এই খারিফ মরসুমে শুধু আমন ধানের চাষ না করে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষ করলে লাভের মুখ দেখতে পাবেন। তাছাড়া রাজ্যেই যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ পেঁয়াজের চাষ হয়, তবে বাইরের রাজ্য থেকে আমদানি করার প্রয়োজনও পড়বে না। এতে ক্রেতারাও কম দামে পেঁয়াজ পাবেন এবং রাজ্যের চাষীরাও লাভবান হবেন।
জলবায়ু ও মৃত্তিকাঃ
পেঁয়াজ প্রধানত নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুতে খুব ভালোভাবে চাষ করা যায়। এই ফসল চাষে অধিকমাত্রায় বৃষ্টিপাতের দরকার হয়ে থাকে। সবজি বা কন্দ হিসেবে পেঁয়াজ চাষের জন্য গড় তাপমাত্রা দরকার যথাক্রমে ১৩-২৪ ডিগ্রী ও ১৬-২৫ ডিগ্রী। ৭০% আপেক্ষিক আর্দ্রতায় পেঁয়াজ খুব ভালো বৃদ্ধি পায়। এই ফসল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় মৌসুমি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হতে হবে গড়ে ৬৫০ থেকে ৭৫০ মিলিলিটার। এক্ষেত্রে অবশ্য বৃষ্টিপাতের ভারসাম্য থাকা ভালো, আসলে ৬৫০ মিলির কম বা ৭৫০ মিলির অধিক বৃষ্টিপাত খারিফ শস্যের জন্য মোটেই ভালো নয়।
পেঁয়াজ চাষের মাটি অবশ্যই জৈব পদার্থে পরিপূর্ণ হতে হবে। মাটি সুস্থ ও নিরোগ হতে হবে। ক্ষেতের চারপাশ আগাছামুক্ত থাকতে হবে ও বৃষ্টির জল বেরিয়ে যাবার ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে। পেঁয়াজ বালিমাটি, এঁটেল মাটি, কাদামাটি, পাথুরে মাটি যেকোনো প্রকার মাটিতে জন্মায়। পাথুরে মাটিতে যদি জৈবসার প্রয়োগ করা যায় তাহলে সেখানেও সফলভাবে অধিকমাত্রায় উৎপাদন সম্ভব। পেঁয়াজ চাষের ক্ষেত্রে মাটির pH-এর মান থাকতে হবে ৬.০-৭.৫ মাত্রার আশেপাশে, কারণ এর চাষে মাটির প্রকৃতি সামান্য ক্ষারকীয় থাকতে হবে।
মাঝারি-বড় আকারের কালচে লাল রঙের কন্দপেঁয়াজ সাধারণত উৎপাদিত হয় খারিফ ঋতুতে। এর চাষে ফলন পাওয়া যায় গড়ে প্রতি একরে ১২০ কুইন্ট্যাল।
বীজ বপনের সময়কালঃ
কন্দপেঁয়াজ বীজ বপনের সঠিক সময়কাল হল জুন মাসের মাঝামাঝি। অবশ্য এর ক্ষেত্র তৈরী করে রাখতে হয় মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়কাল থেকে।
বীজের দর -
কন্দপেঁয়াজ এর চাষের জন্য হেক্টর প্রতি ৫-৭ কেজি বীজ কেনা প্রয়োজন। অবশ্য বীজের ব্যপারে ভালো সংস্থার বীজ কেনাই ভালো। তাছাড়া সরাসরি বীজ বপনের ক্ষেত্রে, প্রতি ক্ষেত্রে ১.৬-২ কেজি সংশিত বীজের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
বীজতলা তৈরী –
বীজতলার উপর প্লাস্টিক-আচ্ছাদনের (পলি টানেলের) ব্যবস্থা করে চারা তৈরি করতে হবে। উপযুক্ত জলনিকাশী ব্যবস্থাযুক্ত উঁচু জমিতে ৬-৮ ইঞ্চি গভীর করে কুপিয়ে বীজতলা করতে হবে। পচা শুকনো গোবরসার বা কেঁচোসার প্রতি বর্গমিটারে ৩-৪ কেজির সঙ্গে জৈব-ছত্রাকনাশক ট্রাইকোডার্মা হার্জিয়ানাম ও সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স ২ গ্রাম করে মিশিয়ে দিন। একবিঘার বীজতলার জন্য ১৫ মিটার লম্বা ১ মিটার চওড়া বীজতলা যথেষ্ট। বিঘাপ্রতি এগ্রিফাউন্ড ডার্করেড বর্ষার পেঁয়াজ চাষে ৭০০-৭৫০ গ্রাম বীজই যথেষ্ট। শোধন করা বীজ না পেলে প্রতি কেজি বীজের হিসাবে ২-৩ গ্রাম থাইরাম/ক্যাপটান/কার্বেন্ডাজিম মাখিয়ে বুনুন। বীজতলায় বীজ ছিটিয়ে না বুনে ৩-৪ ইঞ্চি দূরত্বে লাইন করে বুনলে বীজ সাশ্রয়ের সঙ্গে আগামীতে চারার স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। বীজবোনার পর বীজতলা ট্রাইকোডার্মা মেশানো শুকনো গোবর/কেঁচোসার দিয়ে হালকা করে ঢেকে তার উপর শুকনো খড়ের আস্তরণ দিয়ে দিন। যদি উই বা পিঁপড়ের উপদ্রব থাকে তবে ক্লোরপাইরিফস্ ২০ ই.সি. ২ মিলি/লি. জলে হালকা করে খড়-মাটি আস্তরণ ভিজিয়ে স্প্রে করুন। বর্ষার পেঁয়াজ বীজতলায় অন্য সবজি ফসলের মতই বাঁশের বাখারি দিয়ে উপরে পলিথিনের শীট দিয়ে ঢেকে দিন। এক্ষেত্রে অনেক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ থাকে, চাষিরা কমদামী যে পলিশীট ব্যবহার করেন ও বীজতলা খুব আঁটোসাটো করে ঢেকে দেন, তা না করে একটু মোটা পলিশীট অল্প বেশী খরচে কিনুন ও বাঁশের বাখারি চওড়া করে দুপাশে হাওয়া চলাচলের জায়গা রাখুন। এতে চারার বৃদ্ধি হবে সুন্দর ও ড্যাম্পিং অফের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। বীজ ফুটতে শুরু করলে খড়ের আচ্ছাদন সরিয়ে বৃষ্টির গতি-প্রকৃতি বুঝে পলিশীট সরিয়ে রোদ-হাওয়া খাওয়ান। দিন ১০-১৫ ও মাসখানেকে মিশ্র-ছত্রাকনাশক কার্বেন্ডাজিম+ম্যানকোজেব ১ গ্রাম/লি. হিসাবে স্প্রে করে রাখুন। খরিফে ৪০-৪৫ দিনের চারা রোয়ার উপযোগী হয়। কম বয়সের চারা মাটিতে ভালভাবে দাঁড়ায় না, আবার বেশী বয়সের চারাতে ফলন মার খায়। তাই চাষীদের খেয়াল রাখতে হবে, যতদিন না পর্যন্ত চারাগুলি শক্তপোক্ত হয় ততদিন মাটিতে তা রোপণ করা যাবে না।
কন্দ রোপণ প্রযুক্তি -
ছোটো ও মাঝারিমানের কন্দ ১০-১২ কুইন্ট্যাল, প্রতি কন্দে ১৫ সেমি দূরত্বে ও প্রতি লাইনে ৩০ সেমি দূরত্ব বপন করতে হবে। কন্দ বপনের ১ থেকে ২ দিন অন্তর অন্তর জলসেচ করা উচিত।
সার প্রয়োগ -
এই ফসল চাষের জন্য একর প্রতি ২০ টন জৈব সার, ৪০ কেজি নাইট্রোজেন বা ৯০ কেজি ইউরিয়া সার ও ২০ কেজি পটাশিয়াম পেন্টাক্সাইড বা ১২৫ কেজি সিঙ্গেল সুপার ফসফেট এবং ২০ কেজি পটাশিয়াম অক্সাইড বা ৩৫ কেজি মিউরিটস অব্ পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। সমস্ত সারের অর্ধাংশ চারা স্থানান্তরের আগে প্রয়োগ করতে হবে আর বাকি সারটি চারা স্থানান্তরের চারমাস পরে প্রযুক্ত হবে।
চারা স্থানান্তরিতকরণ -
যখন প্রতিটি চারার বয়স ৬-৮ সপ্তাহ ও উচ্চতা ১৫ সেমি পর্যন্ত হবে তখন তাদের বীজতলা থেকে প্রধান ক্ষেতে স্থানান্তরিত করতে হবে। এই সময় প্রতি চারার মধ্যেকার দূরত্ব হতে হবে ২০ সেমি। চারা স্থানান্তরকরণের পর পরই একবার জলসেচ করে নিতে হবে। চারা স্থানান্তরকরণের কাজটি মূলত সন্ধ্যাবেলাতেই করা উচিত, যাতে স্বল্প আলোয় সুস্থ থাকতে পারে।
বর্ষায় পেঁয়াজ চাষে লাভ -
বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষ করার কিছু সুবিধা রয়েছে। ঠিক পুজোর মুখে বর্ষাকালীন পেঁয়াজ ওঠে বলে ভালো বাজারও মেলে। তবে পেঁয়াজের বীজ কেনার সময় সতর্ক থাকার কথা বলেছেন কৃষি আধিকারিকরা। তাঁরা জানান, শীতকালে যে পেঁয়াজ চাষ হয় তা সুখসাগর প্রজাতির। বর্ষকালীন পেঁয়াজ এগ্রিফাউন্ড ডার্ক রেড প্রজাতির। ফলে বর্ষাকালে সুখসাগর প্রজাতির পেঁয়াজের বীজ বুনলে গাছ হবে কিন্তু পেঁয়াজ হবে না। তাই বিশ্বস্ত কোনও সংস্থা বা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বর্ষাকালীন পেঁয়াজের বীজ কেনার পরামর্শ দিয়ে থাকেন তাঁরা।
ফসল তোলা -
ভালো ফসল তোলার প্রধান রহস্য হলো সঠিকভাবে বীজ বপন বা মূখ্য বৃদ্ধিকালে গাছের সঠিক পরিচর্যা। সাধারণতঃ ডিসেম্বর মাসে ফসল তোলা হয়। এই ফসলের রোগ বা পোকাজনিত কোনো সমস্যা নেই। তবে আর্দ্রতাজনিত কারণে অনেক সময় পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়, সেইজন্য সদ্য উৎপাদিত ফসলকে শুষ্ককরণের জন্য সবসময় মুক্ত আলোবাতাসপূর্ণ গুদামঘরে রাখা উচিত, কারণ মুক্ত বাতাস পেঁয়াজের পচনের হাত থেকে রক্ষা করে।
Related link - বর্ষায় এইসব সবজি চাষের (Monsoon Vegetable Seeds) আগে করুন বীজের পরিচর্যা, হবে প্রচুর ফলন
প্রধানমন্ত্রী ফসল বীমা যোজনা (PMFBY)- খারিফ ফসলের জন্য আবেদনের শেষ তারিখ ৩১ শে জুলাই
#বর্ষা ২০২০- ধান উৎপাদনে (West Bengal paddy production) এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ
#বর্ষা ২০২০, খরা প্রবণ অঞ্চলগুলিতে অপর্যাপ্ত বৃষ্টি মোকাবেলায় শীর্ষ পাঁচটি পদক্ষেপ