গরমের ফল লিচু খেতে আবালবৃদ্ধবণিতা সারা বছর মুখিয়ে থাকে। লিচুর স্বাদ এমনই যার জন্য গরমকালে বাজারে হামলে পড়তে দেখা যায় লিচু প্রেমীদের। অত্যন্ত পুষ্টিকর ও রসালো এই ফল স্বাস্থ্যের পক্ষেও অত্যন্ত ভালো। আম যেমন বাঙালির গরমকালকে মজিয়ে রাখে, তেমনই লিচুও বাংলাকে রসেবশে রাখে সারা গরমটা জুড়ে। গোটা গরমকাল জুড়ে এই ফলের চাহিদা থাকায়, বহু চাষি লিচুর চাষ করে থাকেন। অত্যন্ত সুস্বাদু এই রসালো ফলের বহুদিন ধরে বাংলায় রমরমিয়ে চাষ চলছে। আসুন জেনে নেওয়া যাক, লিচু চাষের পদ্ধতি
মাটি (Soil)
জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ নিষ্কাশিত গভীর উর্বর দো-আঁশ মাটি লিচু চাষের জন্য আদর্শ। তবে বেলেমাটি লিচু চাষের অনুপযুক্ত। নতুন চারার গোড়ায় পুরনো লিচু গাছের নিচের কিছু মাটি প্রয়োগ করে দ্রুত মাইকোরাইজা সৃষ্টি হয়।
জমি তৈরি (Land Preparation)
লিচু চাষের জন্য নির্বাচিত জমি ভালো করে লাঙল, পাওয়ারটিলার, কিংবা ট্রাক্টর যে কোনোটির দ্বারা চাষ ও পরে মই দিয়ে জমি সমতল ও আগাছা মুক্ত করে নিতে হবে। জমি থেকে ইট, পাথর, অন্য কোনো গাছের গোড়া ইত্যাদি যদি থাকে তবে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। জমি চাষের ফলে মাটিতে প্রচুর বায়ু চলাচল হয়। ফলে মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি গাছের জন্য সহজলভ্য হয়। তাছাড়া শিকড় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
রোপণ (Plantation)
রোপণ প্রণালী হলো রোপিত চারার পারস্পরিক অবস্থান। প্রতি হেক্টর জমিতে কি পরিমাণ লিচুর চারা লাগানো সম্ভব তা নির্ভর করে রোপণ দূরত্ব, জমির আকৃতি ও রোপণ প্রণালীর ওপর। সমতল ভূমিতে বর্গাকার প্রণালীতে এবং পাহাড়ি ভূমিতে কন্টুর প্রণালীতে লিচু গাছের চারা লাগানো হয়।
চারা রোপণের দূরত্ব (Planting Distance)
ঘন করে লিচুর চারা লাগানো হলে সেসব গাছে সূর্যের আলো পায় না। ফলে গাছে খাদ্য প্রস্তুত ভালোভাবে হয় না। গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। তাছাড়া রোগ-পোকামাকড়ের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। কিন্তু গাছের জন্য অনুমোদিত দূরত্ব অনুরসণ করলে উপরিউক্ত সমস্যা থাকে না। লিচুগাছ সাধারণত ১০-১২ মিটার দূরত্বে লাগানো উচিত।
চারা রোপণের সময় (Planating Time)
বর্ষাকাল চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় অর্থাৎ জুন-জুলাই মাস। তবে চারা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত লাগানো চলে। প্রখর রোদ ও হাওয়ায় চারা লাগানো যাবে না। বিকেলে চারা লাগানো সবথেকে ভালো।
গর্ত তৈরি
বর্ষার আগেই নির্ধারিত জায়গায় গর্ত করতে হবে। গর্তের দৈর্ঘ্য ১ মিটার, প্রস্থ ১ মিটার ও গভীরতা ১ মিটার রাখতে হবে। গর্ত তৈরির সময় গর্তের ওপরের মাটি এক পাশে ও নিচের অংশের মাটি অন্য এক পাশে রেখে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ফলে মাটিতে কীট বা রোগের জীবাণু থাকলে রোদে তা মারা যাবে। গর্তের ওপরের অংশের মাটির সাথে ২০-২৫ কেজি গোবর সার, কিছুটা পুরনো লিচু বাগানের মাটি, টিএসপি ৬০০-৭০০ গ্রাম, এমপি ৩৫০-৪৫০ গ্রাম, জিপসাম ২০০ -৩০০ গ্রাম, জিঙ্ক সালফেট ৪০-৬০ গ্রাম মিশিয়ে দিতে হবে এবং ওপরের এই সার মিশ্রিত মাটি গর্তের নিচে এবং গর্তের নিজের মাটি গর্তের ওপরে দিয়ে পুরো গর্তটি ভরাট করতে হবে। প্রতি বছর সারের পরিমাণ কছুটা বাড়িয়ে দিতে হবে। গাছের বয়স ১০-১৫ বছর হলে সারের মাত্রা দ্বিগুণ করতে হবে।
চারা রোপণ পদ্ধতি (Planting Process)
গর্ত ভর্তি করার ১০-১৫ দিন পর চারাটি ঠিক গর্তের মাঝখানে রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের পর খুঁটি এবং প্রয়োজনে খাঁচা দিয়ে চারাকে রক্ষা করতে হবে। চারা লাগানোর পর পরই চারার গোড়ায় জল সেচ দিতে হবে।
সারের পরিমাণ (Fertilizer)
গাছে যদি জিঙ্কের অভাব দেখা দেয় অর্থাৎ পাতা যদি তামাটে রঙ ধারণ করে তবে প্রতি বছর ৫০০ লিটার জলের সাথে ২ কেজি চুন ও ৪ কেজি জিঙ্ক সালফেট গুলে বসন্তকালে গাছে ছিটাতে হবে। ফল ঝরা কমাতে এটা সাহায্য করবে। ফল ফেটে যাওয়া কমাতে প্রতি ১০ লিটার জলে ১০ গ্রাম বোরিক পাউডার গুলে ফলে স্প্রে করা যেতে পারে।
গাছের যত্ন (Caring)
সময়মতো মাঝে মধ্যে মরা ডাল পরিষ্কার করা দরকার। সাধারণত লিচুতে অঙ্গছাঁটাই প্রয়োজন নেই তবে গাছের আকৃতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ছাঁটাই করা যেতে পারে। লিচুতে প্রশাখার অগ্রভাগসহ ফল সংগ্রহ করা হয়, এ পরোক্ষ ছাঁটাই গাছের জন্য উপকারী বলেই মনে হয়।
সেচ প্রয়োগ (Irrigation)
গাছের প্রধানত শীত ও গ্রীষ্মের দিনগুলোতে জলের প্রয়োজন হয় বেশি। চারা গাছের বৃদ্ধির জন্য ঘন ঘন সেচ দিতে হবে। যদি পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হয় তবে ফলন্ত গাছের বেলায় পূর্ণ ফুল ফোটা অবস্থায় একবার এবং ফল মটর দানার আকৃতি ধারণ পর্যায়ে আর একবার সেচ দিতে হবে। ফল আসার পর সেচ না দিলে ফল পড়ে যায় ও ফল ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। শীতকালে বিকেলের দিকে সেচ দিলে ঠাণ্ডায় গাছের ক্ষতি হয় না। গাছের গোড়ায় বেশি বা কম রস গাছের বৃদ্ধির পক্ষে ক্ষতিকর। তাই পরিমাণ মতো জল সেচের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
আরও পড়ুন: Pangash Fish Cultivation: পাঙ্গাশ মাছ চাষের উপযুক্ত খাদ্য
পোকামাকড় ও রোগ দমন (Pest and Disease Control)
লিচুর তেমন কোনো মারাত্মক রোগ দেখা য়ায় না। তবে আর্দ্র ও কুয়াশাযুক্ত আবহাওয়ায় পুষ্পমঞ্জুরি পাউডারি মিলডিউ ও অ্যানথ্রাকনোজ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। তা ছাড়া অনেক সময় ছত্রাকজনিত রোগের কারণে ফল পচে যায়। প্রতিকার হিসেবে বর্দো মিশ্রণ ও ডাইথেন এম-৪৫ ছিটানো যেতে পারে।
লিচুর মাইট বা মাকড়
মাকড়সা জাতীয় এ পোকা আকারে খুবই ছোট এবং এরা পাতায় আক্রমণ করে। আক্রান্ত পাতায় মখমলের মতো লালচে বাদামি দাগ সৃষ্টি হয়। ফলে গাছ বাড়ে না ও ফলন কম হয়। প্রতিকার হিসেবে আক্রান্ত ডালপালা বা ডগা ছাঁটাই এবং ধ্বংস করতে হবে। প্রতি ১০ লিটার জলে ২০ গ্রাম থিয়োভিট মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। তা ছাড়া মাইট যাতে গাছে উঠতে না পারে সে জন্য কাণ্ডের বা গোড়ার চারপাশে আলকাতরা লাগানো যেতে পারে।
লিচুর ফল ছিদ্রকারী পোকা
ফল পাকার সময় পোকা ফলের বোঁটার কাছে ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে এবং বীজকে আক্রমণ করে। ফল পাকার সময় বৃষ্টি হলে এ পোকা বেশি দেখা যায়। এরা ছিদ্রের মুখে বাদামি রঙের এক প্রকার করাতের গুঁড়ার মতো মিহি গুঁড়া উৎপন্ন করে। এতে ফল নষ্ট হয় ও ফলের বাজার মূল্য কমে যায়। ফলের গুটি ধরার পর ১৫ দিন পর পর দু’বার সিমবুশ ১ মিলি হারে প্রতি লিটার জলের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফল সংগ্রহ (Harvest)
ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে লিচু গাছে ফুল আসে ও মে-জুন মাসে লিচুর পাকা ফল সংগ্রহ করা হয়। এ সময় ফলের খোসা লালচে রঙ ধারণ করে ও কাঁটাগুলো চ্যাপটা হয়ে খোসা প্রায় মসৃণ হয়ে যায়। কিছু পাতাসহ গোছা ধরে লিচু সংগ্রহ করা হয়, এতে ফল বেশি দিন ধরে ঘরে রাখা যায়। বৃষ্টি হলে তার পর পরই কখনো লিচু সংগ্রহ করা ঠিক নয়।
আরও পড়ুন: Arabian jasmine Farming Process: বেল ফুল চাষ করে কি আদৌ প্রচুর লাভ সম্ভব? জেনে নিন