আমাদের দেশ বিভিন্ন চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত। খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে পশু পালন, মৎস্য চাষ,মৌমাছি পালন। এই প্রত্যেক কৃষির ধরন-কৌশল আলাদা আলাদা হলেও, এই চাষবাসগুলির সঙ্গে যুক্ত মানুষরা দেশের মানুষকে জোগাচ্ছেন খাদ্য। নিজেরা কতটুকু লাভবান হচ্ছেন সেদিকে খেয়াল না রেখেই এই মানুষগুলি দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমাদের উপহার দিচ্ছেন এক সুস্থ-অভাবহীন সমাজ। আমাদের পরিধানের জন্যও যে বস্ত্রের আমদানি ঘটছে, তারও মূল কারিগর এই কৃষক সমাজ। রেশম চাষিদের তত্ত্বাবধানে উৎপাদিত রেশম, আমাদের বস্ত্র সংকট থেকেও রক্ষা করে চলেছে। চীনের পরেই রেশম উৎপাদনে ভারত দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, যা স্বাভাবিক ভাবেই প্রমাণ করে ভারতের রেশম চাষিদের রেশম চাষে অতুলনীয় অবদানের বিষয়ে। ভারতে মোট চার ধরনের রেশম চাষ করা হয়। তুঁত, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় তসর, এরি এবং মুগা। গর্বের সঙ্গে বলা চলে ভারতবর্ষই হল এমন এক দেশ যেখানে এতগুলি অর্থাৎ মোট চার রকমের বাণিজ্যিক রেশম উৎপন্ন হয়।
রেশম চাষের শুরু (Resham Farming)
মূলত বিহার, বাংলায় সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে বহু কাল আগে থেকে শুরু হয়ে রেশম চাষ। প্রাচীনকালের রেশম চাষ প্রযুক্তি বর্তমানে কৌশলগত ভাবে বদলে গেলেও এই অঞ্চলগুলির আদিম জনজাতিরা এখনও নিজস্ব উপায় এবং আধুনিক নিয়মের সংমিশ্রনে রেশমের চাষ করে আসছেন। সোনালী রঙের ঔজ্জ্বল্যের জন্য মুগা রেশমের চাহিদাই সবথেকে বেশি।
উৎপাদন (Productivity)
কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু ও জম্মু ও কাশ্মীর-এই পাঁচ রাজ্যে দেশের মধ্যে সবথেকে বেশি রেশম উৎপন্ন হয়। ২০১৩-১৪ অর্থ বর্ষে আমাদের দেশে কাঁচা রেশম মোট উৎপাদন ছিল ২৬৪৮০ মেট্রিক টন, এর মধ্যে ১৯৪৭৬ মেট্রিক টন তুঁত সিল্ক, ২৬১৯ মেট্রিক টন তসর সিল্ক, ৪২৩৭ মেট্রিক টন এরি সিল্ক এবং ১৪৮ মেট্রিক টন মুগা সিল্ক।
রেশম মথের খাদ্যনালীর উভয় পাশে একজোড়া রেশমগ্রন্থি থাকে, যেগুলিকে পরিবর্তিত লালাগ্রন্থিও বলা হয়। রেশমগ্রন্থি দুটি যখন ধীরে ধীরে পূর্ণতা লাভ করে তখন স্পিনারেট দিয়ে তরল রেশম নির্গত হয় ও সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর সংস্পর্শে আসামাত্র শুকিয়ে রেশম বা সিল্ক সুতোয় পরিণত হয়। রাসায়নিক দিক থেকে এই সুতো প্রোটিন তন্তু, যাতে দুই রকম প্রোটিন মিশ্রিত থাকে- কেন্দ্রীয় অংশটি ফাইব্রয়েন ও তাকে ঘিরে থাকে সেরিসিন – এই দুই প্রোটিনের মিশ্রণই রেশমের ঔজ্জ্বলতার মূল কারণ।
রেশমের অন্যতম ভাগ হল তসর। ভারতে যতটা তসর গোটা বছর উৎপন্ন হয়, তার অধিকাংশটা আসে ঝাড়খন্ড রাজ্য থেকে। তসরের পোকা শাল ও অর্জুন পাতা খেয়ে তসর মথ-এ পরিণত হয়। তসর মথের পূর্ব দশার নাম কোকুন দশা বা গুটি দশা। এই গুটি দশার থেকেই সুতো উৎপন্ন হয়। তসরের চাষ বছরে তিনবার করা সম্ভব।
তুঁত তৈরী হয় বমবিক্স বর্ণের রেশম পোকার গুটি থেকে। এই পোকা মালবেরি বা তুঁত গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। এরি রেশম তৈরী হয় ফিলোসেমিয়া বর্ণের রেশম গুটি থেকে, যারা রেড়ী গাছের পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে, মুগ রেশম মূলত সোম ও শোয়ালু গাছের পাতা খায়। সর্বশেষ হল তসর, যাদের খাদ্য অর্জুন গাছের পাতা।
আরও পড়ুন:Balsam Farming Complete Guideline: দোপাটি ফুলের চাষ করে হয়ে উঠুন আদর্শ ফুল চাষি
রেশম উৎপাদন প্রক্রিয়া (Process of making Silk)
সরকারী বীজাগার থেকে রেশম বীজ সংগ্রহ করা উচিত। ডিম ফোটানো থেকে শুরু করে পাঁচটি পর্যায়ে লার্ভা অবস্থা অতিক্রম করার পর রেশম পোকা আসে। গুটিবদ্ধ অবস্থায় রেশম পিউপা বা কীটগুলিকে গরম জলে সেদ্ধ করে নিয়ে সুতো ছাড়ানো হয় এবং পরে তা গোটানো হয়। এগুলিকে র-সিল্ক বলা হয়। রিলিং করার সময়ে কিছু সুতো পরিত্যক্ত হয়, যাকে চশম বলে। মথ যদি গুটি থেকে কোনভাবে বেরিয়ে যায়, তবে রিল্ড সিল্ক পাওয়া যায় না। কাটা গুটিগুলিকে লাটকোয়া বলে, লাটকোয়া কাটাই করে যে সুতো পাওয়া যায়, তাকে মটকা বলে। চশমকে পাকিয়ে যে রেশম উৎপন্ন হয় তাকে স্পান সিল্ক বলা হয়। ২৫০০০ গুটির দরকার পড়ে এক কেজি র-সিল্ক উৎপাদনে।
রেশম চাষ করতে গেলে খাদ্য গাছের চাষ এবং রোমকীট পালন করার প্রয়োজন পড়ে। এই রেশমকীট থেকেই পরবর্তীতে রেশমগুটি ও সিল্ক মেলে। ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত রেশম শিল্প। ভারতে এই বিশেষ চাষশিল্পের সঙ্গে অর্ধ-লক্ষাধিক মানুষ জড়িয়ে রয়েছেন। রেশম চাষের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলারা। যা ভারতের নারী উন্নয়নের এক অন্যতম প্রধান ধাপ হিসাবে বিবেচিত।