এই 20টি ব্যবস্থা পোল্ট্রি খামারকে বার্ড ফ্লু থেকে নিরাপদ রাখবে! ভার্মি কম্পোস্ট ইউনিটের জন্য ৫০% পর্যন্ত ভর্তুকি পাওয়া যাবে, শীঘ্রই আবেদন করুন এই হাইব্রিড জাতের টমেটো 900 কুইন্টাল প্রতি হেক্টর ফলন দেবে দুধের সঠিক সময় বেছে নিলে উৎপাদন বাড়বে, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
Updated on: 3 April, 2024 6:23 PM IST

তুলনামূলক ভাবে দেখা গেছে যে অন্যান্য যে কোন চাষের তুলনায় মাছ চাষ অধিক লাভজনক এবং এটা প্রমানিত। মাছ যে জলজ পরিবেশে থাকে, সেই জলজ পরিবেশে নানা কারনে বিভিন্ন রকমের পরিবর্তন হতে পারে এবং যার জন্য মাছের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর ও প্রতিকূল পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এমন পরিবেশে থাকলে মাছের দেহে বিভিন্ন রকম অস্বাভাবিক অবস্থা দেখা যায় এবং মাছ তার জীবনযাত্রায় বিভিন্ন রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়। এর ফলে মাছের শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় ও মাছ সহজেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।রোগ বলতে কোনো জীবের দেহ ও মনের অস্বাভাবিক অবস্থা কে বোঝায়, যা বিভিন্ন রকমের চিহ্ন, লক্ষণ ও ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।

আমাদের দেশে জনসংখ্যা যেমন পর পর বাড়ছে, তেমনি মাছের চাহিদাও বাড়ছে। আর সেই চাহিদা পূরন করার জন্য মাছ চাষের প্রবনতাও বাড়ছে, এটা ভালো দিক কিন্তু এই মাছ চাষে যে রোগ সংক্রমণ হয়, তা সঠিক ভাবে নির্ধারণ করে তার প্রতিকার না করতে পারলে, মাছ চাষিরা অনেক সমস্যার মধ্যে পড়বেন।

বর্তমান মাছ চাষে মাছের উকুন বা আরগুলাস মাছ চাষি ভাইদের কাছে একটি মাথাব্যথার কারন। এই পরজীবীর আক্রমনের ফলে মাছের বৃদ্ধি ঠিক মতো হচ্ছে না, আবার কোনো কোনো সময় মাছের মৃত্যুও হচ্ছে যার জন্য মাছ চাষি ভাইরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন। এর হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁরা বিভিন্ন কোম্পানি নিযুক্ত টেকনিশিয়ানের সাহায্য নিচ্ছেন এবং এই কোম্পানি নিযুক্ত টেকনিশিয়ানরা তাঁদের কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদিত বিভিন্ন রকমের রাসায়ানিক জাতীয় দ্রব্য যেমন গ্যামাক্সিন, সাইপারমেথ্রিডিন ও আরও অন্যান্য রাসায়ানিক ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন ও চাষিদের ব্যবহারের জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন। আমাদের এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে গ্যামাক্সিন, সাইপারমেথ্রিডিন এগুলি হল নিষিদ্ধ রাসায়ানিক এবং এই রাসায়ানিক গুলিকে আমরা সরাসরি মাছ চাষের জলজ পরিবেশে প্রয়োগ করতে পারি না বা প্রয়োগ করা কখনই উচিৎ নয়, আর যদি আমরা এগুলি প্রয়োগ করি তাহলে জলজ বাস্তুতন্ত্রে এক ভয়ানক প্রভাব পড়বে যার ফলে পুরো জলজ বাস্তুতন্ত্রটাই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। কিন্তু চাষিরা নিরুপায় হয়ে এই সমস্ত ক্ষতিকর রাসায়ানিক গুলো ব্যবহার করছেন এবং এতে তাঁরা সাময়িক ফলও পাচ্ছেন। কিন্তু আমরা কখনই এই রাসায়ানিক ব্যবহারের পক্ষপাতী নই।

যখন কোন রোগ জীবাণু বা পরজীবী তার অনুলুল পরিবেশে মাছের দেহে প্রবেশ করে বা শরীরের বাইরে বাসা বাঁধে, তখন মাছের সংক্রমণ নীচের যে কোনো একটি অবস্থার মতো হতে পারে -

১. মাছের যে দৈহিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে তা রোগ সংক্রমনকে বাধা দেয় এবং রোগ জীবানু কে ধ্বংস করে দেয়, ফলে মাছ সুস্থ্য থাকে।

২. মাছের যে দৈহিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আছে তা রোগ সংক্রামনকে বাধা দেয় কিন্তু রোগ জীবানু কে ধ্বংস করতে পারে না, ফলে মাছ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।

৩. রোগ জীবাণু বা পরজীবী মাছের দেহে প্রবেশ করে ও প্রতিরোধ ব্যাবস্থা ভেঙ্গে ফেলে, ফলে মাছ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।

রোগের নাম: মাছের উকুন (আরগুলাস) ও নোঙর যুক্ত পোকা (লারনিয়া)। এরা সন্ধিপদী পরজীবী।

আক্রান্ত মাছের নামঃ রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প ইত্যাদি। সাধারনত মিষ্টি জলের মাছেদের এই রোগে আক্রান্ত হবার প্রবনতা বেশী।

আরও পড়ুনঃ হাঁস পালনের আগে জানতে হবে হাঁসের এই মারাত্মক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে

এ জাতীয় পরজীবী মাছের পোনা, অঙ্গুলি পোনা ও বড় মাছ সব ধরনের মাছেরই ক্ষতি করে। নার্সারি পুকুর, লালন পুকুর ও মজুত পুকুরে এই জাতীয় পরজীবীর আক্রমন ঘটে। খোলোসজাতীয় সন্ধিপদ পরজীবীর মধ্যে দুটি পরজীবী মাছের উকুন রোগের জন্য দায়ী। সেগুলি হল-

অ) লারনিয়াসিস (Lernaesis) এবং আ) আরগুলোসিস (Argulosis)

লারনিয়াসিস (Lernaesis) : এই রোগ আংটা কৃমি নামেও পরিচিত। লারনিয়া গনের কয়েকটি প্রজাতি এই রোগ সৃষ্টি করে, যেমন- লারনিয়া পলিমরফা (Lernaeapolimorpha), লারনিয়া সিপ্রিনাসিয়া (LerneaCyprinacea), লারনিয়া টিনোফারিংগোডন্টিস(LernaeaCtenopharyngodontis),

আরগুলোসিস (Argulosis):আরগুনাস গনের কয়েকটি প্রজাতি এই রোগ সৃষ্টি করে। যেমন- আরগুলাস ফলি এসিয়াস(Argulusfolieaceus), আরগুলাস করিগনি (Arguluscoregoni) ।

আরও পড়ুনঃ ছাগল পালনের জন্য ঋণ কোথায় নেবেন? অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানুন

কেন হয় এই রোগ?

পুকুরের পরিবেশ খারাপ হলে ও পুকুরে পচা কাদা বেশি থাকলে এই পরজীবীর আক্রমন ও সংক্রমণ বেশী ঘটে।

এই রোগের লক্ষনঃ

১. এই রোগের সংক্রমণ হলে মাছ ছোটাছুটি করতে শুরু করে দেয়।

২. মাছের আক্রান্ত স্থানে ফুলে যায়।

৩. মাছের খাদ্য গ্রহনের হার কমে যায় ও মাছ রোগা হয়।

৪. আক্রান্ত স্থান লাল হয়ে যায় ও ঘা হয়।

৫. মাছ এই পরজীবীর হাত থেকে বাঁচার জন্য কোন শক্ত জায়গায় গা ঘসতে থাকে

৬. মাছের গায়ে পরজীবী আটকে থাকে, যা চ্যাপ্টা পোকার মতো দেখতে, মাছের শরীর থেকে রক্ত শোষণ করে।

প্রতিকারের উপায়ঃ

১. প্রথমের দিকে প্রতি লিটার জলে ৩০ গ্রাম লবন মিশিয়ে আক্রান্ত মাছকে ২ মিনিট ডুবিয়ে রেখে ছেড়ে দিতে হবে এবং কিছু সময় পরে আবার ২ মিনিট লবন জলে স্নান করাতে হবে, এইভাবে আমরা সারাদিনে ৩৪ বার করবো এবং এই প্রক্রিয়া পর পর ৪-৫ দিন করবো

২. এছাড়াও আমরা জৈবিক ভাবে বানানো ঘরোয়া টোটকাও ব্যবহার করতে পারি। সেটি হল – ১০০ গ্রাম মিশ্রণের জন্য লাগবে ২৫ গ্রাম কচি নিম পাতা বাটা, ২৫ গ্রাম কাঁচা হলুদ, ২৫ গ্রাম তুলসী পাতা ও ২৫ গ্রাম রসুনের কোয়া বাটা এবং এই মিশ্রণের সাথে কিঞ্চিৎ লবন ও কয়েকটি ক্রিস্টাল পটাসিয়াম পারমাঙ্গানেটের দানা

যদি ছোটো পুকুর হয় তাহলে আমরা এই মিশ্রণটি জলে প্রতিদিন একটু একটু করে ছড়িয়ে দিতে পারি আর পুকুরটি যদি আয়তনে বড় হয় তাহলে আমরা কয়েকটি স্যালাইনের  বোতলের মধ্যে এই মিশ্রণটি রেখে “Drift Treatment” পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারি

৩.  পটাশিয়াম পারম্যাঙ্গানেট বিঘা প্রতি ২.৫ কেজি হারে জলে গুলে দিলে উকুন মাছের দেহ থেকে ছেড়ে যায়।

৪. পুকুরে কয়েকটি বাঁশ বা গাছের ডালপালা রেখে দিলে মাছ নিজেই গা ঘষে উকুন ঝেড়ে ফেলতে পারে

আমরা চাষিদের বলবো এই লবন জলের ব্যবহার এবং ঘরোয়া টোটকা, এই দুটি পদ্ধতি মেনে চলতে, এতে দেখা গেছে অনেকাংশে সুফল পাওয়া যায় এবং চাষিদের এটাও বলবো যে যত কম এই সমস্ত রাসায়ানিক ব্যবহার করা যায় তত ভালো, এতে জলজ পরিবেশ সুস্থ থাকবে, মাছও সুস্থ থাকবে এবং সর্বোপরি আমরা গ্রাহকদের বিষহীন, পুষ্টি সম্পন্ন মাছ উপহার দিতে পারবো। আর না হলে আমরা নিজেরাই জেনেশুনে নিজেদের রোগ ডেকে আনবো।

এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, এই রোগের জন্য দরকারী ওষুধ বা জৈবিক ভাবে দমন করার পদ্ধতি এখনো আবিষ্কার হয়নি এবং এর জন্য আমাদের মৎসা বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু চাষি ভাইদের কাছে কোন উপায় না থাকার জন্য নিরুপায় হয়ে তাঁরা এই সমস্ত রাসায়নিক জিনিস ব্যাবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন, কারন তাদের কাছে তখন ফসল বাঁচানোটাই প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে।

তবে বিজ্ঞান যেভাবে এগোচ্ছে এবং মৎস্য বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টার ফলস্বরুপ শীঘ্রই আমরা এই পরজীবী জাতীয় রোগের হাত থেকে বাঁচার জন্য সঠিকপথ খুঁজে পাবো, তখন মাছ চাষিদের কাছে এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।

লেখকঃ অভিষেক গিরি (লেকচারার, প্রভাত কুমার কলেজ, কাঁথি এবং প্রশিক্ষক ও পরীক্ষক, গ্রামীন স্বরোজগার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, RSETI )

সৃজনী পতি (ফিল্ড অফিসার, FECPI Pvt. Ltd.)

ডঃপ্রতাপকুমার মুখোপাধ্যায় (অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিজ্ঞানী, সিফা, ভুবনেশ্বর)

English Summary: parasites-lice-fish-farming-remedies
Published on: 03 April 2024, 05:45 IST