মৎস্য ও মৎস্যজাত কয়েকটি পরিকল্পনা বা প্রকল্পের মাধ্যমে মহিলারা স্বাবলম্বী হতে পারে। যেমন, খিড়কি পুকুরে কম সময়ে অধিক উৎপাদন ভিত্তিক মাছের চাষ, ব্যবসায়িক ভিত্তিতে স্বল্পব্যয় মাছের খাবার তৈরি করে, রঙিন মাছের প্রজনন ও পালনের মাধ্যমে, অ্যাকোয়ারিয়াম তৈরী ও সারানো শিখে, মাছ ও চিংড়ি থেকে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য প্রস্তুত, মাছের কৃত্তিম প্রজনন হ্যাচারি ম্যানেজমেন্ট -এর মাধ্যমে ও মাছের আঁশ থেকে বিভিন্ন অলংকার, ঘর সাজানোর জিনিস তৈরি করে মহিলারা আর্থিক ভাবে সচ্ছল হতে পারেন।
একজন মহিলা কিভাবে মাছ চাষ করতে পারেন ?
মহিলারা জলাশয়ে অথবা সিমেন্টের চৌবাচ্চা করে মাছ চাষ করতে পারেন। বিশেষ করে খিড়কি পুকুর যেগুলি, বাড়ির পিছন দিকের পুকুর, সাধারণত যেখানে মেয়েরা বাসন মাজে ও কাপড় কাচে, সেই সব পুকুরে সঠিক ভাবে চাষ করলে অতিসহজে লাভবান হওয়া যায় । তাছাড়া মাছ চাষ করে মহিলা চাষির দৃষ্টান্ত তো আছেই, তাই মনের জোর নিয়ে এগিয়ে এলে মহিলারাও মাছ চাষ করতে পারবেন। জিওল জাতীয় মাছ ( মাগুর, শিঙি, কই ইত্যাদি ) প্রাথমিক ভাবে চাষ করাই ভালো। এছাড়া কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষ করে অল্প সময়ে অধিক আয় করা সম্ভব।
নারী মাছ চাষ করে দৃষ্টান্ত করেছে এমন উদাহরণ ?
মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন নারী উদ্যোক্তা আরতী বর্মন। ছোট পরিসরে শুরু করলেও বর্তমানে তিনি তিনশো ডেসিম্যাল জলাশয়ে বিভিন্ন জাতের মাছ চাষ করে পরিবারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। রাজ্য ও জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন হলদিয়ার এই মহিলা মাছ চাষি ।
গৃহস্থের পুকুর সদ্ব্যবহারে মহিলাদের ভূমিকা কি?
পারিবারিক পর্যায়ে মহিলাদের সচেতন করে পুষ্টির জন্য মাছের গুরুত্ব বোঝানো অনেক সহজ। বাড়ির মহিলারা সচেতন হলে বিশেষ করে গৃহস্থের পুকুর গুলো সদ্ব্যবহার হয়। দেখা গেছে বাড়ির পুরুষদের সাথে মহিলারা বিষয়টি অবগত থাকলে মৎস্য প্রকল্প রূপায়ন সহজ হয়। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের মাধ্যমে দলগত ভাবেও চাষ করা যায়।
একজন মহিলা তার বাড়ির ছোট্ট পুকুরে মাছ ছাড়লে কি ভাবে পরিচর্যা নিতে পারেন?
প্রথমত, প্রতি ডেসিম্যাল পুকুরে ৪-৬ইঞ্চি সাইজের কার্প জাতীয় মাছ ৪০টি ছাড়ুন। প্রতি সপ্তাহে ১ কেজি তিন দিনের পচানো গোবর জল করে পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে। মাসে এক বার ৩০০ গ্রাম চুন ও ১০০ গ্রাম লবণ ছড়াতে হবে। আর পনেরো দিন অন্তর জৈব-জুস প্রয়োগ করতে হবে। অন্তত এই কাজ গুলো ঠিক ঠাক করলে মাছের ভালো ফলন পাওয়া যাবে।
মহিলারা কি জৈব জুস বানাতে পারবেন?
হ্যাঁ খুব সহজেই বানানো যায়। হাজার বর্গ মিটার একটি জলাশয়ে (পঁচিশ ডেসিম্যাল) আড়াই কেজি বাদাম খোল, তিন কেজি চালের গুঁড়ো, পাঁচশো গ্রাম ঈষ্ট পাউডার, তিন কেজি চিটে গুড়, দেড় কেজি আটা, তিনশো গ্রাম কলার সাথে যেকোনো পোনা মাছের খাবার দুই কেজি মিশিয়ে ৪৮-৬০ ঘন্টা একটি ঢাকনা যুক্ত পাত্রে প্রায় তিন গুন জলের সাথে রেখে পচিয়ে নিতে হবে। এতে উপাদান গুলি গেঁজিয়ে যায়। এটিকে ছেঁকে নিয়ে পুকুরের জলে ছিটিয়ে দিতে হবে এবং পরে বাকি শক্ত পদার্থটি পুকুরে ছড়াতে হবে।
স্বল্প ব্যয় মাছের খাবার কিভাবে মহিলারা তৈরী করতে পারবেন?
মহিলারা সহজেই বাড়িতে মাছের খাদ্য তৈরী করতে পারেন। খাদ্য তৈরির উপকরণ হিসেবে সরিষার খোল, চালের কুড়া, ধান/গমের ভুষি, মাছের শুটকির গুঁড়া ও খনিজ লবণ ব্যবহার করতে পারেন। বাইন্ডার হিসেবে আটা বা মোলাসেস/চিটাগুড় ব্যবহার করা যায়।
পরিমাণ মত উপকরণ জলে ভিজিয়ে রেখে বল আকারের খাদ্য তৈরি করে পুকুরে প্রয়োগ করা যায়।এছাড়া বাড়িতে গুণগতমানসম্পন্ন পিলেট খাদ্য তৈরি করা যায়। নিজ হাতেই খাদ্য প্রস্তুত করতে পারেন, অথবা খাদ্য প্রস্তুতকারী মেশিন এর সাহায্যে বিভিন্ন উপকরণ পরিমাণমত মিশিয়ে চাহিদা অনুযায়ী দানাদার সম্পূরক খাদ্য প্রস্ত্তত করতে পারেন। তাই, খাদ্যে উপকরণসমূহ বাজার থেকে কিনে নিজস্ব পিলেট মেশিন দ্বারা খাদ্য তৈরি করা সবচেয়ে নিরাপদ। এ ক্ষেত্রে শিঙি ও মাগুর মাছের জন্য খাদ্যের বিভিন্ন উপকরণ মিশিয়ে স্বল্প মূল্যে কিন্তু ভালমানের খাদ্য প্রস্ত্তত করা যেতে পারে।
১০০ কেজি মাছের খাবার তৈরি করতে মাছের গুঁড়ো (ফিশমিল) ২০ কেজি , সোয়বিন চূর্ণ ৮ কেজি, চালের গুঁড়ো ৩০ কেজি, ভুট্টাচূর্ণ ৫ কেজি, গমের ভুসি ১২ কেজি, চিটাগুড় ৫ কেজি, সরিষার খৈল ২০ কেজি ও ভিটামিন প্রিমিক্স ১ গ্রাম/কেজি মিশিয়ে তৈরি করতে হবে।
রঙিন মাছ কি? মহিলারা কিভাবে রঙিন মাছের চাষ করতে পারেন ?
যে সমস্ত মাছকে আমরা আমাদের বাড়ি, বাগানবাড়ি, অফিস-কাছারি, চিড়িয়াখানা, দর্শনীয় স্থান অলঙ্কৃত করার জন্য খুব ছোট জলাশয় বা কাচে ঘেরা ছোট জলাশয়ে রাখি তাদেরই রঙিন মাছ বা শৌখিন মাছ বলা হয়। যে কোন মাছকেই আমরা শৌখিন মাছ বলতে পারি যদি তাকে দর্শনীয় জায়গায় অলঙ্কৃত করে সাজিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। রঙিন মাছ গুলি দুই ধরনের আছে । কিছু প্রজাতি আছে যারা সরাসরি বাচ্চা দেয়, যেমন- গাপ্পি, প্লটি, মলি, সোর্ডটেল প্রভৃতি। আবার কিছু প্রজাতীর ডিম থেকে বাচ্চা বের হয় যেমন- বার্ব, গোরামি, গোল্ড ফিশ ইত্যাদি । সরাসরি বাচ্চা দেওয়া প্রজাতীর বাজারমূল্য কম ( ২ -৬ টাকা প্রতিটি) কিন্তু যে প্রজাতীর ডিম থেকে বাচ্চা বের হয় তাদের বাজারমূল্য ভালোই। সেক্ষেত্রে গোল্ড ফিশ চাষ করলে ভালো। কারন এর বাজার মূল্য ভালো , বাচ্চাও সারা বছর পাওয়া যায়, চাষ করা সহজ ও চাহিদাও সারা বছর আছে। বাড়ির বারান্দায় চৌবাচ্চা তৈরি করে অতি সহজেই মহিলারা এই রঙিন মাছের চাষ করতে পারেন। ২-৬ ডেসিম্যাল পুকুরেও চাষ করা যায়। প্রাথমিক ভাবে যদি অপেক্ষাকৃত উচ্চ সহনশীল মাছ ( যারা সহজে মরে যায়না) চাষ করেন তবে এই চাষে আত্মবিশ্বাস আসবে।
চৌবাচ্চায় রঙিন মাছ করার লাভ খরচ হিসাব কেমন?
৮ ফুট, ৬ ফুট, ২.৫ ফুট আয়তনের একটি সিমেন্টের চৌবাচ্চা তৈরি করতে হবে। চৌবাচ্চা পরিস্কার করার জন্য প্লাস্টিকের ব্রাস লাগবে। আংশিক জল বের করার জন্য ১ইঞ্চি সাইজের টুলু পাম্পের পাইপ লাগবে। বিদ্যুৎ না থাকলে এয়ারেটার মেশিন চালানোর দরকার নেই। উপরোক্ত সাইজের চৌবাচ্চায় ১ ইঞ্চি সাইজের গোল্ডফিশের বাচ্চা ৪০০-৫০০ টা ছাড়া যায় । আর ডিমপোনা সাইজের হলে ৯০০-১০০০টি ছাড়া যাবে।
ধরি ৫০০ মাছের ৯৫% বাঁচবে এবং প্রতি মাছের খরচ ৩ টাকা । তাহলে খরচ হবে ১৫০০ টাকা । চৌবাচ্চা তৈরির খরচ ২৫০০টাকা । বিক্রি করার সময় মাছ পাওয়া যাবে ৪৭৫টি এবং এর বিক্রি দাম ( ৪৭৫ X ১০ টাকা ) ৪৭৫০ টাকা । মোট লাভ ২২৫০ টাকা । আর এটিতো একটি চৌবাচ্চার হিসেব, একসাথে অনেকগুলি হলে এককালীন বেশি লাভ করা যায়।
অ্যাকুয়ারিয়াম এর মাধ্যমে মহিলারা কিভাবে স্বনির্ভর হতে পারে?
কাঁচের অ্যাকুয়ারিয়াম তৈরি করে বিক্রি করে স্বনির্ভর হওয়া যায়। অতি সহজেই অ্যাকুয়ারিয়াম তৈরি করা যায়। অনেক সময় মার্কেট না পাওয়ার আশঙ্কা অনেকে করতে পারেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলব যে যদি মহিলা স্বনর্ভর গোষ্টির সদস্য হন তবে একটি লিফলেট ছাপিয়ে স্থানীয় স্কুল, কলেজ, অফিসে ছড়িয়ে দেন । এবং প্রয়োজন মতো অ্যাকুয়ারিয়াম তৈরীর বরাত নিয়ে এই কাজ কত্রা যায়। তাছাড়া মাসে মাসে একুয়ারিয়াম পরিস্কার বা পরিচর্যার কাজ করেও উপার্জন করা যেতে পারে।
অ্যাকুয়ারিয়াম তৈরি করতে কি কি জিনিসের প্রয়োজন?
অ্যাকোয়ারিয়াম তৈরির জন্য যে সব বস্তুর দরকার সেগুলি হল —গ্লাস নির্মিত ঢাকা বাক্স, বৈদ্যুতিক আলো ও তার সামগ্রী, বাতাস প্রবেশ করার যন্ত্র (এয়ার পাম্প), ছোট ছোট নুড়ি পাথর, খাবার পাত্র (ফিডিং কাপ), স্বয়ংক্রিয় তাপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (থারমোস্ট্যাট হিটার), নানা রকম দৃষ্টি নন্দন খেলনা, পিছনে লাগানো সুন্দর সুদৃশ্য, ছবি (সিনারি), পরিষ্কার করার জন্য ব্যবস্থা, মগ, বালতি, জল পরিবর্তনের জন্য পাইপ, বাতাস প্রবেশের জন্য পাইপ, সংযোজক জল, খোলা বন্ধের চাবি, মিথিলিন ব্লু, পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট জাতীয় রাসায়নিক দ্রব্য।
অ্যাকুয়ারিয়াম পরিচর্যা করা মানে ?
অ্যাকোয়ারিয়ামের পরিচর্যা মানে এর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মেরামতি, জল পাল্টানো ও তার সংশোধন এবং মাছেদের খাবার, স্বাস্থ্য, চিকিত্সা রোগ প্রতিরোধ ইত্যাদি।
মাছ ও চিংড়ির প্রক্রিয়াকৃত খাবার তৈরি করে মহিলারা কিভাবে স্বনির্ভর হতে পারেন?
মাছ ও চিংড়ি থেকে বিভিন্ন খাবার প্রস্তুত করা যায়। এগুলো নির্ধারিত দোকানে বা মেলায় অনুষ্ঠানে বিক্রি করে উপার্জন করা যায়। এরকম ভাবে চিংড়ির আচার, মাছের আচার, কাটলেট, মাছের বল প্রভৃতি তৈরি করা যায়। তাছাড়া মাছের আঁশ থেকে বিভিন্ন অলংকার ঘর সাজানোর জিনিস তৈরি করে মহিলারা আর্থিক ভাবে সচ্ছল হতে পারেন।
এই সমস্ত বিষয়ে মহিলারা প্রশিক্ষন কোথায় কিভাবে পেতে পারেন?
এই সব বিষয়ে জানার জন্য ব্লকে বা জেলায় মৎস্য দপ্তরের আধিকারিকদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
সুমন কুমার সাহু (মৎস্যচাষ সম্প্রসারণ আধিকারিক, হলদিয়া)
Related link - https://bengali.krishijagran.com/animal-husbandry/the-role-of-lime-in-fish-farming/