মৌমাছিকে তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে এনে মৌচাকের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পালন করাকেই বলা হয় মৌমাছি পালন | অধিকাংশ ফসলের ফলন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হল মৌমাছির সংখ্যা হ্রাস। ফলন বৃদ্ধিতে মৌমাছির যেমন গুরুত্ব রয়েছে তেমন মধুর অনেক উপকারিতাও রয়েছে। তাই মধুর চাহিদা সর্বকালের, সর্বজনবিদিত।
মৌমাছি পালন খুব একটা কঠিন কিছু নয়। আর মৌমাছি পালনের মাধ্যমে অনায়াসে বিকল্প আয়ের দিশা দেখতে পারেন কৃষকরা। বর্তমানে কৃষি দপ্ততর থেকে মৌমাছি পালনে বিশেষ উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের । ইতিমধ্যে কৃষি দপ্তরের আত্মা প্রকল্পে কাটোয়া-১ নম্বর ব্লকের খাজুরডিহি পঞ্চায়েতের একাইহাট এলাকায় সরকারি প্রকল্পে মৌমাছি পালন শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে মধু উৎপাদনও । কৃষি দপ্তর থেকে সরাসরি এই ধরনের উদ্যোগ প্রথম। মৌমাছি পালন দেখে এগিয়ে আসছেন অনেক কৃষকবন্ধুরা |
মধু উৎপাদনের জন্য প্রায় ৬-৭ রকমের মৌমাছি মূলত পালন করা হয়। তার মধ্যে ‘এটিস মেলিফেরা’ নামে ইটালিয়ান প্রজাতির মৌমাছি পালন বেশ গুরুত্বপূর্ণ । এই প্রজাতির মৌমাছি দেশীয় প্রজাতির মৌমাছির তুলনায় অনেক বেশি মধু উৎপাদন করে।
মৌমাছি পালনের সরঞ্জাম:
মৌমাছি পালনের জন্য মৌ-বাক্স, ধোঁয়াদানি, বটম বোর্ড, ব্রড চেম্বার, সুপার চেম্বার, টপ ব্রুড চেম্বার, ক্রাউন বোর্ড, মধু নিষ্কাষন যন্ত্র, রানি মৌমাছি অবরোধ জাল, ডামি বোর্ড, টুপি ও বোরখা, পুরুষ মৌমাছি ধরা ফাঁদ, হাইভ স্ট্যান্ড প্রয়োজনীয় |
উপযুক্ত পরিবেশ:
মৌ-বাক্স রাখার জন্য নির্বাচিত স্থানটি ছায়াযুক্ত, শুকনো ও আশপাশে মৌমাছির খাদ্য সরবরাহের উপযোগী গাছ-গাছালি দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়া অতি-প্রয়োজনীয়। প্রয়োজনে কিছু কিছু ঋতুভিত্তিক গাছ জরুরি ভিত্তিতে লাগানো যেতে পারে। নির্বাচিত স্থানের আশপাশে যেন বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী এবং ধোঁয়া উৎপাদনকারী কোনো কিছু না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
পালন:
যে কাঠের বাক্স মৌমাছি পালন করা হয় সেটি বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ে তৈরী। মধুঘর ও বাচ্চাঘরে সারি সারি কাঠের ফ্রেম সাজিয়ে দেয়া হয়। এ ফ্রেমেই মৌমাছিরা চাক তৈরি করে। কোনো গাছের গর্ত থেকে মৌমাছি ও তাদের চাক সংগ্রহ করার পর বাক্স দেওয়া হয়। একটি মৌমাছি পরিবারে থাকে মাত্র একটি রানী মৌমাছি, কিছু পুরুষ এবং অধিকাংশ শ্রমিক মৌমাছি। চাক তৈরি, বাচ্চাদের লালনপালন, মধু এবং ফুলের পরাগ সংগ্রহ ইইত্যাদি সব কাজ শ্রমিক মৌমাছিরাই করে। কিন্তু মৌমাছি পালন করে চাক থেকে মধু পেতে হলে একজন মৌমাছি পালককে মৌমাছিদের যত্ন নেয় ।
মৌমাছি পালনের নিয়ম:
যে জায়গায় বাক্সে মৌমাছি পালন করা হয় তার পাশাপাশি প্রায় সাত কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মধু সংগ্রহ করবে মৌমাছিগুলি। পাশাপাশি জমিগুলির ফসলের ফুল, বিভিন্ন গাছের ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে আবার মৌমাছিগুলি ফিরে আসবে কাঠের বাক্সে। অন্য কোথাও উড়ে পালানোর সম্ভাবনা নেই। অক্টোবর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মৌমাছিগুলির মধু উৎপাদনের সময়। এই মরশুমের মধ্যে ১৫ বার পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করা যায়। এক একটি কাঠের বাক্স থেকে গড়ে ৭০ কেজি করে মধু পাওয়া যাবে। এক একটি কাঠের বাক্সে প্রায় ১০ বছর পর্যন্ত চাষ করা যায়। তবে বর্ষাকালে কাঠের বাক্সগুলিকে খোলা জায়গা থেকে তুলে ছাউনি দেওয়া জায়গায় রাখতে হবে। যাতে বৃষ্টিতে ক্ষতি না হয়। বর্ষায় মৌমাছি মধু সংগ্রহ করতে পারে না। তাই সেসময় মৌমাছিগুলিকে রক্ষা করার জন্য সময়ে সময়ে চিনির রস বাক্সে দিতে হবে |
রোগবালাই:
বিভিন্ন প্রকার শত্রু ও রোগের আক্রমনে মৌমাছি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে । ভিজে, স্যাতসেঁতে আবহাওয়ায় মোমপোকার আক্রমণ সবচেয়ে বেশী হয়। চাকের কুঠুরির উপরে মাকড়সার জালের ন্যায় আবরণ দেখেই বোঝা যায় মৌমাছিদের মোম-পোকা আক্রমণ করেছে। তাই লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন বৃষ্টির মধ্যে বাক্স না থাকে |
আরও পড়ুন - বাগানে সাথী ফসল চাষ – কৃষক বন্ধুর বাড়তি আয়ের উৎস
প্রধানত, মৌমাছি পালনের মাধ্যমে মধু উৎপাদন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি জমিতে ফসলের উৎপাদনও বহুগুণ বাড়ানো যায় | তাই মৌমাছি পালনে দু’দিক থেকেই লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে।
নিবন্ধ: রায়না ঘোষ
আরও পড়ুন - অতিরিক্ত লক্ষ্মীলাভে চাষ করুন ছোলা, জেনে নিন সহজ পদ্ধতি