লিচু একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পুষ্টিকর ফল। রূপে, গুণে ও স্বাদে এটি একটি উপাদেয় ফল বিধায় অনেকে বিশ্বের সবচেয়ে লোভনীয় ও সুস্বাদু ফল বলে মনে করেন। এতে ঔষধি গুণ ছাড়াও প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ, শর্করা জাতীয় পদার্থ ও ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে।
বাজারে অল্প সময়ের জন্য থাকলেও সবার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ফল হিসেবে পরিচিত। দেশে বাণিজ্যিকভাবে লিচু চাষ হচ্ছে (Litchi Cultivation) ব্যাপকভাবে | লিচু চাষ করে কৃষকরাও আর্থিক দিক থেকে লাভবান হচ্ছেন |
মাটি (Soil):
প্রচুর জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ নিষ্কাশিত গভীর উর্বর দো-আঁশ মাটি লিচু চাষের জন্য বেশি উপযোগী। সাধারণত, লিচু স্যাঁতসেঁতে মাটি পছন্দ করে। সাধারণত মাটির পিএইচমান ৬.৫-৬.৮ হলে লিচু চাষ উপযোগী হয়। তবে বেলেমাটি লিচু চাষের অনুপযুক্ত। নতুন চারার গোড়ায় পুরনো লিচু গাছের নিচের কিছু মাটি প্রয়োগ করে দ্রুত মাইকোরাইজা সৃষ্টি হয়।
জলবায়ু (Climate):
লিচু একটি অবউষ্ণ জলবায়ুর ফল। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে গাছ ভালোভাবে বাড়লেও ফুল ধারণের জন্য মৃদু ঠাণ্ডার পরিবেশ দরকার। এবং গ্রীষ্মকালে উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় লিচু ভালো হয়। শীতকালে তুষারপাত ও গ্রীষ্মকালে উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়া লিচু চাষের প্রধান অন্তরায়। বার্ষিক বৃষ্টিপাত ১৫০ সেমি. ও বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৭০-৮৫% লিচু চাষের জন্য উপযোগী। গাছে ফুল আসার সময় বৃষ্টিপাত হলে পরাগায়ন ব্যাহত হয়। গ্রীষ্মকালে পর্যায়ক্রমে শুষ্ক আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাত হলে ফল ফেটে যায় ও ঝরে পড়ে। পাকার সময় আবহাওয়া শুষ্ক হলেও ফল ফেটে যায়।
জমি তৈরী:
লিচু চাষের জন্য নির্বাচিত জমি ভালো করে লাঙল, কিংবা ট্রাক্টর যে কোনোটির দ্বারা চাষ ও পরে মই দিয়ে জমি সমতল ও আগাছা মুক্ত করে নিতে হবে। জমি থেকে ইট, পাথর, অন্য কোনো গাছের গোড়া ইত্যাদি যদি থাকে তবে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। জমি চাষের ফলে মাটিতে প্রচুর বায়ু চলাচল হয়। ফলে মাটিতে বিদ্যমান পুষ্টি গাছের জন্য সহজলভ্য হয়। তাছাড়া শিকড় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
চারা রোপণের সময়:
বর্ষাকাল চারা লাগানোর উপযুক্ত সময় অর্থাৎ জুন-জুলাই মাস। তবে চারা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত লাগানো চলে। প্রখর রোদ ও হাওয়ায় চারা লাগানো যাবে না। বিকেলে চারা লাগানো বেশ ফলদায়ক |
রোপণের দূরত্ব:
ঘন করে লিচুর চারা লাগানো হলে সেসব গাছে সূর্যের আলো পায় না। ফলে গাছে খাদ্য প্রস্তুত ভালোভাবে হয় না। গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। তাছাড়া রোগ-পোকামাকড়ের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। কিন্তু গাছের জন্য অনুমোদিত দূরত্ব অনুরসণ করলে উপরিউক্ত সমস্যা থাকে না। লিচুগাছ সাধারণত ১০-১২ মিটার (অর্থাৎ ৩০-৪০ ফুট) দূরত্বে লাগানো হয়।
রোপণ পদ্ধতি:
বর্ষার আগেই নির্বাচিত জায়গায় জমিতে গর্ত করতে হবে। গর্তের দৈর্ঘ্য ১ মিটার, প্রস্থ ১ মিটার ও গভীরতা ১ মিটার রাখতে হবে। গর্ত তৈরির সময় গর্তের ওপরের মাটি এক পাশে ও নিচের অংশের মাটি অন্য এক পাশে রেখে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। ফলে মাটিতে কীট বা রোগের জীবাণু থাকলে রোদে তা মারা যাবে। গর্তের ওপরের অংশের মাটির সাথে ২০-২৫ কেজি গোবর সার, কিছুটা পুরনো লিচু বাগানের মাটি, টিএসপি ৬০০-৭০০ গ্রাম, এমপি ৩৫০-৪৫০ গ্রাম, জিপসাম ২০০ -৩০০ গ্রাম, জিঙ্ক সালফেট ৪০-৬০ গ্রাম মিশিয়ে দিতে হবে এবং ওপরের এই সার মিশ্রিত মাটি গর্তের নিচে এবং গর্তের নিজের মাটি গর্তের ওপরে দিয়ে পুরো গর্তটি ভরাট করতে হবে। প্রতি বছর সারের পরিমাণ কছুটা বাড়িয়ে দিতে হবে। গাছের বয়স ১০-১৫ বছর হলে সারের মাত্রা দ্বিগুণ করতে হবে।
সার প্রয়োগ:
১ থেকে ৩ বছর বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ১০-২০ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি ১৫০-২০০ গ্রাম।
৪-৬ বছর বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ২০-৩০ কেজি, ইউরিয়া ৬০০ গ্রাম, টিএসপি ৫০০ গ্রাম, এমওপি ২৫০-৩০০ গ্রাম।
৭-১০ বছর বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ৩০-৪৫ কেজি, ইউরিয়া ৭৫০ গ্রাম, টিএসপি৭০০ গ্রাম, এমওপি ৫০০ গ্রাম।
১০ বছরের বেশি বয়সী গাছের জন্য গাছপ্রতি জৈবসার ৫০-৬০ কেজি, ইউরিয়া ১০০০ গ্রাম, টিএসপি ৭৫০ গ্রাম, এমওপি ৬০০ গ্রাম।
রোগবালাই ও দমন (Disease management system):
মাইট বা মাকড় :
মাকড়সা জাতীয় এ পোকা আকারে খুবই ছোট এবং এরা পাতায় আক্রমণ করে। আক্রান্ত পাতায় লালচে বাদামি দাগ সৃষ্টি হয়। ফলে গাছ বাড়ে না ও ফলন কম হয়। প্রতিকার হিসেবে আক্রান্ত ডালপালা বা ডগা ছাঁটাই করতে হবে। প্রতি ১০ লিটার জলে ২০ গ্রাম থিয়োভিট মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। তা ছাড়া মাইট যাতে গাছে উঠতে না পারে সে জন্য কাণ্ডের বা গোড়ার চারপাশে আলকাতরা লাগানো যেতে পারে।
ফল ছিদ্রকারী পোকা :
ফল পাকার সময় পোকা ফলের বোঁটার কাছে ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে এবং বীজকে আক্রমণ করে। ফল পাকার সময় বৃষ্টি হলে এ পোকা বেশি দেখা যায়। এরা ছিদ্রের মুখে বাদামি রঙের এক প্রকার করাতের গুঁড়ার মতো মিহি গুঁড়া উৎপন্ন করে। এতে ফল নষ্ট হয় ও ফলের বাজার মূল্য কমে যায়। ফলের গুটি ধরার পর ১৫ দিন পর পর ২ বার সিমবুশ ১ মিলি হারে প্রতি লিটার জলের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। রোগ ছাড়াও লিচুর আর একটি সমস্যা হলো বাদুড়। রাতে ও দিনে টিন পিটিয়ে যথাক্রমে বাদুড়ের এবং পাখি (যেমন কাক ও অন্যান্য পাখি ইত্যাদির উপদ্রব কমানো যায়। তা ছাড়া জাল দিয়েও লিচু রক্ষা করা যায়।
আরও পড়ুন - Kharif Crop - আগত খারিফ মরসুমে পেঁয়াজ চাষে বিভিন্ন রোগের প্রতিকার করবেন কীভাবে?
ফসল সংগ্রহ:
২০-৩০ বছর বয়স পর্যন্ত লিচুগাছে ফলন বাড়তে থাকে। সাধারণত প্রতিটি গাছ থেকে বছরে ৮০-১৫০ কেজি বা ৩২০০-৬০০০টি লিচু পাওয়া যায়। যা কৃষকবন্ধুরা বাজারে বিক্রি করে ভালো লাভ পেতে পারেন |
নিবন্ধ: রায়না ঘোষ
আরও পড়ুন - Mushroom Spawn and Farming: ঝিনুক মাশরুমের চাষে করুন দ্বিগুন উপার্জন