অনেকেই মাছ চাষে বেশ আগ্রহী হয়ে থাকেন | কিন্তু, আপনি কি জানেন মাছের মিশ্র পদ্ধতিতে চাষ কতটা লাভজনক? রুই, কাতলা, মৃগেল, রাজপুঁটি, নাইলোটিকা, সিলভার কার্প ইত্যাদি একসঙ্গে চাষ বেশ লাভজনক। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এগুলো চাষ করলে ঝুঁকি কম ও খরচ কম হয় । এজন্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছের মিশ্র চাষ করলে লাভের পরিমান বেশি হয় |
তবে জেনে নিন, মাছের মিশ্র চাষের পদ্ধতির বিবরণ,
পুকুর নির্বাচন (Pond selection):
মাছ চাষের সাফল্যতা পুকুর নির্বাচনের ওপরেই নির্ভর করে | মৌসুমী পুকুর বা সারা বছর জল থাকে এমন পুকুরে মাছ চাষ করা হয় | পুকুরের আয়তন ১-৩ বিঘা এর মধ্যে হলেই ভালো হয়। তবে এর চেয়ে বড় বা ছোট আকারের পুকুরেও মাছ চাষ করা যায়। পুকুরের গভীরতা ৩-৫ ফুট হওয়া দরকার | পুকুর নির্বাচনের সময় খেয়াল রাখতে হবে, যেন বছরে ৫-৬ মাস জল থাকে | পুকুরটি অবশ্যই আগাছামুক্ত ও খোলামেলা হতে হবে | পুকুর পাড়ে বড় ধরনের গাছপালা এবং গাছের পাতা যাতে জলে না পরে এ জাতীয় গাছ না থাকাই ভালো। পুকুরের উপর গাছের ছায়া পড়লে পুকুরে মাছের প্রাকৃতিক খাবার প্রচুর পরিমাণে জন্মাতে পারে না। গাছের পাতা জলে পরে পচে জলের স্বাভাবিক গুণাগুণ নষ্ট করে উৎপানদশীলতা কমিয়ে দেয়। সাধারণত দো-আঁশ ও কাদাযুক্ত দো-আঁশ মাটি পুকুরের জন্য উত্তম। মাছ চাষ ব্যবস্থাপনার জন্য পুকুরটি আয়তাকার হওয়া উচিত।
জলজ আগাছা পরিষ্কার:
পুকুরের অপ্রয়োজনীয় আগাছা মাছ চাষে বাধা সৃষ্টি করতে পারে | মাছের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করে ও মৎস্যভুক প্রাণীর শিকারের সুযোগ করে দেয়। সাধারণত, এই ধরণের আগাছা জল ও মাটির মৌল উপাদান বা পুষ্টি গ্রহণ করে মাটিকে অনুর্বর করে তোলে | এমনকি, জলে অক্সিজেনের স্বল্পতা ঘটায় |বিভিন্ন প্রকার সার এই জলজ আগাছা গ্রহণ করে নেয়। ফলশ্রুতিতে পুকুরে প্রয়োজনীয় পরিমাণ মাছের খাদ্য জন্মায় না। তাই পুকুরে শেওলাজাতীয় উদ্ভিদ, ভাসমান উদ্ভিদ, লতানো উদ্ভিদ ও নিমজ্জমান উদ্ভিদজাতীয় জলজ আগাছা জন্মাতে ও বৃদ্ধি ঘটতে দেয়া উচিত নয়। জলজ আগাছার মধ্যে সাধারণত কচুরিপানা, কলমিলতা, হেলেঞ্চা, ঝাউ ইত্যাদি লক্ষ করা যায়; যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সূর্যের আলো পুকুরের জলে খাদ্য তৈরিতে সহায়ক এবং আগাছা পুকুরের জলে সূর্যকিরণ প্রবেশ করতে দেয়না। সুতরাং সকল প্রকারের জলজ আগাছা শিকড়সমেত উপরে ফেলতে হবে।
ভক্ষণকারী মাছ ও ক্ষতিকর প্রাণীর অপসারণ:
পুকুর শোকানোর সময়, রাক্ষুসে মাছ ও চাষের অপ্ৰয়োজনীয় মাছ পুরোপুরি ছাঁটাই করতে হবে | ভক্ষণকারী মাছ যেমন শোল, বোয়াল, গজার, চিতল এবং চাষের অপ্রয়োজনীয় মাছ যেমন পুঁটি, চাঁদা প্রভৃতি সরিয়ে ফেলতে হবে | মাছের জন্য ক্ষতিকর অন্যান্য প্রাণী যেমন- সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া ইত্যাদি মেরে ফেলার ব্যবস্থা নিতে হবে। জল নিষ্কাশনের পর পুকুরের তলার মাটি ন্যূনতম সাতদিন ধরে রৌদ্রে শুকাতে হবে। এর পরেও যদি অতিরিক্ত কাদা থাকে তাহলে কিছু কাদা তুলে ফেলার ব্যবস্থা করতে হবে। এরপর মাটি শুকানোর পর পুকুরের তলায় চাষ দেওয়ার অন্তত ২/৩ দিন পর প্রয়োজনীয় পরিমাণ জল সরবরাহ করতে হবে বা বৃষ্টির জলের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
পুকুরে পোনা ছাড়ার প্রক্রিয়া ও সময় (Fry production):
সঠিক মাত্রায় উন্নতমানের পোনা মজুদের ওপর মাছ চাষে সফলতা আসে | একক চাষের ক্ষেত্রে ৩-৫ ইঞ্চি আকারের (৫-১০ গ্রাম ওজনের) পোনা নির্বাচন করাই উত্তম। ছোট আকারের পোনা মজুদে পোনা মৃত্যুর হার বেশি হবে এবং লাভের সম্ভাবনা কম থাকে। সার প্রয়োগের ৮-১০ দিন পর প্রাকৃতিক খাদ্য পরিমিত পরিমাণে পুকুরের পানিতে বিদ্যমান থাকলে প্রতি শতাংশ পুকুরে মোট ৩০-৩৫টি চারা পোনা মজুদ করা যাবে। এর মধ্যে রুই ১০-১৫টি, কাতলা ৮-১০টি, মৃগেল ৮-১০টি, রাজপুটি ৫-৬টি, নাইলোটিকা ৫-৬টি পোনা প্রতি শতাংশে ছাড়তে হবে। পোনা মাছ সকালে বা বিকেলে পাড়ের কাছাকাছি ঠাণ্ডা পরিবেশে ছাড়াই উত্তম। অতি বৃষ্টিতে বা কড়া রোদের সময় পোনা ছাড়া উচিত নয়। নিকটবর্তী স্থানের জন্য পোনা পরিবহনের ক্ষেত্রে মাটির হাঁড়ি বা অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে পোনা পরিবহন করা যেতে পারে। তবে দূরবর্তী স্থানের জন্য অক্সিজেন ভর্তি পলিথিন ব্যাগে পোনা পরিবহন করা অধিকতর নিরাপদ। পুকুরে পোনা ছাড়ার সময় পোনা ভর্তি ব্যাগ বা পাত্রের অর্ধাংশ পুকুরের জলে ১০-১৫ মিনিট ডুবিয়ে রাখতে হবে। এরপর ব্যাগ বা পাত্রের মুখ খুলে দিতে হবে। অতঃপর পাত্র বা ব্যাগের কিছু জল বের করে এবং পুকুরের জল ভেতরে ঢুকিয়ে উভয় জলের তাপমাত্রা সমতায় আনতে হবে। যখন পাত্রের ভেতরের এবং পুকুরের জলের তাপমাত্রা সমান হয়ে যাবে তখন ব্যাগ বা পাত্রটিকে কাত করলে পোনাগুলো আপনা আপনি পুকুরে চলে যাবে।
পোনা ছাড়ার পর সার প্রয়োগ (Fertilizer):
পোনা মাছের সংখ্যার ওপর নির্ভর করে নিয়মিতভাবে সার প্রয়োগ করতে হবে | জৈবসার যেমন- গোবর প্রতি ১৫ দিন অন্তর ১ কেজি অথবা হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ৫০০ গ্রাম হারে পুকুরে ছিটিয়ে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ছাড়া প্রতি শতাংশে ইউরিয়া ৪০ গ্রাম ও টিএসপি ২০ গ্রাম হারে একটি পাত্রে ৩০ গুণ জলের সাথে মিশিয়ে অন্তত ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে রোদের সময় গোলানো সার পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। উল্লেখ্য, পুকুরের জল যদি অধিক সবুজ রঙ ধারণ করে তাহলে সার প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হবে। মেঘলা ও বৃষ্টির দিনে সার প্রয়োগ করা যাবে না।
আরও পড়ুন - মুরগির চেয়েও বেশি লাভজনক! ক্যাম্পবেল হাঁস পালনের পদ্ধতি
মাছের সম্পূরক খাদ্য তৈরির নিয়ম (Fish food) -
পুকুরের ছোট ছোট জলজ কণা মাছের প্রাকৃতিক খাদ্য হিসাবে ব্যবহার হয় | কিন্তু, প্রাকৃতিক খাদ্যের অভাব হলে তৎক্ষণাৎ সম্পূরক খাদ্যের ব্যবস্থা করতে হবে | ফিশমিল ১০%, চালের গুঁড়ো ৫৩%, সর্ষের খোল ৩০.৫০%, ভিটামিন ও খনিজ মিশ্রণ ০.৫% ও চিটাগুড় ৬% মেপে নিতে হবে । এগুলো গুঁড়ো করে মিশ্রণ বানাতে হবে । এরপর জল দিয়ে ম- তৈরি করে পিলেট মেশিনে দিয়ে ছোট ছোট বড়ি তৈরি করতে হবে। এগুলো শুকিয়ে মাছকে খেতে দিতে হবে । এই খাদ্যে মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ করলে, ফলন যেমন ভালো হবে তেমনি বাজারজাত করে লাভ ঘরে আসবে |
নিবন্ধ: রায়না ঘোষ
আরও পড়ুন - Aquaponics Farming: বাড়ির ছাদে মাছ চাষ করার সহজ উপায়, অ্যাকোয়াপনিক্স পদ্ধতি