পান, যার বৈজ্ঞানিক পরিচিতি পাইপার বিটল, এক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস | দৈনন্দিন জীবনেই হোক বা পুজোর কাজে পান পাতা ব্যবহার করা হয় | ভারতবর্ষে পানের উৎপাদনের দুই-তৃতীয়াংশ হয় পশ্চিবঙ্গে। এ ছাড়াও, ওড়িশা, অসম, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ু রাজ্যে পানের চাষ হয়। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৯০০০ হাজার হেক্টর এলাকায় পানের চাষ হয়।
পান চাষ (Betel Leaf farming) পদ্ধতি এক বিশেষ রকমের যা ‘বরজ নামে পরিচিত। এই বরজ হল ভালো ভাবে ঘেরা ও উপরে ছাউনি দেওয়া বিশেষ ভাবে প্রস্তুত একটি ঘর। আর এই ছায়া ঘন পরিবেশের মধ্যে পানের চাষ যথেষ্ট সংখ্যায় ও উপযুক্ত মানের হয়। আর এ কারণেই ওই বিশেষ ধরনের ঘর বরজ -এ পান চাষ করাই সাধারণ রেওয়াজ। তবে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলা সহ অসম, উত্তর-পূর্ব ভারতে সাধারণ ভাবে সুপারি গাছকে অবলম্বন করে ছায়ায় বরজ ছাড়াই পান চাষ করা হয়। এই সকল অঞ্চলে বছরের বেশির ভাগ সময়ই বৃষ্টিপাত হয়। ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি ও বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণও বেশি থাকে। যে কারণেই এই গাছে পান চাষের পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় | এছাড়াও, বরজ চারা বর্তমানে শেড নেট পদ্ধতিতে পান চাষ করে কৃষকবন্ধুরা ভালো উপার্জন করেন |
মাটি ও জলবায়ু(Soil and climate):
সাধারণত যে কোনও মাটিতেই পান চাষ হতে পারে। তবে উঁচু অবস্থানের জলনিকাশিযু্ক্ত দোঁয়াশ বা এঁটেল-দোঁয়াশ মাটি পান চাষের উপযুক্ত। আর জমির পি এইচ ৬.৫ – ৭.৫-এর মধ্যে থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে সেচের সু-ব্যবস্থা আছে এমন বেলে বা দোঁয়াশ মাটিতেও পান চাষ করা যেতে পারে। তবে নোনা বা ক্ষার জাতীয় মাটি পান চাষের অনুপযুক্ত। ছায়াযুক্ত আর্দ্র বা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া ও রসযুক্ত মাটি পান চাষের উপযুক্ত। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৫০০ – ১৭৫০ মিলি এবং তাপমাত্রা ১০০ – ৪০০ সেলসিয়াস এই ফসলের জন্য প্রয়োজন।
সাধারণ ভাবে একটি পান-বরজ থেকে ৮ – ১০ বছর ধরে পানের ভালো ফলন পাওয়া যায়। যদি না প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কোনও কারণে বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মিঠা পানের জন্য দোঁয়াশ মাটি আর বাংলা ও সাঁচি পানের জন্য এঁটেল-দোঁয়াশ মাটিই সর্বোৎকৃষ্ট। পানের গুণগত মান ও ফলন দুই-ই মাটির তারতম্যের উপর অনেকটাই নির্ভরশীল।
জাত:
সাধারণত নানা জাতের পান দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে ঢলপান বা বাংলাপান, মিঠাপান, ছাঁচিপান, লালিপান, কর্পূরীপান, গাছপান ইত্যাদি। সব থেকে বেশি বাংলাপান জাতের চাষ হয় |
আরও পড়ুন -Cashew Farming: অধিক লাভে জুলাইয়ে রোপণ করুন কাজুর চারা
চাষের সময়:
আষাঢ় ও আশ্বিন–কার্তিক মাস উপযুক্ত। তবে আশ্বিন–কার্তিক মাসে লাগালে ফলন ভালো পাওয়া যায়। এক একটি গাছাতে ৮০ – ৯০টি এক গাঁট যুক্ত কাটিং বা খাদির প্রয়োজন হয় অর্থাৎ কাঠা প্রতি ৮০০ – ৯০০ বা বিঘা প্রতি অর্থাৎ ০.৩৩ শতকে ১৬০০০ – ১৮০০০ টি কাটিং এর প্রয়োজন।
লতা শোধন পদ্ধতি:
সতেজ, রোগমুক্ত ৪-৫ বছর পুরনো বরজ থেকে লতা সংগ্রহ করতে হবে। লতার গোড়ার দিকের এক হাত/দেড় হাত বাদ দিয়ে গাঁট বীজ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। লতা সংগ্রহের আগে সেই বরজে ১০–১৫ দিনের ব্যবধানে কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকঘটিত রাসায়নিক ওষুধ ৪ গ্রাম প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে ২ বার স্প্রে করতে হবে। এর পর লতা সংগ্রহের ৫–৬ দিন আগে গাছের ডগা ২–৩ সেমি ভেঙে দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এর পর জীবাণুমুক্ত কাটার যন্ত্র দিয়ে লতা কেটে এমিসান ৬ রাসায়নিক ওষুধ ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলমিশ্রিত দ্রবণে সেই সব লতা ১০ মিনিট ভিজিয়ে ছায়ায় শুকিয়ে নিয়ে লাগাতে হবে।
লতা লাগানোর দূরত্ব:
সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ – ৬০ সেমি এবং প্রতি সারিতে ২ টি লতার মধ্যে ১০ – ১৫ সেমি দূরত্ব রাখতে হবে। লতা লাগানোর সময় সারির মাটিতে কপার অক্সিক্লোরাইড দ্রবণ (৪ গ্রাম / লিটার জল) দ্বারা ভিজিয়ে দিতে হবে।
বরজ তৈরি:
নির্বাচিত জমির মাটি ভালো ভাবে লাঙল দিয়ে তার পর ভিজিয়ে দিতে হবে। এর পর চৈত্র – বৈশাখ মাসে ওই কর্ষিত জমি ১ মাস ধরে রৌদ্র খাওয়াতে হবে। এ জন্য সাদা পলিথিন চাদরে জমি ঢেকে দিতে হবে। সপ্তাহের এক দিন বিকেলে পলিথিন চাদর খুলে জমিতে অল্প জল ছিটিয়ে আবার ঢেকে দিতে হবে। এর পর ৬০ মিলি ফরম্যালিন ১০ লিটার জলে গুলে প্রতি বর্গমিটার জমিতে প্রয়োগ করে পলিথিন চাদরে আরও ৪ – ৫ দিন ঢেকে রাখতে হবে। এর ২৫ – ৩০ দিন পর ওই জমিতে লতা লাগাতে হবে।বরজের উচ্চতা ২ মিটারের বেশি হওয়া উচিত নয়। এ ছাড়া বর্ষাকালে ছাউনি পাতলা করতে হবে |
সার প্রয়োগ(Fertilizer):
পানের জমিতে প্রতি বছর হেক্টর প্রতি ৩০-৫০ কুইন্টাল গোবর সার প্রয়োগ করতে হয়। চারা ৫/৬ পাতাওয়ালা হলেই পচা খোল জাতীয় সার প্রয়োগ করলে গাছ সতেজ হয়ে ওঠে। হেক্টর প্রতি ১০০ কেজি ইউরিয়া ৩ বারে জমিতে প্রয়োগ করতে হয়। উক্ত সারের সাথে ৫০ কেজি টিএসপি ও ৫০ কেজি পটাশ সার মিশ্রিত করে প্রয়োগ করতে হয়। উক্ত সার ৩ বারে সারির উভয় পার্শ্বে ২-১ ইঞ্চি গভীরতায় প্রয়োগ করতে হয়।
পান তোলা:
সঠিকভাবে যত্ন ও পরিচর্যা করলে চারা লাগানোর ৬ মাস পর হতে পান তোলা যেতে পারে। প্রতিটি গাছ থেকে বছরে তিন/চার এমনকি ৫ বারও পান তোলা যায়।
নিবন্ধ: রায়না ঘোষ
আরও পড়ুন -Wetland Farming: জলাভূমিতে কৃষিকাজ ও তার গুরুত্ব