কলার বৈজ্ঞানিক নাম মুসা একুমিনাটা। ইহা একটি সুস্বাদু সহজলভ্য ও পুষ্টিকর ফল।এর ফলন অন্যান্য ফল ও ফসল অপেক্ষা অনেক বেশি। কলা মূলত ক্যালরি সমৃদ্ধ ফল। এছাড়াও এতে ভিটামিন এ, বি-৬ ও সি এবং ফসফরাস, লৌহ ও ক্যালসিয়াম রয়েছে।
প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যোপযোগী পাকা কলায় ৬২.৭ গ্রাম জলীয় অংশ, ০.৯ গ্রাম খনিজ, ০.৪ গ্রাম আঁশ, ৭.০ গ্রাম আমিষ, ০.৮ গ্রাম চর্বি, ২৫.০ গ্রাম শর্করা, ১৩.০ মি.গ্রা. ক্যালসিয়াম, ০.৯ মি.গ্রা. লৌহ, ০.১ মি.গ্রা. ভিটামিন বি-১, ০.০৫ মি.গ্রা. ভিটামিন বি-২, ২৪ মি.গ্রা. ভিটামিন সি ও ১০৯ কিলোক্যালরী খাদ্যশক্তি রয়েছে। কাঁচা কলা ডায়রিয়ায় ও পাকা কলা কোষ্ঠকাঠিন্যতা দূরীকরণে ব্যবহার করা হয়। কলার থোর/মোচা এবং শিকর ডায়াবেটিস, আমাশয়, আলসার ও পেটের পীড়া নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।
কলার জাতসমূহ ও তার বৈশিষ্ট্য (New Variety) :
সম্পূর্ণ বীজমুক্ত কলা: যেমন-সবরি, অমৃতসাগর, অগ্নিশ্বর, দুধসর, দুধসাগর প্রভৃতি ।
দু-একটি বীজযুক্ত কলা: যেমন-চাম্পা, চিনিচাম্পা, কবরী, চন্দন কবরী, জাবকাঠালী ইত্যাদি ।
বীজযুক্ত কলা: এটেকলা যেমন-বতুর আইটা, গোমা, সাংগী আইটা ইত্যাদি ।
আনাজী কলাসমুহ: যেমন-ভেড়ার ভোগ, চোয়াল পউশ, বর ভাগনে, বেহুলা, মন্দিরা, বিয়েরবাতি প্রভৃতি।
টিস্যুকালচার চারা ব্যবহারের সুবিধাদি (Tissue Culture Method) :
১. চারা তাড়াতাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয় ও চারার মৃত্যুহার কম এবং সব চারার বৃদ্ধি সমান হয়
২. সব গাছের ফুল প্রায় একই সাথে আসে এবং সব গাছের ফল প্রায় একই সাথে আহরণ হয়
৩.ফল পেতে সময় কম লাগে ও ফলন বেশি হয়
৪.চারা রোগমুক্ত থাকে ফলে রোগ ব্যবস্থাপনা কম নিতে হয় ও শ্রমিক খরচ কম লাগে
মাটি ও জলবায়ুঃ
পর্যাপ্ত রোদযুক্ত ও পানি নিকাশের সুব্যবস্থাসম্পন্ন উর্ববর দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ মাটি কলা চাষের জন্য উত্তম। গাছের বৃদ্ধি এবং উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী তাপমাত্রা ১৫-৩৫০সে.। তাপমাত্রা ১৩০সে. এর নীচে কলায় শৈত্যাঘাত দেখা যায়। প্রতি মাসে গড়ে ১২০ সেমি বৃষ্টিপাত কলা চাষের জন্য অনুকুল। শুষ্ক আবহাওয়া বা দীর্ঘকালীন খরা, শিলাবৃষ্টি, ঝড়, সাইক্লোন ও বন্যা কলা চাষের অন্তরায়।
চারা নির্বাচনঃ
বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদের জন্য টিস্যুকালচার চারা নির্বাচন করাই উত্তম। তবে টিস্যুকালচার চারা না পাওয়া গেলে অসি তেউড় লাগাতে হবে। তিন-চার মাস বয়স্ক সুস্থ্য সবল অসি তেউড় রোগমুক্ত বাগান থেকে সংগ্রহ করা উচিৎ। সাধারণত বেটে জাতের গাছের ৩৫-৪৫ সে.মি. এবং লম্বা জাতের ৫০-৬০ সে.মি. দৈর্ঘ্যরে ১.৫-২.০ কেজি ওজনের চারা লাগানো হয়।
জমি তৈরি, গর্ত খনন ও চারা রোপণঃ
জমি ভালোভাবে চাষ করে ১.৫-২.০ মিটার দূরে দূরে ৪৫ সে.মি.দ্ধ ৪৫ সে.মি. দ্ধ ৪৫ সে.মি. আকারের গর্ত খনন করতে হয়। চারা রোপণের ১৫-২০ দিন আগেই গর্তে গোবর সার ও টিএসপি মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত বন্ধ করে রাখতে হবে। চারা রোপণের পর পানি দিয়ে জমি ভালোভাবে ভিজিয়ে দিতে হয়।
রোপণের সময়ঃ
বছরের যে কোন সময়েই কলার চারা রোপণ করা যায়। তবে অতিরিক্ত বর্ষা ও অতিরিক্ত শীতের সময় চারা না লাগানোই উত্তম। বর্ষার শেষে আশ্বিন-কার্তিক মাস চারা রোপণের সর্বোত্তম সময়। এসময় মাটিতে যথেষ্ট রস থাকে, ফলে সেচের প্রয়োজন হয় না। এ সময়ে রোপিত চারার ফলন সবচেয়ে বেশি। কলার চারা রোপণের দ্বিতীয় সর্বোত্তম সময় হলো মাঘ মাস। এ সময় চারা রোপণের জন্য পানি সেচ অত্যাবশ্যক।
সারের পরিমাC
মধ্যম উর্বর জমির জন্য গাছ প্রতি গোবর/আবর্জনা পঁচাসার ১০ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি ৬০০ গ্রাম, জিপসাম ২০০ গ্রাম, জিঙ্ক অক্রাাইড ১.৫ গ্রাম ও বরিক এসিড ২ গ্রাম প্রয়োগ করতে হবে। উল্লিখিত পরিমাণের সম্পূর্ণ গোবর, টিএসপি, জিপসাম, জিঙ্কঅক্সাইড ও বরিক এসিড এবং অর্ধেক এমওপি সার গর্ত তৈরির সময় গর্তে দিতে হয়। ইউরিয়া ও বাকী অর্ধেক এমওপি চারা রোপণের ২ মাস পর থেকে ২ মাস পর পর ৩ বারে এবং ফুল আসার পর আরও একবার গাছের চর্তুদিকে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হয়। সার দেয়ার সময় জমি হালকাভাবে কোপাতে হবে যাতে শিকড় কেটে না যায়। জমির আর্দ্রতা কম থাকলে সার দেয়ার পর পানি সেচ দেয়া একান্ত প্রয়োজন।
পানি সেচ ও নিকাশঃ
শুষ্ক মৌসুমে ১০-১৫ দিন পর পর জমিতে সেচ দেয়া দরকার। আবার বর্ষার সময় বাগানে যাতে পানি জমতে না পারে, তার জন্য নালা করে অতিরিক্ত পানি নিকাশের ব্যবস্থা করতে হয়।
সাকার বা চারা ছাঁটাইঃ
কলার কাদি বের হওয়ার পূর্ব পর্যšত গাছের গোড়ায় কোন চারা রাখা উচিত নয়। কাদি সম্পূর্ণ বের হওয়ার পর মুড়ি ফসলের জন্য গাছপ্রতি মাত্র একটি চারা রেখে বাকি চারাগুলো মাটির সমতলে কেটে ফেলতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যাঃ
সময়মত বেড়া নির্মাণ, আগাছা দমন, ঠেস দেয়া, অপ্রয়োজনীয় পাতা পরিষ্কার, গোড়ায় মাটি দেয়া, মোচা অপসারণ, কাঁদি ঢেকে দেয়া ইত্যাদি কাজ করা দরকার।
আন্তঃ ফসলের চাষঃ
আশ্বিন-কার্তিক মাসে রোপন করা চারার ৩-৪ মাস তেমন বৃদ্ধি না হওয়ায় দুই-তৃতীয়াংশ জায়গা পতিত থাকে। তখন কলা বাগানে কলা চাষ না করে আন্তঃ ফসল হিসেবে শীতকালীন শ্বাক-সবজী, পেঁয়াজ, আলু, মুলা, গাজর, ধনিয়া, মসুর, সরিষা ইত্যাদি চাষ করে বাড়তি কিছু আয় করা যায়। আন্তঃ ফসলের চাষ করতে হলে অতিরিক্ত কিছু সারও প্রয়োগ করতে হবে যাতে কলা ফসলের খাদ্যের ঘাটতি না হয়।
মুড়ি ফসলঃ
প্রথম ফসলের চেয়ে মুড়ি ফসলের ফলন বেশি। তাছাড়া মুড়ি ফসলের উৎপাদন খরচ কম এবং ফসলও একমাস আগে পাওয়া যায়। তিন বছরের বেশি কোন মুড়ি ফসল রাখা ঠিক নয়। কারণ ফলন কমে যায় এবং রোগবালাই এর আক্রমণ বেশি হয়। ফল সংগ্রহের সময় প্রথম ফসলের কলা গাছটিকে মাটির প্রায় ১ মিটার উপর কাটতে হয়। তারপর নির্বাচিত চারা ব্যতীত অন্য সব চারাসহ মাতৃগাছের গুঁড়ি বা মোথা তুলে ফেলে ঐ স্থান সার মিশানো মাটি দ্বারা ভরাট করে দিতে হয়। অন্যান্য পরিচর্যা সাধারণ কলা বাগানের মতই করতে হয়।
শস্য আর্বতনঃ
কলা মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করে ফলে একই জমিতে মুড়ি ফসলসহ চার বারের বেশি কলা চাষ করলে জমি উর্বরতা নষ্ট হয়। ফলে ফলন কমে যায় এবং মাটির স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। এজন্যে পরপর চার বারের বেশি কলার চাষ করা উচিত নয়। কলা গাছ উঠিয়ে ফেলে অন্য ফসল যেমন শাক-সবজি ও অন্যান্য ফলের চাষ করলে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং অন্য ফসল ভালো হয়।
প্রতিকারঃ
সম্পূর্ন পরিপক্ক হত্তয়ার পূর্বে কলা সংগ্রহ করতে হবে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এবং ফেব্রুয়ারি মাসে চারা রোপণ করতে হবে যাতে প্রচন্ড শীত বা নিম্ন তাপমাত্রা পরিহার করে পরিপক্ক কলা সংগ্রহ করা যায়। নিয়মিত সেচ প্রয়োগ করতে হবে।
আরও পড়ুন - ফলের মাছি - সমস্যা ও প্রতিকার, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কীট দমন
কলা সংগ্রহঃ
ঋতু ভেদে রোপণের ১০-১৩ মাসের মধ্যেই সাধারণত সব জাতের কলাই পরিপক্ক হয়ে থাকে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করলে কলার গাঁয়ের শিরাগুলো তিন-চতুর্থাংশ পুরো হলেই কাটতে হয়। তাছাড়াও কলার অগ্রভাগের পুষ্পাংশ শুকিয়ে গেলেই বুঝতে হবে কলা পুষ্ট হয়েছে। সাধারণত মোচা আসার পর ফল পুষ্ট হতে ২-৪ মাস সময় লাগে। কলা কাটানোর পর কাঁদি শক্ত জায়গায় বা মাটিতে রাখলে কলার গায়ে কালো দাগ পড়ে এবং কলা পাকার সময় দাগওয়ালা অংশ তাড়াতাড়ি পচে যায়।
আরও পড়ুন - লাউয়ের বিভিন্ন পোকামাকড় দমন ও রোগ প্রতিরোধের পদ্ধতি