চাষবাস মানেই বাজারের রাসায়নিক সার, কৃষিবিষ ও উচ্চফলন ও হাইব্রিড বীজ দিয়ে চাষ করা। সবুজ বিপ্লবের নামে বিগত ৪০ বছর ধরে এই চাষই চলছে। কৃষক থেকে সাধারণ মানুষ সবাই ধরে নিয়েছেন এর কোন বিকল্প নেই। সেই ভাবেই ক্রমাগত প্রচার করে বোঝানো হয়েছে। এটাই নাকি বৈজ্ঞানিক কৃষি। প্রথম দিকে কৃষকদের দ্বিধাদ্বন্দ থাকলেও ধীরে ধীরে ম্যাজিক বীজের ফলন দেখে এই চাষেই ঝুঁকে পড়েছিলেন। প্রথমদিকে ফলন ভালোই হয়েছিল। ধান গমের এলাকা ও উৎপাদন বাড়লেও তৈলবীজ ও ডালের এলাকা ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছে। যে সব কৃষি উপকরণ কৃষকরা নিজেরাই সংগ্রহ করতেন তা ক্রমে অবজ্ঞা ও অবহেলার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অবশ্য মোট উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সেচের নিবিড় যোগাযোগ আছে। ভালো আবহাওয়ার জন্য ২০১১-১২ বর্ষে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য (২৫০ মিলিয়ন টন) উৎপাদিত হয়। কিন্তু সব মানুষের খেতে পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা নেই। দেশজ বীজ মানেই খারাপ বীজ, গোবর সার দিয়ে চাষ করলে ফলন কম হয় ইত্যাদির প্রচার চলে। ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক কৃষির চেপে যাওয়া তথ্যগুলি প্রকাশ পেতে থাকে। কৃষিকাজের খরচ বাড়তে থাকে, কারন সব উপকরণই কৃষককে বাজার থেকে কিনতে হয় এমনকি বীজটাও। সর্বপরি ধান ও গম ইত্যাদি দানা শস্যের ফলন নিম্নমুখী। এই রসায়ন নির্ভর কৃষিকাজে কৃষকরা এখন নাজেহাল। কৃষকরা চাষ ছেড়ে দিচ্ছেন, অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন। সত্যি কোন বিকল্প আছে কি যাতে চাষের খরচ কমে? সমস্যাগুলো উপলব্ধি করলেই আমরা কম খরচের চাষের সমাধান সূত্র সহজেই পেতে পারি। রাসায়নিক কৃষির মাত্র ৪০ বছরেই এই সমস্যাগুলি তৈরি হয়েছে।
মূল সমস্যাগুলি হল –
-
আগের থেকে বেশী রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার করেও আধুনিক জাতের ধান ও গমের ফলন কমেছে।
-
বহুল প্রচলিত আধুনিক ধানের জাত লালস্বর্ণ ধানের ফলন বিঘা প্রতি ২২ মন থেকে গড়ে ১৩-১৪ মণ নেমেছে।
-
গোবর সার প্রয়োগেই অনেক বেশী উচ্চফলনশীল ধানের ফলন ১৬-১৭ মণ, বীজ পাল্টাতে হয় না। কিন্তু এই বিষয়টা কখনো প্রচার করা হয় না।
-
প্রচুর খাদ্য উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও প্রায় ৪০ কোটি মানুষ দুবেলা খেতে পায় না।
-
কৃষি উপকরণের দাম বহুলাংশে বেড়েছে, চাষবাস ব্যয়বহুল হয়েছে, সেই অনুপাতে কৃষি পণ্যের দাম বাড়েনি।
-
মাটির জৈবিক সত্ত্বা হারিয়েছে, কেঁচো ও অন্যান্য উপকারি জীবানুর সংখ্যা কমেছে, অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব বেড়েছে।
-
অতিরিক্ত জল তোলার ফলে ভূগর্ভস্থ জলতল নিচে নেমে যাচ্ছে। আর্সেনিক ও ফ্লোরাইডের দূষণ বাড়ছে।
-
খাদ্যে, জলে, দুধে, মাছ, মাংস, শাকসব্জি ও ফলে কৃষি রাসায়নিকের মাত্রাতিরিক্ত অবশেষ পাওয়া যাচ্ছে।
-
মানুষের রোগ ভোগ বেড়েছে বিশেষত ক্যানসার।
-
২ লক্ষের বেশী কৃষকের আত্মহত্যা বেদনাদায়ক এবং আত্মহত্যার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।
-
বিষ বেশী প্রয়োগ করেও রোগ ও পোকা না কমে ফসলে বিশেষ কৃষিবিষ প্রতিরোধী রোগ ও পোকার সংখ্যা বাড়ছে।
-
মৌমাছি জাতীয় পরাগমিলন-কারী পোকার সংখ্যা ব্যাপক পরিমাণে কমছে। পটলে ফুল ছোঁয়াতে হচ্ছে।
-
সবুজ বিপ্লবের সাথে সাথে বিপুল ফসল বৈচিত্র্যে ধ্বংস হয়েছে, কৃষকের হাতে দেশজ বীজ নেই। দেশের ৮২০০০ দেশী ধানের জাত, ৩৬৬৮ রকমের বেগুন, ১৬০০০ ছোলার জাত, ধানের জমিতে জন্মানো বিভিন্ন ধরনের মাছ ইত্যাদি সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কৃষকের জমি থেকেই।
-
দেশজ বীজের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতার কথা উহ্য রাখা হয় কারণ এতে কৃষি উপকরণ বিক্রেতাদের কোন উপকার হবে না।
-
কখনো বলা হয় না আঞ্চলিক দেশজ বীজই ভবিষ্যৎ খাদ্য সুরক্ষার স্তম্ভ।
উপরের সমস্যাগুলি ভালো করে অনুধাবন করলেই কম খরচের সুস্থায়ী চাষের দিশা পাওয়া সম্ভব। হাজার বছরের পরীক্ষিত ও প্রমাণিত চাষ ব্যবস্থার দিকে ফিরে দেখা প্রয়োজন। কেন এতদিন এইসব চাষ ব্যবস্থা টিঁকে আছে? দেশী ধানের সঙ্গে মাছ ও গেড়ি-গুগলি, খড় এই সবের কোন গুরুত্ব নেই, অথচ ধানের জমিতে জন্মানো মাছ গ্রামীন মানুষের কাছে সহজলভ্য প্রোটিন, খড় গরুর খাদ্য, চাল ছাওয়ার কাজে লাগে।কৃষক ধানের জমির মোট উৎপাদনশীলতার কথা ভাবতেন, বিচ্ছিন্নভাবে শুধু দানার ওজনটা নয়। আধুনিক জাতের ধান চাষে স্বাদ বৈচিত্র থাকে না । ফলন যা বেশী হল তা দিয়ে বাজার থেকে মাছ কিনে খেতে হয়।ধানের পর ডাল শস্য চাষ জমিকে উর্বর করে, খরচও খুব কম। বোরো ধানে চাষের পক্ষে প্রচার চালানো হল এতে রাসায়নিক সার ও বীজ ছাড়াও মাটির তলার জল তোলার পাম্প বিক্রির ব্যবসাটাও ভালো হবে। অন্যান্য ডাল শস্যের চাষও উঠে গেল। এখন ডালের দাম আকাশছোঁয়া। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য টানা ৯০ দিন ৩০ গ্রাম করে খেসারীর ডাল খেলে স্নায়ুর অসুখের সম্ভাবনা থাকে। তবে গরম জলে ডাল সেদ্ধ করে জল ফেলে দিলে ওই রোগের সম্ভাবনা কমে যায়। আবার একই ডাল রোজ খাওয়া হয় না। অতিরিক্ত জল তোলার জন্য জলে আর্সেনিক দূষণ এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সনাতনী পরিবেশ-বান্ধব চাষে খরচ কম, উৎপাদনও ধারাবাহিক থাকে। দ্রুত ফলন বাড়ানোর তাগিদে অথচ এসবই অগ্রাহ্য করে রাসায়নিক নির্ভর সবুজ বিপ্লবের ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। নৈতিকতা বিজ্ঞান বানিজ্যের কাছে হার মানে। বাজারের কেনা সার, বিষ ও বীজ প্রয়োগকেই বৈজ্ঞানিক কৃষি বলে চালানো হয়। বিজ্ঞান একটা পদ্ধতি এই নিয়ম কানুনও মানা হল না। অথচ আধুনিক জাতের বীজ ২-৩ বছর না পাল্টালে ভালো ফলন হবে না, এবং কৃষি উপকরনের মাত্রা বছরের পর বছর বেড়েই চলে। এটা ভারত নয় সব দেশেই একই অবস্থা।
উচ্চ ফলনশীল ধান সর্বত্র একই ফলন দেয় না। কেবলমাত্র সমতলভূমিতে যেখানে সার সেচ ও পরিচর্যা ঠিক মত হবে সঠিক আবহাওয়ায় ফলন পাওয়া যাবে। তাই উচ্চফলনশীল না বলে আধুনিক জাতের ধান বলাই শ্রেয়। বাংলায় এই ধরনের ৫৫০০ আঞ্চলিক ধানের চাষ ছিল সবুজ বিপ্লবের আগে। আধুনিক জাতের দাপটে এখন সবই লুপ্তপ্রায়। কোন লুপ্ত ধানকে পৃথিবীর কোন বৈজ্ঞানিক আর ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। একটি বিশেষ ধান মানেই একটি বৈশিষ্ট। বিভিন্ন রোগ সহনশীল যেমন টুংরো ভাইরাস, ঝলসা, পোকার আক্রমণ সহনশীল যেমন মাজরা, ভেঁপু, বাদামী শোষক পোকা। আবার গভীর জল, মাটির লবন সহ্যকারী, ঠান্ডাসহ্যকারী, সুগন্ধীচাল, সরুচাল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অনেক বেশী ধানের মধ্যে পাওয়া যায়। সুতরাং ধান চাষীর মাঠ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে ওই চরিত্র উদ্ভিদ প্রজননের মাধ্যমে প্রবেশ করানো যাবে না। তাছাড়া মাঠে স্বাভাবিক নিয়মে ইতর পরাগ মিলনে ওই চরিত্র অন্য কোন ধানে প্রবেশ করার সুযোগ থাকল না। এই ভাবেই নতুন কোন জাত নির্বাচিত হয়।
যে কোনো রাষ্ট্রেরই নীতি হওয়া উচিৎ চাষব্যবস্থা যেন ব্যয় বহুল না হয় এবং উৎপাদনশীলতা যেন বজায় থাকে। চাষ ব্যবস্থা ব্যয়বহুল যাতে না হয় সেই জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র বিপুল পরিমানে ভর্তুকি দেয় চাষীদের। আমেরিকা, ইউরোপ ও জাপানে বিপুল ভর্তুকি দেওয়া হয়, এমন কি চাষ না করা বা বন্ধ রাখার জন্যও ভর্তুকি চালু আছে। অবশ্য ওই দেশের হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমির অধিপতির সঙ্গে ভারতের ছোট জোতের চাষীর কোন তুলনাই চলে না। ভারতে রাসায়নিক সারের বিক্রয় মুল্য কমাবার জন্য সার উৎপাদনকারী সংস্থাগুলিকে এক লক্ষ উনিশ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল ২০০৭-০৮ বর্ষে। প্রায় ৪০% নাইট্রোজেন যুক্ত সার, ৬০% ফসফেট ঘটিত সার ও পুরো পটাশঘটিত সার বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিপুল পরিমানে ভর্তুকি দিয়ে যে খাদ্য উৎপাদিত হয়, তাকে দাবি করা হয় ভারত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
সারা পৃথিবীই রাসায়নিক কৃষির ভয়াবহতার দিক সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। কৃষক ও পরিবেশের স্বার্থে সুস্থায়ী উন্নয়ন ও সুস্থায়ী কৃষির বিকাশের কথা বলা হলেও নীতি নির্ধারকরা বানিজ্য নির্ভর কৃষির পক্ষে রায় দিচ্ছেন। আমেরিকাতে ১৯৮৬ সালে জৈব কৃষি সরকারি নীতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই সমস্ত দেশে জৈব ফসলের জন্য আলাদা বাজার রয়েছে। আবার কিউবা দেশটি পুরোপুরিভাবে জৈব দেশ। কোন প্রকার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই দেশে চাষ হচ্ছে এবং আগের থেকে খাদ্য প্রাপ্তি বেড়েছে। ২০০৮ সালের ৮ই এপ্রিল জোহান্সবার্গে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অন এগ্রিকালচারাল সায়েন্স টেকনোলজি ডেভেলপমেন্টের আলোচনা সভা। সংযুক্ত রাষ্ট্রের সৌজন্যে গঠিত এই সমীক্ষা চালানো বহু দেশে এবং ওই আলোচনা সভায় ভারত সহ বিশ্বের ৪০০ বৈজ্ঞানিক ও ১০০০ প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন। ওই সমীক্ষায় বলা হয়েছে কৃষি পণ্যের ব্যবসার মাধ্যমে রাসায়নিক কৃষি ব্যবস্থা আর বেশীদিন মানুষকে খাওয়াতে পারবেনা, বিকল্প হিসেবে জৈব কৃষির পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে। বহু আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে জৈব কৃষির উৎপাদনশীলতা রাসায়নিক কৃষির থেকে বেশী, খরচ কম হয় ও পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও ভবিষৎ খাদ্য সুরক্ষার সহায়ক। জৈব ফসলের ব্যবহারে শারীরিক সুস্থতা বজায় থাকে, রোগ ভোগ কম হয়। কারন কৃষিবিষ-বিহীন জৈব ফসল বেশী পুষ্টিকর এবং ক্যান্সার প্রতিরোধক অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমান বেশী থাকে। উল্লেখ্য যে সমস্ত জায়গায় তথাকথিত বৈজ্ঞানিক কৃষি উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি সেখানে কৃষক আত্মহত্যাও নেই, পরিবেশ দূষণও নেই। জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষ, উত্তর পূর্বভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ওইসব ঘটনা নেই।
সুখের কথা ভারত সরকারের কৃষি মন্ত্রক জৈব কৃষি প্রকল্প গ্রহন করেছ। মোট ৮টি কেন্দ্রের মাধ্যমে সব রাজ্যেই এর প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করছেন। উদ্যানবিদ্যা বিভাগও অনুরূপ কর্মসূচি নিয়েছেন। রাজ্য সরকার বিভিন্ন ব্লকে জৈব গ্রাম প্রকল্পের মাধ্যমে জৈব কৃষির প্রসার ঘটাতে চাইছেন। কিন্তু কোন এক কারনে এই নিয়ে বিশেষ কোন প্রচার নেই।
বহু কৃষকই রাসায়নিক কৃষির ধাক্কা উপলব্ধি করেছেন এবং বিকল্প কৃষির দিকে ঝুঁকেছেন। রাসায়নিক কৃষিতে তাঁদের এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকা অবস্থা। কোন প্রকার বাস্তব অভিজ্ঞতা বিহীন বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তোলেন জৈব কৃষি মানুষকে খাওয়াতে পারবে কিনা, এর উৎপাদন কম ইত্যাদি। বাস্তবটা বরং উল্টো, রাসায়নিক কৃষিই বেশীদিন মানুষকে খাওয়াতে পারবে না। আবার উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে খেতে পাওয়ার সরাসরি সম্পর্ক নেই এবং উৎপাদন কমের জন্য পৃথিবীর কোথাও দুর্ভিক্ষ হয়নি। আদি জনগোষ্ঠি যারা প্রকৃতির উপর নির্ভর করে জীবন নির্বাহ করেন , অর্থাৎ তথাকথিত রাসায়নিক সার ও বিষের বৈজ্ঞানিক কৃষি শেখেননি তাদের কেউই দূর্ভিক্ষে মারা যাননি। প্রশ্নটা হল মানুয়ের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানো এবং গণবন্টন ব্যবস্থার উপর জোর দেওয়া। এমনকি প্রাচুর্য্যের দেশ আমেরিকাতেও দুবেলা খাবার যোগাড় করতে অক্ষম মানুষের সংখ্যা ২ কোটির কাছাকাছি। কিন্তু এই দিকটা এড়িয়ে যাওয়া হয়।
প্রথম সবুজ বিপ্লবের অজস্র উদ্ভুত সমস্যার কোনরকম সমাধান না করেই আরো বেশী রাসায়নিক সার , বিষ ও হাইব্রিড বীজের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ২য় সবুজ বিপ্লবের সংগঠিত করবার প্রচুর অর্থ মঞ্জুর করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বহু বিতর্কিত পেটেন্ট করা খাদ্য ফসল-জিন শস্য চালানোর চেষ্টা হচ্ছে। এর দ্বারা কৃষকের অধিকার খর্ব হবে, বীজের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়ে যাবে, কৃষকের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে চলেছে, কৃষি ব্যবস্থাটার মার্কিন মদতপুষ্ট কিছু কোম্পানীর করায়ত্ত করে।
কম খরচে চাষ বাসের ধাপ সমুহ:
কম খরচে চাষবাস বিষয়টা মোটেই জটিল ও অবাস্তব বিষয় নয়। বাইরের কৃষি উপকরন – সার, বিষ ও বীজ ব্যবহারেই চাষবাস ব্যয়বহুল হয় এবং হচ্ছে। কারন উপকরনের দাম বাড়ে বাজারের নিয়ম অনুযায়ী, ভর্তুকি কমে, উৎপাদিত পন্যের মূল্য বাড়ে না। মাটির উর্বরতা ও উৎপাদিকা শক্তি হ্রাস পায়। প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারেই সুস্থায়ী কৃষি উৎপাদন সম্ভব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য জাপানী অনুবীজ বিজ্ঞানী মাসানুবু ফুকুওকা দীর্ঘ গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে কৃষি বাস্তুতন্ত্র কে এমন এক বিশেষ অবস্থায় পৌঁছলে জমিতে চাষ করবার প্রয়োজন হয় না এবং ফলন বিনা রাসায়নিকে কমখরচে যা হয়, আর রাসায়নিক চাষে খরচ বাড়িয়ে যা ফলন হয় - দুইই সমান। তিনি হাতে নাতে এই প্রাকৃতিক চাষের ফলাফল গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে ছিলেন ১৯৮৫ সালে। একটি খড়ের বিপ্লব নামক বইয়ে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। রাসায়নিক কৃষির প্রণেতারা স্বাভাবিক ভাবে এই চাষ চাইবেনা পাছে সার, বিষ ও বীজ বিক্রিতে টান পড়ে। তাঁদের কাছে কৃষি মানে বিভিন্ন কৃষি উপকরনের বিক্রি। মহারাষ্ট্রের সুভাষ পালেকের শূন্য বাজেটের প্রাকৃতিক চাষের প্রবক্তা। তাঁর পদ্ধতি মহারাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য বেশ কিছু রাজ্যে প্রচলিত হচ্ছে। এখানে আবার প্রচলিত জৈব চাষের থেকে খরচ কম। একটি গরুর গোবর দিয়েই তিন বিঘা জমি চাষ অনায়াসে সমম্ভব। তার সঙ্গে তরল সারের মত পঞ্চগব্য (দুধ, ঘি, দই, গোবর ও গোচনা ইত্যাদি দ্বারা প্রস্তুত), পঞ্চামৃত ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়।
নদীয়ার করিমপুর গ্রামে এই পদ্ধতিতে চাষ-আবাদ হচ্ছে। আমাদের কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে গরুর ব্যবহার অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কম খরচের একটি উল্লেখযোগ্য জৈব উপাদান হল গোবর। রাসায়নিক কৃষি ব্যবস্থার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের প্রচলন বাড়ে, চাষের গরুর ব্যবহার কমে যায়। ট্রাকটর বা পাওয়ার টিলার দ্বারা চাষের সময় জমির কেঁচো , ব্যাঙ, সাপ সবই মারা পড়ে পালানোর পথ পায় না। জমিতে চাষের গভীরতা কম হয় বিশেষ করে ধান চাষে হাজার হাজার বছর এই চাষের ফলে মাটির উৎপাদিকা শক্তি নষ্ট হয়নি বা উৎপাদনশীলতাও কমেনি। এটাই হল জৈব কৃষি। রাসায়নিক কৃষির মতো এখানে ফসলকে খাবার যোগান দেওয়া হয় না, বরং মাটিকে খাবার দেওয়া হয়। মাটিতে প্রয়োগ করা জৈব পদার্থ মাটিতে বসবাসকারী কৃষকের বন্ধু কেঁচো, উপকারী জীবানু, পরভোজি মাটির কৃমি ইত্যাদির সংখ্যা বাড়ে এবং এগুলি উদ্ভিদকে খাবার যোগান দেয়। মাটির পি এইচ প্রশম করে ৭ এর কাছাকাছি আসে। প্রথম দিকে ১-২ বছর ফলন কম হবে, মাটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় আসার সুযোগ দিতে হবে। যাতে মাটির জৈবিক সত্তা ফিরে আসে। একজন কৃষককে পুরোজমি রাতারাতি জৈব কৃষিতে রুপান্তরিত করার প্রয়োজন নেই। ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে হবে। জৈব কৃষির ধাপগুলি হল নিম্নরূপ -
(ক) মাটির প্রশম করন ও মাটির খাদ্য: রাসায়নিক কৃষির জমির অম্লত্ব ও ক্ষারত্ব বেড়ে যায়, উদ্ভিদ খাদ্যের যোগান ঠিক হয় না। তাই মাটিকে প্রশম করতে হবে। বিঘা প্রতি বছরে একবার ফসফেট দ্রবীভূতকারী জীবানু সহ ২০ কেজি রক ফসফেট, ৮০০-১০০০ কেজি গোবর সার, ২-৩ বার তরল সার, ধান মিলের কালো তুষের ছাই (বিঘা প্রতি ৫০ কেজি), কচুরিপানার খোল কম্পোস্ট ইত্যাদি।
(খ) বীজ নির্বাচন: এমন বীজ সংগ্রহ করতে হবে যাতে বীজ ঐ অঞ্চলে উৎপাদন করা সম্ভব হয়। বীজ পারস্পরিক বিনিময় করতে হবে। বীজ একবার সংগ্রহ করলে সারা জীবন ওই বীজ চলে যাবে। অনেক দেশজ ফলের স্বাদ ভালো। ১৮৮০ সালে ইংরেজের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে তামিলনাড়ুর সালেম ও থাঞ্জাভূর জেলায় ধানের ফলন ছিল বিঘা প্রতি ২৫-৩০ মণ/হেক্টর। বেশী উৎপাদনক্ষম অনেক দেশজ ফলনের জাত আছে যেমন ধানের ক্ষেত্রে কেরালাসুন্দরী, বহুরুপী, কেশবসাল, বউরানী ইত্যাদি। গোবর সার দিয়ে এর ফলন হয় বিঘা প্রতি ১৫-১৮ মণ। দেশী ধানের খড়ের ভালো দাম পাওয়া যায়। অনেক দেশজ উচ্চফলনশীল ফসল আছে যেগুলোতে রোগ ও পোকা কম লাগে। যেমন লাল ও গাছ ঢ্যাঁড়শ, মালদার নবাব গঞ্জের বেগুন, সাদা ডিম ও কুলি বেগুন।
(গ) চাষ পদ্ধতি : একক ফসলের চাষ করা যাবেনা। দুতিন রকম ফসল বিভিন্ন লাইনে বুনে মিশ্র ফসলের চাষ করা প্রয়োজন। পুরো জমির ফসল একবারে উঠবেনা। যে লাইনের ফসল উঠবে চাষ করে বা খুপি করে সেই লাইনে উপযুক্ত ফসল লাগাতে হবে। জঙ্গলে বিভিন্ন উদ্ভিদ একই সাথে বেড়ে ওঠে , প্রায় গায় গায় লেগে থাকে । রোগ পোকা থাকে না , বৃদ্ধিও ভালো হয়। সেই ভাবে বিভিন্ন রকম ফসল একসঙ্গে চাষ করলে ফসলে রোগ ও পোকার উপদ্রব কম হয় এবং মোট উৎপাদন বেশী হয়। একই গোত্রের ফসল এক সঙ্গে চাষ করা যাবে না। যেমন বেগুন ও টমাটো। কারন দুই ফসলের রোগ ও পোকা একই এবং আক্রমণ বেশী হবে। সম দৈর্ঘ্যের শিকড় যুক্ত ফসল এক সাথে চাষ করা যাবে না, দুটি ফসলই মাটির একই স্তর থেকে খাদ্য টানবে ফলে খাদ্যের প্রতিযোগিতা বাড়বে।
কয়েকটি সাথি ফসলের নমুনা:
_______________________________________
বেগুন ও টমাটোর সাথী ফসল –
বরবটি/মটর/সয়াবীন/গাজর/পিঁয়াজ, রসুন। (বেগুন ও টমাটো এক সাথে নয়)।
ভুট্টা +সয়াবীন/বাদাম/কলাই/অড়হড়। তিল+পাট/মেস্তা। করলা+লংকা। ছোলা+তিসি। টমাটো+বাঁধাকপি/রসুন/গাঁদা।
অড়হর+মুগ/বাদাম/বাজরা। তিল+কলা। মিষ্টি আলু+ভুট্টা+তুলো। মাচায় পটল+নিচে লংকা।
ভুট্টা+মুগ/বরবটি/শাঁকালু/শীম। সরিষা+গম+ছোলা। জোয়ার+ভুট্টা। টক ঢ্যাড়শ+অড়হর।
সুপারি/নারকোল+পেয়ারা/লেবু। পেঁপেঁ/কলা+আনারস। কলা+আনারস। আম(চারা অবস্থায়)+ বিভিন্ন সবজি/ডাল শস্য
আম(বড় অবস্থায়)+হলুদ/আদা। কলা+লংকা/তিল/বরবটি।
বেগুনের/পান বোরোজের জমির চারপাশে ঢ্যাঁড়শ/কলাগাছ লাগালে সাদামাছির আক্রমণ কমে।
সুঁয়োযুক্ত ধান যেমন সুঁয়োকলমা, তুলাইপাঞ্জী ইত্যাদ ধান জমির চারপাশে লাগালে ধান কাটার সময় গরু ও ছাগলের উপদ্রব কমে। জমির চারপাশে তিল লাগালে গরু ও ছাগলের উপদ্রব কমে।
গভীর জল যেখানে জমে না এবং যেখানে জল নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সেখানে ১২-১৫ দিনের ধান চারা এক কলি (একটি চারা) করে ১০ ইঞ্চি * ১০ ইঞ্চি দূরত্বে লাগালে বীজের খরচ বাচে এবং ফলন ভালো হয়। বহু দেশী ধানের ফলন যথেষ্ট ভালো এবং সুগন্ধি ধানের ফলন কম হলেও চাহিদা বেশী, দামও ভালো পাওয়া যায়। ধান মাছ ব্যবস্থাপনায় কৃষকের লাভ হয়। সেই ভাবে দেশী মুড়ির চাল, সরু ধানের চাষে খরচ কম হয়।
দক্ষিন ২৪ পরগনায় আলে ঢ্যাড়শ + শীম (সামান্য দেরীতে লাগিয়ে আগা ছেটে রাখা হয় যাতে ঢ্যাড়শ গাছের ক্ষতি না হয়। কয়েক মাস পর থেকে শীমের বৃদ্ধি হতে থাকে, ছাটা হয় না। ঢ্যাঁড়শ উঠে যাওয়ার পর শীমে ফুল আসার সময় হয়। একই পরিচর্যায় দুটি ফসল হল।
বাঁধাকপির চারিদিকে বা আট লাইন অন্তর অন্তর সরিষা দু লাইন করে লাগাতে হবে। বাঁধাকপি লাগানোর ১৫ দিন আগে। জাব পোকা , করাত মাছি হীরকপৃষ্ঠ মথ সবার আগে সরিষাতে আক্রমণ করবে এবং মূল ফসল বাঁধাকপি রক্ষা পাবে।
টমাটোর সাদা মাছি ঠেকাতে চারিদিকে শশা লাগানো হয়। ফসলের চারিদিকে তুলসি, চাকুন্দে, আকন্দ, বাসক, ভাট ইত্যাদি থাকলে পোকা বিতারকের কাজ করে। এই রকম প্রমানিত বহু সাথী ফসলের উদাহরণ আছে। সব জমিতে একই ফসল প্রযোজ্য হবে তা নয়, পরিবেশ ও পরিস্থিতি আনুযায়ী করতে হবে।
জলমগ্ন ধানের জমিতে রাসায়নিক সার ও কৃষিবিষ না ঢুকলে সহজেই মাছ জন্মায়। আগে সাড়ে চার মাস সময়ে এক বিঘা ধান জমি থেকে প্রায় ৩০-৪০ কেজি মাছ পাওয়া যেত। ধানের সঙ্গে সহজ লভ্য প্রোটিন হিসাবে মাছটাও সহজে মিলে যেত, ধানের ফলন কম হলেও পুষিয়ে যেত। সেই অবস্থা আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এখন কম করে এক বিঘা জমিতে ২০ কেজি মাছ হলে, ৬০ টাকা কেজি হিসাবে ১২০০ টাকা আর্থিক মূল্য হয় যা শুধু ধান চাষ করে পাওয়া যায় না। শস্য পর্যায় অনুসরণ করতে হবে যাতে একই জমিতে একই রকম ফসল বারবার না চাষ করা হয়।
বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া মাটিকে রোদ খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। মাটির রস সংরক্ষণ বড় কথা। গ্রীষ্মকালে জমিতে আচ্ছাদন ফসলের যেমন মুগের চাষ করা। এই সময় রাসায়নিক কৃষির মত গভীর চাষ করতে হবে না। এতে মাটির রস উঠে যাবে।
জমির আগাছা সম্পূর্ণ নির্মূল না করা, কিছু আগাছা রেখে দিতে হবে, এগুলিই শত্রু ও বন্ধু পোকার আশ্রয়স্থল। বছরের কোন না কোন সময়ে অবশ্যই ডাল শস্য চাষ করতে হবে, এতে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া মাচায় চাষ ও সুসমন্বিত চাষ ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে।
কম খরচে আলু চাষ –
ধান কাটার পর রসযুক্ত জমিতে আলুর চোখ কেটে নির্দিষ্ট দূরত্বে বসানোর পর এক মুঠো গোবর সার চাপা দিতে হবে এবং পরে কচুড়িপানা সামান্য শুকিয়ে আচ্ছাদন করে দিতে হবে। চাষ না করে খুব কম খরচে আলু চাষ পশ্চিম মেদিনীপুরে হচ্ছে। ১০ দিন পর আবার কচুড়িপানা দিয়ে আচ্ছাদন দিতে হবে। মোট ৩-৪ বার আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এতে মাটির রস সংরক্ষিত হবে, সেচের কোন প্রয়োজন নেই। আলু কচুরিপানার মাঝখানে হবে, মাটির ভিতরে নয়। এতে রোগ পোকা কম হয়। উৎপাদন কম হলেও চাষের খরচ কম।
বাড়ীতে পুরানো বস্তায় মাটি ও গোবর সার ভরে বিভিন্ন সবজি করা যেতে পারে। ধান জমির আল ও পুকুর পাড়ে সরু মাচায় লাউ, কুমড়ো, শীম, করলা, ধুদুল, কুদরী ইত্যাদি লতানো ফসলের চাষ করা হচ্ছে। খরচ কমে জায়গার সঠিক ব্যবহার হয়।
ফল বাগানে গাছের পাতা সরিয়ে না ফেলে গাছে যতদূর ছায়া পড়ে সেই অংশে রেখে দিতে হবে। এর ফলে জমির রস সংরক্ষন হবে এবং কোন সেচের প্রয়োজন হবে না।
(ঘ) রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণ:
জৈব উপায়ে উৎপাদিত ফসলে রোগ ও পোকার উপদ্রব কম হয়। রাসায়নিক সার প্রয়োগে গাছ রোগ পোকা প্রবণ হয়ে পড়ে। দেশজ ফসল, মিশ্র ফসল ও সাথী ফসল থাকা ও জৈব সার প্রয়োগের জন্য রোগ ও পোকার উপদ্রব কম হয়। রাসায়নিক কৃষিতে এই বিষয়ের উপর কোন নজর দেওয়া হয় না। রোগ পোকার আক্রমণের প্রাথমিক অবস্থায় আক্রান্ত রোগ ও পোকার অংশটি তুলে ফেলে দিতে হবে। সময়ের ফসল সময়ে লাগাতে হবে। সেমন গ্রীষ্মকালে লাগানো মূলত শীতকালীন ফসল বাঁধাকপি ও ফুলকপিতে ব্যাপক রোগ ও পোকার আক্রমণ হয়। কৃষক বেশী লাভ পাওয়ার জন্য বেশী কীটনাশক স্প্রে করেন। আবার শীতকালে বেগুনে পোকা কম হয়।
চামরমনি ও কালোনুনিয়া ধানে ঝলসা হয় না। বেশীরভাগ দেশজ ফসল ও দেশী ধানের রোগ ও পোকার প্রতিরোধ শক্তি আছে। প্রকৃতিতে পোকা, মাকড় ও রোগ থাকবেই সব নির্মূল করতে যাওয়া বৃথা। পাখি প্রচুর পোকা খায়। জমিতে পাখি বসার জায়গা করে দিতে হবে। একটি ফিঙে পাখি দিনে প্রায় ১৫০ টা পোকা খেতে পারে। রাতে পেঁচা ইদুর খেয়ে ইঁদুরের সংখ্যা কমিয়ে রাখে। প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় মাকড়সার মত মাংসাশী পোকা ফসল আক্রমণকারী নিরামিষাশী পোকা ধ্বংস করে। কিছু পোকা শত্রু পোকার শরীরে ডিম পাড়ে। এর ফলে শত্রু পোকার সংখ্যা কমতে থাকে। জৈব কৃষির উদ্দ্যেশ্য হল প্রাকৃতিক খাদ্য খাদক সম্পর্ককে স্বাভাবিক রাখা তা হলেই ফসল সুরক্ষিত থাকবে।
মাটির উপকারী ছত্রাক ট্রাইকোডারমা ভিরিডি উদ্ভিদ রোগ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ক্ষতিকর ছত্রাককে আক্রমণ করে। বাজারে টিভি নামে প্রচলিত এই ছত্রাক উদ্ভিদের রোগের জন্য স্প্রে করা হয়। মাটিতে পাওয়া এক জীবানু ব্যসিলাস থুরিনজিয়েনসিস-এর স্পোর বানিজ্যিকভাবে বিক্রি হচ্ছে বিটি নামে। পিসিলিমাইসেস নামক মাটিতে বসবাসকারী ছত্রাক মাটির কৃমি নিমাটোড প্রতিহত করতে সাহায্য করে। শীতকালে (সর্ব্বোচ্চ ২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায়) বিভিন্ন সবজি লেদা পোকার জন্য স্প্রে করা হয়। ওই স্পোর লেদা পোকার পাকস্থলীতে প্রবেশ করার পর পাকস্থলী নষ্ট করে দেয় , পোকার আক্রমণ কমে। এর জন্য কোন রাসায়নিক কীটনাশকের মত কোন দূষণ হয় না। কয়েক বছর চাষ করার পর কৃষি বাস্তুতন্ত্র স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পর বাইরের উপকরনের আর বিশেষ প্রয়োজন হয় না। তবে বহু বিতর্কিত জীন পরিবর্তিত বিটি শস্য আলাদা বিষয়। ফসলে শুধুমাত্র লেদা পোকার আক্রমন প্রথম দিকে কম হলেও গৌন পোকার আক্রমনের জন্য আরো বেশী বিষ স্প্রে করতে হয়, লেদা পোকারও প্রতিরোধ শক্তি বেড়ে যায়। তাছাড়া পরিবেশে এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া প্রমানিত এবং জৈব কৃষিতে গ্রহনযোগ্য নয়।
প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থাপনা
জৈব কৃষির একটি সহজ নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা হল তরল সার
_______________________________________
একটি ৩০-৪০ লিটার জল ধরবে এই রকম একটি মাটির জ্বালায় ২ কেজি গোবর, ৪ লিটার গোচনা, ২০০ গ্রাম করে কুচো করা আতা, বাসক, নিসিন্দা ও ভাট পাতা, ২০০ গ্রাম করে টক দই, চিটে গুড় ও ব্যসন দিয়ে জল ভরে দিতে হবে। উপরে সরা চাপা দিয়ে রাখতে হবে এবং রোজ দু-এক বার করে নাড়তে হবে যাতে বাতাস চলাচল ভালো হয়। এক মাস পর গন্ধ কমে গেলে ওই তরল সার বালতি বা অন্য পাত্রে স্থানান্তরিত করে শেষবার ধান জমিতে চাষ
করার পর ছিটিয়ে দিতে হবে। তিনটি জ্বালা রাখতে হবে এক বিঘা জমির জন্য, ১৫-২০ দিন অন্তর ছেটাতে হবে। এক রাত ধরে কাপড়ের ঝুলিতে ছেঁকে নিয়ে এক ভাগ
ছাঁকা তরল সারের সঙ্গে ৩ ভাগ জল মিশিয়ে সবজিতে স্প্রে করলে অনুরুপ ফল পাওয়া যাবে।
------------------------------------------------------
দয়ে পোকা, মাকড় ও জাব পোকা নিয়ন্ত্রনের জন্য বরফ ঠান্ডা জল বা ১০০ গ্রাম এরারুটের আঠা বা ১০০ গ্রাম এটেল মাটি ১০ লিটার ঠান্ডা জলে গুলে স্প্রে করতে হবে।
বেগুন ও টমাটোর ফল ছিদ্রকারী পোকার জন্য ৫০ গ্রাম রসুন, ৩০ মিলি কেরোসিন তেলে থেতো করে একরাত ভিজিয়ে রাখতে হবে, ছেঁকে নিয়ে ২০ লিটার জলে সামান্য সাবান (৫-৭ গ্রাম)গুলে স্প্রে করতে হবে। তামাক পাতা
ভেজানো জল স্প্রে করলে অনেক পোকা কম থাকে। সিট্রোনেলা তেল ৩ মিলি এক লিটার জলে গুলে স্প্রে করলে ধানের গন্ধি পোকা কম হয়। ১০ লিটার জলে এক কেজি গোবর গুলে (ছেকে নিয়ে) তার সঙ্গে ২ লিটার গোচনা মিশিয়ে ধানে ও অন্যান্য ফসলে স্প্রে করলে রোগ পোকা কমে ও বৃদ্ধি ভালো হয়। এর দ্বারা ধানের গন্ধি পোকা কমে। এক কেজি কেঁচো সার ১০ লিটার জলে গুলে নিয়ে ভালো করে ছেঁকে নিয়ে স্প্রে করলে গাছের রোগ পোকা কম হয় ও বৃদ্ধি ভালো হয়।
৩০ মিলি বাদাম পাতার রস ১০ লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করলে বাদাম ছাড়া অন্য ফসলের অনেক রোগ কমে যায়। রোগ পোকা নিয়ন্ত্রনের জন্য এই ধরনের অনেক দেশজ পদ্ধতি আছে। এই সব পদ্ধতি হাইব্রিড বা আধুনিক জাতের জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। মাঠে ইঁদুর দেখা দিলেই ইঁদুর নিয়ন্ত্রনের জন্য ইঁদুর কল ফাঁদ, বাঁশের তৈরী বিশেষ ফাঁদের ব্যবহার। পটল মূলের রসে/ঢোল কলমির পাতার রসে ভেজানো গম বীজ ইঁদুরের গর্তে ছড়িয়ে দেওয়া। আলকুশির বীজের উপরের রোঁয়া ইঁদুরের গর্তের মুখে ছড়িয়ে দিতে হবে। ইঁদুরের শরীরে ওই রোঁয়া লাগলে ইঁদুরের অস্বস্তি হয়, ওই জায়গা ছেড়ে পালায়। এক ভাগ সিমেন্টের সঙ্গে তিন ভাগ আটা মিশিয়ে (শুকনো অবস্থায়) কাগজের উপর জমিতে রেখে দিতে হবে। পাকস্থলীতে ওই মিশ্রণ জমাট বেঁধে মৃত্যু ঘটায়। ইঁদুরের গর্তে শুকনো লংকার ধোঁয়া দিলে পালিয়ে যায়। এই ধরনের বহু দেশজ নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা আছে।
- Dr. Anupam Pal (Joint Agriculture Director, Agricultural training center, State Government of West Bengal)
Share your comments