কৃষিকাজে জলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে স্বাদু জলের ভান্ডার সীমিত, তাই বর্তমানে নানা দেশের সাথে আমাদের দেশেও জলসংকটের কালো ছায়া নেমে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গের ভূগর্ভস্থ জলস্তর ক্রমশই নিচের দিকে নেমে চলেছে। তাই ভবিষ্যতের জীবনযাপন ও কৃষিকাজ টিকিয়ে রাখতে জলসম্পদের সংরক্ষণ অত্যন্ত প্রয়োজন। কৃষিকাজে সঠিক বৈজ্ঞানিক পরিকাঠামোতে জলসেচের মাধ্যমে উৎপাদনের উৎকৃষ্টতা ও পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে জলের অপচয় বন্ধ করা সম্ভব। সেচের উন্নত প্রয়োগ কৌশল ও উন্নত কৃষি ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সেচের পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটিয়ে আধুনিক সেচ ব্যবস্থার প্রয়োজন।
ভারতবর্ষের কৃষিতে জলসেচ ব্যবস্থার গুরুত্ব :- ভারতের কৃষিকাজে জলসেচ ব্যবস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । নিম্নলিখিত কারণগুলির জন্য ভারতের কৃষিকাজে জলসেচ ব্যবস্থার প্রয়োজন ।
(১) মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা :- ভারতের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ বৃষ্টিপাত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে হলেও এই বৃষ্টিপাত অত্যন্ত অনিশ্চিত। কোনো বছর প্রচুর মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ফলে বন্যার সৃষ্টি হয় । আবার কোনো বছর মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হওয়ার জন্য খরা দেখা দেয় । মৌসুমি বৃষ্টিপাতের এই অনিশ্চয়তার জন্য ভারতের কৃষি জমিতে জলসেচের প্রয়োজন হয়।
(২) শীতকালীন বৃষ্টিপাতের অভাব :- দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বৈশিষ্ট্য অনুসারে শীতকালে তামিলনাড়ু উপকুল এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতের কোনও কোনও অংশ ছাড়া ভারতে বৃষ্টিপাত হয় না । সেই জন্য শীতকালীন রবিশস্য চাষের জন্য ভারতে জলসেচের প্রয়োজন হয় ।
(৩) বৃষ্টিপাতের অসম বন্টন :- ভারতের সর্বত্র মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সমান নয়, উত্তর-পশ্চিম ভারত ও দাক্ষিণাত্য মালভূমির মধ্যভাগে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কম হওয়ায় এই সব অঞ্চলে কৃষি কাজের জন্য জলসেচের প্রয়োজন হয় ।
(৪) উচ্চফলনশীল শস্যের চাষ :- বর্তমানে প্রচলিত নানান উচ্চফলনশীল শস্যের চাষ হয়। এই উচ্চফলনশীল শস্যের চাভে প্রচুর জলের প্রয়োজন হয়।
(৫) বহুফসলী চাষ – আজকাল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে একই জমিতে বহুবার ফসল ফলানো যায়। তাই বহুফসলি জমিতে সারাবছর সেচের জলের যোগান অপরিহার্য।
(৬) কৃষি জমির প্রয়োজন বৃদ্ধি – কৃষিজ দ্রব্যের চাহিদা পূরণের জন্য কৃষি যোগ্য জমির সম্প্রসারণের প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। এই সমস্ত জমিতে সারাবছর সেচের জলের যোগান রাখা অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
আমাদের দেশের কৃষকেরা দুই ধরণের উৎস থেকে সেচের জল ব্যবহার করে - ভূপৃষ্ঠে জমে থাকা জল ও ভূগর্ভস্থ জল ( কূপ, নলকূপ ইত্যাদি)। ভূপৃষ্ট জল বিভিন্ন ধরণের বড় ও ছোট জলাধার থেকে খালের মাধ্যমে বা নদী সেচ উত্তোলন বা ছোট জলাশয় ও পুকুরের জল সেচের মাধ্যমে ব্যবহার করা হয়। খালের সাহায্যে জলসেচ ব্যবস্থা সব সময় মাধ্যাকর্ষের উপর নির্ভরশীল কিন্তু জল উত্তোলন সেচ ব্যবস্থা সব সময় বৈদ্যুতিক শক্তি নির্ভর। পাতকুঁয়া, নলকূপ ও অগভীর খোঁড়া কূপের জল বিদ্যুৎচালিত বা ডিজেল চালিত ইঞ্জিনের সাহায্যে উত্তোলন করা যায়।
সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায়, নির্দিষ্ট পরিমানের জলসেচ প্রয়োগ করাই উন্নত সেচ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। যে সমস্ত চওড়া উন্মুক্ত খালের সাহায্যে আমরা জমিতে সেচ প্রয়োগ করি সেই পদ্ধতিতে গাছ তার প্রয়োজনীয় জল নির্দিষ্ট সময়ে গ্রহণ করতে পারেনা। তাই চিরাচরিত চওড়া খালের দ্বারা সেচ পদ্ধতি কোনো নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট শস্যে প্রয়োজনীয় জলের পরিমান মেটাতে পারেনা। এর কারণ গুলি নিম্নরূপ -
- খালবা অন্যান্য উপনালা বা ক্ষুদ্র নালাগুলির রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পলি, ঘাস বা অন্যান্য গাছ জন্মে এর গভীরতা ও রাস্তা পথ হারায়।
- পলিজমে নালা বিকৃত হয়ে যাওয়ার ফলে খালের ঢাল মজে যায়, এক্ষেত্রে কোনো খালের মধ্যে দিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী পরিমান জল বাহিত হয় আবার কোনো কোনো জায়গায় প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম পরিমান।
- মাটিরভেদ্য স্তরের পাশ দিয়ে কোনো খাল বাহিত হলে তা খনন করা যায়না।
- জলেরপ্রবেশ দ্বার ও বন্ধের দরজার ছিদ্র দিয়ে জলের অপচয় হয়।
- প্রধানপ্রবেশ পথে কোনো নিয়ন্ত্রণ দরজা থাকে না, ফলে ক্ষুদ্র নালাগুলির মধ্যে অসমান ভাবে জল প্রবাহিত হয়।
- নিয়ন্ত্রিত পরিকাঠামো ও কৃষকদের চাহিদা মতো নির্দিষ্ট পরিমান সেচব্যবস্থা না থাকার ফলে অতিরিক্ত জলসেচ প্রদান করা হয়।
শোচনীয় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা।
উপরোক্ত সমস্যাগুলির কারণেই নতুন উদ্ভাবনী সেচ পদ্ধতির ব্যবহার প্রয়োজন। সেচের দক্ষতা বৃদ্ধির সাথে উৎপাদন বাড়াতে আধুনিক সেচ ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।
এক্ষেত্রে বিশেষভাবে চিহ্নিত মধ্যাকর্ষের মাধ্যমে প্রবাহিত জল এবং পিভিসি পাইপের দ্বারা জলবন্টনের মাধ্যমে তা করা যেতে পারে এবং চিরাচরিত পদ্ধতির থেকে এক্ষেত্রে জলের অপচয় অনেক কম হবে।বন্যা সেচ পদ্ধতি বা চিরাচরিত মাধ্যকর্ষের মাধ্যমে জলের প্রবাহের পরিবর্তে গাছের শিকড় অঞ্চলে ক্ষুদ্র সেচের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় জলের যোগান দেওয়া হয়।
যেমন - স্প্রিংলার সেচ, ড্রিপ সেচ (বিন্দু সেচ ব্যবস্থা) বা উন্নত পরিকল্পনার মাধ্যমে শস্যের উৎপাদনের কোনোরূপ ক্ষতি না ঘটিয়ে জল সঞ্চয়ের জন্য কৃষক তা প্রতিস্থাপন করতে পারে। জলসেচের মূল লক্ষ্য হলো নির্দিষ্ট সময় ও পরিমানের জল নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী প্রয়োগ করা। যেহেতু ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে শস্যের জলের প্রয়োজনও পরিবর্তিত হয়, তাই জলসেচের সময়সূচি সেইভাবে নির্ধারণ করা প্রয়োজন। অপ্রয়োজনীয় ভাবে সারা বছরই চাষবাসের জন্য একটি জমিতে সেচ প্রয়োগ করা বা অতিরিক্ত সেচ গাছের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
স্প্রিংলার এবং ড্রিপ সেচব্যবস্থাকে সেচসেবিত কৃষির প্রধান জল সঞ্চয় কৌশল বলে বিবেচিত করা যায়। বর্তমানে সারা বিশ্বে ১৫% সেচ সেবিত এলাকার (৪৪ মিলিয়ন হেক্টর) ৩৫ মিলিয়ন হেক্টর স্প্রিংলার ও ৯ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা মাইক্রো সেচ ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত। বড় বা ছোট ফার্মের বিভিন্ন শস্য ও মাটির উপর নির্ভর করে বহু ধরণের স্প্রিংলার ও ড্রিপ সেচ ব্যবস্থার প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। স্প্রিংলার এবং ড্রিপ জলসেচ ব্যবস্থাই গুরুত্ত্বপূর্ণ জল সঞ্চয়ের কৌশল।
ঝর্ণা সেচ - যে সব মাটি সহজে ভেদ্য এবং কম জলধারণোক্ষম সেখানে ঝর্ণা সেচ ব্যবস্থাই আদর্শ। যে সব মাটির ঘনত্ব বেশী ও ভেদ্যতা কম সেই মাটিতে ঝর্ণা সেচ ব্যবস্থা খুবই আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। লবনাক্ত মাটিতে ঝর্ণা সেচ প্রয়োগের ফলে সহজে জলের ক্ষরণ ঘটে এবং শস্যের অঙ্কুরোদগমে সুবিধা হয়। তাজা সবজি ও ফল চাষের ক্ষেত্রে যেখানে শস্যের বর্ণ ও গুণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে - ঝর্ণা সেচ পদ্ধতি প্রয়োগে শস্য উৎপাদন বাড়ানো যায়। ঝর্ণার বহু ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এই যন্ত্রটি দিয়ে সেচ নিয়ন্ত্রণ, তরল সার, কীটনাশক, আগাছানাশক প্রভৃতি প্রয়োগের জন্য ব্যবহার করা যায়। বিশাল আধুনিক কৃষি কার্য্যে কোনো প্রকার দক্ষতা হ্রাস না ঘটিয়ে এই ঝর্ণা যন্ত্রটির ব্যবহার খুবই আর্থিক সহায়তা প্রদান করে। গাছের কোনো এক সংকটময় বৃদ্ধি দশায় খুব অল্প পরিমাণ সেচ, উৎপাদন বৃদ্ধি প্রায় দ্বিগুন করতে পারে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে প্রথাগত সেচের তুলনায় ঝর্ণা সেচের মাধ্যমে ১৬ - ৭০ শতাংশ জলের অপচয় বন্ধ করা যায় এবং বিভিন্ন কৃষি অঞ্চল অনুযায়ী ৩ - ৫৭ শতাংশ উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব।
প্রথাগত ভাবে ঝর্ণা সেচ পদ্ধতিটি খরচ সাপেক্ষ। তাই ভারতবর্ষের অর্থসামাজিক পরিবেশ ও প্রকৃতির উপর নির্ভর করে ব্যাপক ব্যবহারের জন্য এই পদ্ধতির কিছু পরিবর্তন খুবই প্রয়োজন।
মাধ্যাকর্ষের প্রভাবে মাটির ঢাল অনুযায়ী ঝর্ণা সেচ স্থাপিত করা হয় এবং জলবাহী মাথার সাহায্যে প্রাথমিক খরচ কমানো যায়।
তাছাড়া এই পদ্ধতি মেনে ছোট জলাশয় ও ভূপৃষ্ট প্রবাহ সেচের অসুবিধা আছে এরূপ জায়গাগুলিতে ভালোভাবে সেচ দেওয়া যায়।
উন্নত মানের সবজি ও ফলের চাষে ঝর্ণা পদ্ধতিতে সেচ প্রয়োগ করা যেতে পারে, কারণ যেখানে জলের অভাব আছে বা জলের ব্যবহার খুব খরচ সাপেক্ষ বা মাটি সমস্যা জনিত সেখানে ঝর্ণা সেচ খুবই উপকারী।
রুনা নাথ (runa@krishijagran.com)
কৃষি জাগরণ।
Share your comments