‘৩ জি কাটিং’ প্রধানত এটি কুমড়োগোত্রীয় ফসলের (Pumpkin Crop) ফলন বৃদ্ধির সহজতম পন্থা। সবচেয়ে বড় কথা হল, একজন কৃষকবন্ধু বিনা কোন খরচেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে সাধারণ অবস্থার তুলনায় ১০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত অধিক ফলন আশা করতে পারেন।
কি এই ‘৩ জি কাটিং’ (3G Cutting) –
‘৩ জি’ (3G) কথাটির ইংরাজিতে আক্ষরিক অর্থ হল ‘Third Generation’, যার বাংলা মানে করলে দাঁড়ায় ‘তৃতীয় প্রজন্ম’। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে কীসের ‘তৃতীয় প্রজন্ম’? সহজ উত্তর হল গাছের শাখা প্রশাখার। বিষয়টি একটু পরিষ্কার করে বোঝা দরকার। বীজের অঙ্কুরোদগমের পর, যে কোন গাছের যে প্রাথমিক শাখাটির (Primary branches) জন্ম হয় এবং বৃদ্ধি ও বিকাশ চলতে থাকে, তাকে ‘১ জি’ (First Generation) অর্থাৎ প্রথম প্রজন্মের বা প্রথম বর্গীয় শাখা বলা হয়। প্রাথমিক শাখা থেকে পরবর্তীতে ‘২ জি’ (Second Generation) অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রজন্মের শাখা প্রশাখা (Secondary branches) ও ২ জি শাখা প্রশাখা থেকে ‘৩ জি (Third Generation) অর্থাৎ তৃতীয় বর্গীয় (Tertiary branches) শাখা প্রশাখার জন্ম হয়।
কুমড়োগোত্রীয় সবজী ফসল চাষের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা হল এই ‘৩ জি’ কাটিং।
কেন করব এই ‘৩ জি’ কাটিং -
ক) বীজের অঙ্কুরোদগমের পর প্রাথমিক/ প্রধান শাখাটির উচ্চতা ভূমি থেকে ৫-৬ ফুট (শসা ও কুমড়ো) অথবা ৭-৮ ফুট (লাউ, চালকুমড়ো,উচ্ছে, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গে, ধুন্দুল) হলে তার অগ্রস্থ বা শীর্ষস্থ অংশের ছাঁটাই করে দিতে হবে।
খ) এর ফলে খুব স্বভাবতই অগ্র প্রকটতা (Apical dominance) বাধাপ্রাপ্ত হবে ও দ্বিতীয় বর্গীয় প্রশাখাগুলি প্রাথমিক শাখা থেকে জন্ম নেবে।
গ) এরপর দ্বিতীয় বর্গের প্রশাখাগুলি ২-৩ ফুট অবধি লম্বা হলে ঠিক আগের মত এক্ষেত্রেও সেগুলির অগ্রভাগ ছাঁটাই করে দিতে হবে।
ঘ) কিছুদিন পর দ্বিতীয় বর্গের প্রশাখাগুলি থেকে ৩ জি বা তৃতীয় বর্গের প্রশাখাগুলি জন্ম নেবে। সর্বাধিক সংখ্যায় এই ধরণের প্রশাখাগুলিকে একটি গাছে বাড়তে দেওয়া উচিত। সঠিক সময়ে ও সঠিক মাত্রায় যদি পরিপোষকের যোগান দেওয়া যায়, তাহলে সে ক্ষেত্রে অধিক মাত্রায় স্ত্রী ফুল পাওয়া সম্ভব ও ফলন বৃদ্ধি সম্ভব।
‘৩ জি’ কাটিং করার সময় আমাদের যে বিশেষ দিকগুলিতে নজর দেওয়া প্রয়োজন, সেগুলি হল-
ক) বীজের অঙ্কুরোদগমের পর ও প্রাথমিক শাখার বৃদ্ধির পাঁচ-পাতা দশা (5 leaf stage) অবধি কোনরকম ‘২ জি’ পার্শ্ব শাখার (Side shoot) উৎপত্তি হলে, তা অতি অবশ্যই পুরোটাই কেটে বাদ দিতে হবে।
খ) প্রাথমিক শাখার অগ্রভাগ ছাঁটাই এর জন্য গাছের উচ্চতা ন্যূনতম ৬-৮ ফুট (ফসল ভেদে) ও বয়স ২০-২৫ দিন হওয়া বাঞ্ছনীয়।
গ) ‘২ জি’ প্রশাখার অগ্রভাগ ছাঁটাই-এর আগে খেয়াল রাখা দরকার সেটি যেন ন্যূনতম ১২ টি পাতা বিশিষ্ট হয়।
ঘ) এই পদ্ধতি অনুসরণের পূর্বে দেখে নিতে হবে যেন মাটিতে পর্যাপ্ত রস থাকে ও গাছ পর্যাপ্ত সূর্যালোক পায়।
ঙ) খেয়াল রাখতে হবে, যেন গাছ খুব বেশী ঝাঁকালো না হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে গাছের অভ্যন্তর ভাগ পর্যন্ত সূর্যের আলো সঠিকভাবে পৌঁছতে পারবে না।
চ) তৃতীয় বর্গীয় প্রশাখাগুলি থেকে যাতে চতুর্থ প্রজন্মের প্রশাখার জন্ম না হয়, সেদিকে সদা সচেতন থাকা উচিৎ।
ছ) ছাঁটাই অবশ্যই নতুন ও পরিষ্কার ব্লেড দিয়ে করা উচিৎ। এক্ষেত্রে পরিষ্কার হাত বা আঙ্গুলের ব্যবহারও করা যেতে পারে।
‘৩ জি’ কাটিং –এর উপকারিতা (Advantages) –
ক) এই গোত্রীয় ফসলের প্রাথমিক শাখার ৭০-৮০ শতাংশ পুরুষ ফুল ও ২০ শতাংশ স্ত্রী ফুল জন্মায়। দ্বিতীয় বর্গের শাখায় হয় ৫০ শতাংশ পুরুষ ফুল। কিন্তু তৃতীয় বর্গীয় শাখায় পুরুষ ফুল কমে গিয়ে দাঁড়ায় ১০-১৫ শতাংশে ও স্ত্রী ফুলের সংখ্যা হয় ৮০-৮৫ শতাংশ। তৃতীয় প্রজন্মের প্রশাখাগুলিতে স্ত্রী ফুলের বহুল আধিক্যের কারণে গাছ প্রতি ফলন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়।
খ) ফলের আকার ও আকৃতি (Size & Shape) অনেক বেশী ভালো হয়।
গ) যেগেতু ‘১ জি’ ও ‘২ জি’ শাখা প্রশাখাগুলিতে পুরুষ ফুলের আধিক্য থাকে, তাই তৃতীয় বর্গীয় প্রশাখাগুলিতে স্ত্রী ফুলের পরাগায়ন সুনিশ্চিত হয়।
ঘ) ফলন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে কৃষকবন্ধুরা অনেক বেশী লাভবান হন।
ঙ) একটি গাছ থেকে দীর্ঘমেয়াদী ফলন (Prolonged fruiting) পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন - জানুন উন্নত জাতের হলুদের বৈশিষ্ট্য ও তার চাষের পদ্ধতি
অনেক ক্ষেত্রে কৃষকবন্ধুরা একটি ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে থাকেন যে, যে কোন শস্য জাতীয় ফসল (Agronomic crop) চাষের তুলনায় সবজীর চাষ অনেক বেশী কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, বিভিন্ন ছোটখাট ও সহজ কিন্তু লাভজনক কৌশল ব্যবহার করে চাষবাস করতে পারলে সবজী ফসল থেকে মুনাফা কিন্তু শস্য ফসলের তুলনায় অনেক বেশী। ঠিক তেমনই একটি কৌশল হল কুমড়োগোত্রীয় ফসলের ক্ষেত্রে ‘৩ জি’ কাটিং। তাই যে সমস্ত কৃষক বন্ধুরা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে এই সব সবজীর চাষ করে থাকেন বা যারা আগামী তে করবেন বলে চিন্তাভাবনা করছেন, তাদের অতি অবশ্যই এই পদ্ধতির অবলম্বন করা উচিৎ। এতে করে অনেক বেশী লাভবান হওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুন - সুস্থায়ী পদ্ধতিতে ফসলের সাদা মাছি নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি