নারকেল ছোবড়া থেকে সার উৎপাদন
নারকেল ছোবড়া থেকে সার উৎপাদন কৃষিতে একটি আধুনিক প্রযুক্তি। নারকেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপজাত দ্রব্য তার বাইরের খোলস। অর্থাৎ প্রচলিত ভাষায় যাকে আমরা নারকেলের ছোবড়া বলে থাকি। এই ছোবড়া প্রক্রিয়া জাত করে প্রচুর বর্জ্য উৎপন্ন করা যায়, যা মূলত ছোবড়ার ধুলো বা ছোবড়ার ছাল রূপে পরিচিত।
নাইট্রোজেন ও কার্বনের অনুপাত, লিগনিন ও সেলুলোজের পরিমাণ কমাতে ছোবড়া বর্জ্যকে কমপোস্ট সারে পরিণত করা হয় এবং একে উদ্ভিদের পুষ্টির জন্য ব্যবহার করা হয়। কমপোস্টটি ওজনে তুলনামূলক হালকা হওয়ায় এর পরিবহনেও সুবিধা হয়।
ছোবড়া বর্জ্যকে সারে পরিণত করার পদ্ধতি -
ছোবড়া বর্জ্য তন্তু অপসারণ করে সংগ্রহ করা হয়। তন্তু থাকলে চালুনি দিয়ে তা চেলে নিতে হবে। না হলে সার তৈরির পর এগুলিকে আলাদা করতে হয়। এগুলি সারে পরিণত হয় না বরং এগুলি সার তৈরির প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে। তাই তন্তুহীন ছোবড়া বর্জ্যই সংগ্রহ করা বাঞ্ছনীয়।
সার তৈরির স্থান নির্বাচন -
সার তৈরির জন্য পৃথক স্থান নির্বাচন করা জরুরি। উঁচু এলাকা এবং গাছের ছায়াযুক্ত অঞ্চল সারের প্রস্তুতির পক্ষে আদর্শ। কারণ ছায়াযুক্ত অঞ্চলে সারের মধ্যেকার আর্দ্রতা সংরক্ষিত থাকে। সার তৈরির জমি যেন এবড়োখেবড়ো হলে তাকে ভাল করে দুরমুশ করে, সমান করে নিতে হবে। বৃষ্টি এবং সূর্যের তেজ থেকে রক্ষার জন্য সার তৈরীর জায়গায় ছাদ থাকলে ভালো হয়।
ছোবড়া বর্জ্য থেকে সার তৈরীর জন্য মাটিতে গর্ত করার বা সিমেন্টের আধারের প্রয়োজন নেই। একে মাটির ওপরেই রাখা যায়। প্রথমে একে ৩ ইঞ্চি পুরু এবং ৪ ফুট লম্বা করে রেখে ভাল করে ভেজাতে হবে, ভেজানোর পর নাইট্রোজেনজাত দ্রব্য (ইউরিয়া, এক টন ছোবড়ায় ৫ কিলো, বা পোল্ট্রির জঞ্জাল, প্রতি টন বর্জ্যে ২০০ কিলো) মেশানো হয়। এর পর প্লেউরোটাস এবং টিএনএইউ বায়োমিনারেলাইজার (২%) নাইট্রোজেনের উৎস হিসেবে মেশানো হয়। ভালো সার তৈরির জন্য উপযুক্ত জায়গা বাছাই করা অত্যন্ত জরুরি।
উপাদান ঝাড়াই করাঃ
প্রতি ১০ দিনে এক বার সারের ঝাড়াই করা দরকার, এতে স্তুপের মধ্যে জমে থাকা বাতাস বেরিয়ে যেতে পারে এবং তাজা হাওয়া ঢুকতে পারে। বাতাস চলাচলের আরও একটি পদ্ধতি হল সার তৈরির উপাদানগুলির মধ্যে উল্লম্ব ও অনুভূমিক ভাবে ছিদ্রযুক্ত পিভিসি বা লোহার পাইপ ঢুকিয়ে রাখা।
আর্দ্রতা রক্ষাঃ
বর্জ্য পদার্থকে সুষম ভাবে সারে পরিণত করতে সঠিক মাত্রায় আর্দ্রতা বজায় রাখা একান্ত প্রয়োজন। ৬০ শতাংশ আর্দ্রতা রক্ষা জরুরী । কিন্তু বাড়তি জল বর্জ্য পদার্থ থেকে বের করে দিলে চলবে না, উপাদানগুলিকে হাতে করে নিংড়ে নিতে হবে। যদি এতে একটুও জল না বেরিয়ে আসে, তা হলে বুঝতে হবে, উপযুক্ত আর্দ্রতা বজায় রয়েছে।
সার সংরক্ষণঃ
সার তৈরির পর চালুনিতে ঝাড়াই করে যে সার পাওয়া যায়, তা ব্যবহারের উপযুক্ত। যদি সার তখনই না ব্যবহার করা হয়, তা হলে আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য সেটাকে খোলা, ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে, যাতে সারে উপস্থিত উপকারী জীবাণুগুলো না মরে যায়। আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য মাসে এক বার সারের ওপর জল ছড়াতে হবে।
ছোবড়া সারের সুবিধাঃ
ছোবরার সার মাটির গুণ বাড়ায়। বেলে মাটি আঁটোসাঁটো হয় এবং কাদা মাটি আরও উর্বর হয়। এই সার মাটির সুষম ভাব বাড়ায়। এই সার মাটির জল ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায়(শুকনো মাটির ওজনের ৫ গুণেরও বেশি)।এর ফলে মাটির আর্দ্রতা বাড়ে। ছোবড়া সার প্রয়োগের ফলে নিচের স্তরের মাটির(১৫-৩০ সেমি)ঘনত্ব কমে। ছোবড়া সারে ফসলের সকল পুষ্টিবিধায়ক পদার্থ থাকে এবং এই সার অজৈব সারের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। ছোবড়া সারের প্রয়োগের ফলে মাটিতে উপস্থিত মাইক্রোফ্লোরা, অ্যামোনিয়া এবং নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ে।
ছোবড়া সারের ব্যবহারের প্রয়োগমাত্রা -
প্রতি হেক্টর জমিতে ৫ টন ছোবড়া সার ব্যবহার করা দরকার। বীজ রোপণের আগে মাটির তলায় ছোবড়া সার ব্যবহার করতে হবে। পলিথিনের ব্যাগে বা টবে গাছ লাগাতে হলে মাটির সঙ্গে ২০ শতাংশ ছোবড়া সার মিশিয়ে পলিথিন ব্যাগ বা টবে ভরা উচিত। নারকেল, আম, কলা বা অন্যান্য ফল গাছে সার দিতে হলে, অন্তত ৫ কিলো ছোবড়া সার দিতে হবে।
ব্যবহারের সীমাবদ্ধতাঃ
ছোবড়া সার কিনে বড় ক্ষেতে ব্যবহার করা খুব একটা লাভজনক নয়। ছোবড়া সার নিজের খামারে তৈরিই সুবিধাজনক। যদি অপরিণত সার ব্যবহার করা হয়, তা হলে মাটিতে প্রবেশের পরেও এটির পচন চলতে থাকবে, ফলে মাটির পুষ্টিবিধায়ক পদার্থ কমে যাবে। এতে ফসলের ক্ষতি হবে। তাই সার সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যাবার পরই তা ব্যবহার করতে হবে।
স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)
Share your comments