চিরাচরিত ও গতানুগতিক চাষ পদ্ধতির বাইরে বেরিয়েও কৃষক বন্ধুরা নতুন, বিকল্প চাষের সন্ধানে লেগে পড়েছেন এবং তার চাষ পদ্ধতি নিয়েও তাদের মধ্যে উৎসাহের কোনো খামতি নেই। ধান, পাট, আলু ও শাকসবজি জাতীয় ফসল থেকে আশানুরূপ লাভের মুখ না দেখতে পেয়ে কৃষকদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে যে ক্ষতি তাদেরকে বিকল্প চাষের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করছে। বিকল্প চাষ হিসাবে ড্রাগন ফলের চাষ (Dragon Fruit Farming) করে এ রাজ্যের কৃষকবন্ধুরা কিছুটা হলেও লক্ষ্মীলাভ করছেন।
ক্যাকটেসি পরিবারের অন্তর্গত ড্রাগন ফলের উৎস মেক্সিকো হলেও আমাদের দেশে ইদানীং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এদেশে গুজরাটে সর্বপ্রথম এই ফলের চাষ শুরু হয়। ড্রাগন ফল এক ধরনের ক্যাকটাস জাতীয় বহুবর্ষজীবী চিরহরিৎ লতা। এই গাছের কোন পাতা নেই। ড্রাগন ফলের গাছ সাধারনত ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। ফল আকারে বড়, পাকলে খোসার রং লাল হয়ে যায় ,শাঁস গাঢ় গোলাপী রঙের, লাল ও সাদা এবং রসালো প্রকৃতির। ফলের শাঁসের মধ্যে ছোট ছোট অসংখ্য কালো বীজ থাকে এবং সেগুলি নরম। এক একটি ফলের ওজন ১৫০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। টেবিল ফল হিসাবেই শুধু নয়, খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে এই ফল থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য তৈরি করা হয়। একবার রোপণের পর অন্তত কুড়ি বছর ধরে এর ফল পাওয়া যায়। রোপণের দ্বিতীয় বছর থেকেই ফলন শুরু হলেও পাঁচ বছরের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়।
পুষ্টিগুণ (Nutrition) :
এই ফল স্বাদে-গুণে পুষ্টিতে ভরপুর। ড্রাগন ফল ভিটামিন সি, খনিজ লবণ, উচ্চ ফাইবার যুক্ত এবং প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এতে বিদ্যমান। এছাড়াও ফলে ফ্যাট, ক্যারোটিন, প্রচুর ফসফরাস, অ্যাসকরবিক অ্যাসিড, প্রোটিন,ক্যালসিয়াম, আয়রন রয়েছে। এ কারণে একে আশ্চর্য বিদেশি ফলও বলা হয়ে থাকে।
ড্রাগন ফলের গুরুত্ব (Health Benefits) :
১. ক্যারোটিন সমৃদ্ধ হওয়ায় চোখ ভালো রাখে।
২. আঁশের পরিমাণ বেশি থাকায় হজমে সহায়তা করে। এছাড়া আঁশ শরীরের চর্বি কমায়।
৩. ফলে উপস্থিত প্রোটিন শরীরের বিপাকীয় কাজে সাহায্য করে।
৪. ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত করে ও দাঁত মজবুত রাখে।
৫. ভিটামিন বি-৩ রক্তের কোলেস্টেরল কমায় এবং ত্বক মসৃণ রাখে।
৬. ভিটামিন সি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ত্বক, দাঁত ও চুল ভালো রাখতে সাহায্য করে।
প্রজাতি (Variety) :
১) লাল ড্রাগন ফল বা পিটাইয়া: ত্বকের রঙ লাল ও শাঁস সাদা। এই প্রজাতির ফলই বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
২) কোস্টারিকা ড্রাগন ফল: ত্বক ও শাঁস উভয়ের রঙই লাল।
৩) হলুদ রঙের ড্রাগন ফল: এই জাতের ড্রাগন ফলের ত্বক হলুদ রঙের ও শাঁস সাদা।
জলবায়ু ও মাটি:
রৌদ্রোজ্জ্বল খোলামেলা যুক্ত জায়গা, ভালো নিকাশি ব্যবস্থাসহ জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটি ড্রাগন ফল চাষের উপযুক্ত।
বংশবিস্তার:
অঙ্গজ জনন পদ্ধতি বা বীজের মাধ্যমে ড্রাগন ফলের বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে। তবে মাতৃ গুনাগুণ বজায় রাখতে অঙ্গজ জনন পদ্ধতিতে অর্থাৎ কান্ড কাটার মাধ্যমে বংশ বিস্তার করা হয়, এর সফলতার হার প্রায় একশো শতাংশ এবং ফলও তাড়াতাড়ি ধরে। বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তারের ক্ষেত্রে ফল ধরতে তিন বছর লেগে যায়। অঙ্গজ পদ্ধতিতে উৎপাদিত একটি গাছে ফল ধরতে ১২-১৮ মাস সময় লাগে। দুই থেকে তিন বছর বয়সি পরিণত গাছের থেকে বংশবিস্তারের জন্য ৪০-৫০ সেমি দৈর্ঘ্যের কান্ড নেওয়া হয়। বাছাই করা কান্ডটি শক্ত এবং ঘন সবুজ হওয়া প্রয়োজন। কান্ডটি লাগানোর আগে ভালো করে ছত্রাকনাশক দিয়ে শোধন করে নেওয়া আবশ্যক। শোধন করার পর কান্ডগুলো ৫-৭ দিন ছায়াযুক্ত স্থানে রাখা হয়। এরপর পলিথিন ব্যাগে বেলে দোআঁশ মাটিতে কাটা অংশ পুতে সহজেই চারা উৎপাদন করা যায়। ভালো শিকড় গজানোর জন্য নিয়মিত জল দেওয়া অত্যাবশ্যক। ২০ থেকে ৩০ দিন পরে গোড়া থেকে শিকড় বেরিয়ে এলে তখন মূলজমিতে লাগানোর উপযুক্ত হয়। রোপণের জন্য হেক্টর প্রতি ৬৫০০ টি গাছের প্রয়োজন।
জমি নির্বাচন ও তৈরি:
উঁচু ও মাঝারি উঁচু উর্বর জমি নির্বাচন করতে হবে এবং জমিতে ২-৩ টি চাষ দিয়ে ভালোভাবে মই দিতে হবে।
রোপণের সময় ও পদ্ধতি (Plantation) :
ড্রাগন ফল বছরের যেকোনো সময় লাগানো গেলেও এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস উপযুক্ত। কাটিং গুলো মাটির ১.৫-২ ইঞ্চি গভীরে রোপণ করা হয়। রোপণের আগে প্রতি লাইনে ২-৩ মিটার দূরত্বে কংক্রিটের স্তম্ভ পুঁতে দেওয়া হয় যার উচ্চতা ১.৪-১.৬ মিটার হওয়া উচিত। কংক্রিটের চারপাশে উঁচু করে মাটি বের করে তাতে সারের মিশ্রণ (২০ কেজি গোবর সার + ৫০০ গ্রাম এস.এস.পি. + ১ কেজি এন.পি.কে @ ১৬:১৬:৮ + ২০০ গ্রাম নিমখোল) দেওয়া হয়। প্রতিটি স্তম্ভের চারপাশে ৩-৪ টি কাটিং রোপণ করে চারাগুলি স্তম্ভের সাথে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হয় ও মাটি,খড় বা প্লাস্টিকের আচ্ছাদন দিয়ে দেওয়া হয়।
গাছের পরিচর্যা:
ড্রাগন ফল গাছ খুব দ্রুত বাড়ে এবং মোটা শাখা তৈরি করে। ১ বছরের একটি গাছ ৩০টি পর্যন্ত শাখা তৈরি করতে পারে। ডাল ছাঁটাই নতুন দল গজাতে ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। মূল কান্ড ও শাখা কান্ড রেখে দিয়ে পার্শ্ব ও মাটি অভিমুখী ডালগুলি ছাঁটাই করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত ও জড়িয়ে যাওয়া ডালগুলো কেটে ফেলতে হবে। রোপণের প্রথম বর্ষে প্রথম ছাঁটাই করতে হবে। ছাঁটাইয়ের পর অবশ্যই যেকোনো ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
সারপ্রয়োগ (Fertilizer Application) :
প্রথম বছর ৫০ গ্রাম করে ইউরিয়া ও সুপার ফসফেট, তিনবার প্রতি স্তম্ভে প্রয়োগ করতে হবে। দ্বিতীয় বছর থেকে ৫০০ গ্রাম করে ইউরিয়া, ফসফেট এবং পটাশ সার + ২০ কেজি জৈব সার, তিনবার প্রতি বছর প্রতি স্তম্ভে প্রয়োগ করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে স্প্রে-এর মাধ্যমে অনুখাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। ফসল তোলার ১০ দিন আগে সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে।
সেচ পদ্ধতি (Irrigation) :
ড্রাগন ফল খরা ও জলাবর্ধতা সহ্য করতে পারে না। তাই গরমের দিনেই ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হবে। এছাড়া ফলন্ত গাছে ৩ বার অর্থাৎ ফুল ফোটা অবস্থায় একবার, ফল মটর দানা অবস্থায় একবার এবং ১৫ দিন পর আরেকবার সেচ দিতে হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন পরিচর্যা:
আগাছা অপসারণ করে নিয়মিত সেচ প্রদান এবং প্রয়োজনে চারপাশে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। গাছ লতানো এবং ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার লম্বা হওয়ায় সাপোর্টের জন্য ৪ টি চারার মাঝে ১টি সিমেন্টের ৪ মিটার লম্বা খুঁটি পুততে হবে। চারা বড় হলে খড়ের বা নারিকেলের রশি দিয়ে বেধে দিতে হবে যাতে কাণ্ড বের হলে খুঁটি আঁকড়ে গাছ সহজেই বাড়তে পারে।
রোগ ও পোকা (Disease & Pest Management) :
-
কান্ড ও ফল পচা- কপার অক্সিক্লোরাইড ৪ গ্রাম প্রতি লিটার অথবা ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি ৪ গ্রাম প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
-
অ্যান্থ্রাকনোস- কার্বেন্ডাজিম ও ম্যানকোজেবের মিশ্রণ ২ গ্রাম প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
-
ফ্রুট ফ্লাই- হেক্টর প্রতি ২০-২২ টি ফেরোমন ট্র্যাপ লাগালে উপকার পাওয়া যাবে।
-
মিলিবাগ- ১০০০০ পি.পি.এম. নিম তেল ৪ মিলি প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
আরও পড়ুন - Paddy Disease – ধান চাষে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কীট ও রোগ ব্যবস্থাপনা
ড্রাগন ফল সংগ্রহ ও ফলনঃ
ড্রাগন ফলের কাটিং থেকে চারা রোপনের পর ১ থেকে ১.৫ বছর বয়সের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা যায়। ফল যখন সবুজ থেকে সম্পূর্ণ লাল রঙ ধারণ করে তখন সংগ্রহ করতে হবে। গাছে ফুল ফোঁটার ৩৫-৪০ দিনের মধ্যেই ফল চয়নযোগ্য হয়ে যায়। সম্পূর্ণ পূর্ণতা প্রাপ্ত বাগান থেকে হেক্টর প্রতি ২০-৩০ টন ফল পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন - Cultivation of Black Rice: জৈব উপায়ে ব্ল্যাক রাইসের চাষ