ভীড় করতেন। কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য, পাহাড়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য ভ্রমণকারীদের বিমোহিত করত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৫০ সালে চা দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৃষি সম্পদ হয়ে উঠেছিলো। তৎকালীন দেশের কর্ম সংস্থানের ১৮ শতাংশ, রপ্তানীর ১৪ শতাংশ এবং GNP র ১০১৬ শতাংশ চা এর অবদান হিসেবে স্বীকৃত। ৩ লাখ হেক্টরে চা চাষ হ'তে লাগলো। ভারত তখন বিশ্বের বৃহত্তম চা উৎপাদনকারী (বিশ্বের চা উৎপাদনের শতকরা ৪৪ ভাগ) এবং রপ্তানীকারক ( বিশ্বের মোট শতকরা ৪৫ ভাগ ) দেশ ছিল। ইতিমধ্যে স্বাধীনতা হ'ল ১৯৪৭-এ। নতুন সরকার এল। কিন্তু তারা যে নীতি নিলো তা চা ব্যবসার পক্ষে অনুকূল হলো না। ফলে ১৯৫২/৫৩ সালে চায়ের দাম পড়ে গেল।
এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত কিছু বুঝে ' টি বোর্ডের ' মাধ্যমে সরকার চা বাগিচায় নতুন করে জোয়ার আনার চেষ্টা করল। কিছু আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব এবং অপর্যাপ্ত সহায়তার পরিমাণ কাজের গতি হ্রাস করে দিলো। টি বোর্ডও সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সমর্থন পায়নি, এছাড়া, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় করের চাপ, শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষার জন্য ( নাকি ভোট ব্যাঙ্ক রক্ষার জন্য ) নানা আইনের প্রবর্তন- এই সব চায়ের গতিকে হ্রাস করে দিল। অর্থনৈতিক অব্যবস্থায় শ্রমিক অসন্তোষ তীব্র হলো। এই অসন্তোষ যেমন চায়ের বাগানে, তেমনি বন্দরেও দেখা দিল। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হ'ল ক্রেতারা। এই সুযোগে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে তৈরী চা ভারতে প্রবেশ করল। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত চায়ের সাম্রাজ্যে ভারত ছিল সম্রাট; পরবর্তী কালে শ্রীলংকা, কেনিয়া, মালব্য, রোয়ান্ডা, ইন্দোনেশিয়া ও চীন ভারতে চা বাণিজ্যের অন্দরে ঢুকে গেল।
দার্জিলিং চায়ের সমস্যা অন্যরকম, অন্যান্য চা উৎপাদনশীল পাহাড়ী এলাকা থেকে দার্জিলিং পাহাড়ের অবস্থা কিছুটা কঠিন। এখানে বৃষ্টি প্রচুর, খাড়া পাহাড় এবং ফসল তোলার সময় খুব ছোট। জলবায়ু প্রতিকূল। বৃষ্টি প্রচুর হওয়ার ফলে মাটির উপরিভাগ ধুয়ে যায়।
মাইক্রোচিপসের দৌলতে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। নতুন প্রজন্ম হয় শাহরুখ খান বা ঐশ্বরিয়া রাই হবার স্বপ্ন দেখে, চা এর বাগানে হাত দিতে চায় না, বরং এই নবীনেরা IT সেক্টরে বা এয়ারলাইন্সের চাকরী নিয়ে ভালো মাইনের লোভে বাগান থেকে সরে যাচ্ছে। বাগানে কাজ করার সেইরকম লোক নেই। দু দশক আগে সেখানে ১৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপন্ন হত, ২০১৬ তে তা হয়েছে ৮ মিলিয়ন কেজি। ২০১৭-র রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য এ বছর মাত্র ২ মিলিয়ন কেজি চা উৎপন্ন হয়েছে। দার্জিলিং এর আগামী ভবিষ্যৎ আরও কঠিন। হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, নেপাল, সিকিম, ও নীলগিরি চায়ের ক্রমবর্দ্ধমান বাণিজ্য দার্জিলিং চা কে সংকটের মধ্যে নিয়ে এসেছে। নেপালের ইলামে যে মডেলে চা তৈরী ও বাজার জাত হয়, তা ক্ষুদ্র চা চাষিরা অনুসরণ করতে পারে। সেখানে ক্ষুদ্র চাষিরা চা চাষ করে এবং সেন্ট্রাল কোঅপারেটিভ ফ্যাক্টরীতে চা তৈরী করে। ওখানে কোন বাধাধরা মাইনে নেই, করের বাহুল্য নেই, নেপালী চা নানা কারণে এখন অনেক উন্নত হয়েছে।
১৮০০ সালে আসামে ও পরে ডুয়ার্স-তরাইতে চা বাজার একটি নির্দিষ্ট রাস্তা মেনে এগিয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৮৩ সালের কাছাকাছি সময়ে এ অঞ্চলে চা এর নবজাগরণ হলো। চায়ের দাম প্রচুর বেড়ে গেল, Boom দেখা গেল, ৫০ শতাংশ চা বাগান চলল, ১০% বন্ধের মুখে পড়ল ও বাকী ৪০% বন্ধ হয়ে গেল। এরই এক বছর পর ১৯৮৪ সালে দার্জিলিং এ চা এর বাজারে জোয়ার এসেছিল। সব জায়গা থেকে চাএর লোভনীয় প্রিমিয়াম পেতে শুরু করল। বিনিয়োগকারী যাদের চা সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই, তারাও বস্তাভর্তি টাকা পেতে থাকলো। যে সমস্ত চা বাগান বন্ধ ছিলো, তারা আবার নতুন করে বাঁচলো। বামপন্থী শ্রমিক ইউনিয়ন এর লাভ তুলতে লাগলো। শ্রমিকের জন্য তারা বহু দাবী রাখলো চা কোম্পানির কাছে। আর চা কোম্পানিও বিনা শর্তে বহু দাবী মেনে নিলো। বাগানগুলিতে শ্রমিকদের প্রতাপ বেড়ে গেল। বিশৃঙ্খলা শুরু হলো চা বাগানে। সুখের কথা, প্রতি বছর চায়ের মূল্য ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি হচ্ছিল। বিনিয়োগকারীরা লাভের আশায় বাগান থেকে চীনা জাত হটিয়ে দিয়ে সেই জায়গায় উচ্চফলনশীল আসাম চায়ের জাত নিয়ে এল যার জন্য রাসায়নিক সার ও কীটনাশক পদার্থের ব্যবহার প্রয়োজনের থেকেও অত্যন্ত বেশী মাত্রায় ব্যবহৃত হ'তে লাগলো।
ফলনও বাড়লো অনেক, হেক্টর প্রতি ২৫০০ কেজি, পরিমাণ হয়তো এতে বাড়লো কিন্তু চায়ের গুণ ক্ষতিগ্রস্ত হল। সুখের কথা, এই সব অঞ্চলে তখন ক্ষুদ্র চা চাষিরা সংগঠিত হল। ডুয়ার্সেই তখন ৪৪০০০ ক্ষুদ্র চা চাষি। এরা চায়ের স্বার্থ বাঁচিয়ে রাখতে যথাযথ প্রয়াস নিল। আজকের দিনে নতুন মন্ত্র হলো-পার্টনারশিপ চাই, ওনারশিপ(ownership) নয়।
মুশকিল হ'ল, অন্যেরা চায়ের বদলে অন্য কৃষিক্ষেত্রে যেতে পারলেও দার্জিলিং এর চা ছাড়া গতি নেই, কেননা এখানে আলাদা ভাবে কোন কৃষি জমি নেই। তবে ডুয়ার্স সহ অন্যান্য অঞ্চলে ক্ষুদ্র চা চাষিরাই সক্রিয়ভাবে চা এর উৎপাদনে আগ্রহ নিচ্ছে। বহুদিন ধরে উপভোক্তারা চাইছে, যে চা তারা খাবে তা যেন স্বাস্থ্যসম্মত হয়, রাসায়নিক বিষমুক্ত হয়, তাই জৈব চা (organic tea) উপভোক্তাদের কাছে মনপসন্দ। দার্জিলিং এর তৈরী জৈব চা স্বাদে-গন্ধে অনন্য। রাষ্ট্রপুঞ্জ যেন ২০৩০ সালের মধ্যে Sustainable Development Goal (SDG) এ পৌঁছতে চাইছে। নিঃসন্দেহে, এই লক্ষে ভারতের ভূমিকা সদর্থক হবে।
- রাজা ব্যানার্জি (আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জৈব চা বিশেষজ্ঞ - দার্জিলিং)
Share your comments