খরিফ মৌসুমে চীনাবাদামের চাষ করেন অনেকে | শুধু অর্থকরী ফসল হিসাবেই নয়, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতেও এর অসীম ভূমিকা | গমের সাথে সাথী ফসল হিসাবে চীনাবাদাম চাষ (Ground nut farming) করা যায় | এতে চাষীদের লাভ বাড়ে | চীনাবাদাম একটি উৎকৃষ্ট ভোজ্য তেলবীজ | চীনাবাদাম প্রতিরোধ করে কোলন ক্যানসার, ব্রেস্ট ক্যানসার ও হাটের্র রোগ। এতে প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে, যা হাড় গঠনেও সহায়ক। চীনাবাদামে আরও আছে প্রচুর আয়রন। এ উপাদান রক্তের লোহিত কণিকার কার্যক্রম বৃদ্ধি করে। চীনাবাদামের ক্যারোটিন ও ভিটামিন ই ত্বক এবং চুল সুন্দর রাখে। তাই, এর বাজার চাহিদাও বেশ ভালো ভাবেই রয়েছে |
মাটি (Soil):
চিনাবাদামের ফুল মাটির উপরে ফুটলেও গর্ভাশয়ের নীচের যে বৃন্তটি শুঁটি গঠন করে, সেটি মাটির নীচে চলে যায় এবং সেখানে পুষ্ট হয়ে বাদামে পরিণত হয়। এই কারণে ভাল জল নিকাশি ব্যবস্থাযুক্ত জমি যেমন হাল্কা, ঝুরঝুরে দোঁয়াশ মাটিতে বাদাম চাষ করা বেশ প্রয়োজনীয় |
জমি তৈরী:
চীনাবাদাম চাষের জন্য জমিতে তিন থেকে চারটি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হবে। ক্ষেতের চারপাশে নালার ব্যবস্থা করলে পরে সেচ ও জল নিকাশের সুবিধা হয়।
মাটি শোধন:
এক একর জমির জন্য ১০০ কেজি ভাল পচানো গোবর সারের সঙ্গে এক কেজি করে উপকারী ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়া (ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি ও সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স) মিশিয়ে পরিমাণ মতো জল দিয়ে এক সপ্তাহ আর্দ্রতা ও ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। এতে উপকারী ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা ১০-১২ গুণ বৃদ্ধি পাবে। শেষ চাষের এক সপ্তাহ আগে মাটিতে প্রয়োগ করে মাটি শোধন করলে টিক্কা, শিকড় ও গোড়াপচা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। ল্যাদা পোকা লাগার ভয় থাকলে এক একর জমিতে ৪ কেজি ফোরেট ১০জি অথবা কার্বোফিউরন ৩ জি শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে।
বীজ বপণের সময়:
খরিপ মৌসুমে এপ্রিল মাস থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চীনাবাদাম বপণের উপযুক্ত সময়। রবি মৌসুমে আশ্বিনের মাঝামাঝি থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত চীনাবাদাম বপণ করা যায়।
রোপণ:
চীনাবাদাম বপণের আগে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। খোসা ছাড়ানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে, যেন বীজের উপরের পাতলা পর্দা পড়ে না যায়। টাটকা খোসা ছাড়ানো বীজ লাগানো উত্তম । খোসা ছাড়ানোর পর ২ থেকে ৫ দিনের মধ্যে বাদামের বীজ বপণ করা উচিত। বীজ সারিতে বপণ করতে হবে। খরিপ মৌসুমে সারি থেকে সারির দূরত্ব হবে ৪৫ সেন্টিমিটার এবং বীজ থেকে বীজের দূরত্ব হবে ১৫ সেন্টিমিটার। বীজ বপণের সময় জমিতে প্রয়োজনীয় রস থাকতে হবে। রস কম থাকলে সেচ দিয়ে জমি তৈরি করে দিয়ে বীজ বপণ করতে হবে। বীজ ৫ সেন্টিমিটার মাটির গভীরে বপণ করতে হবে।
সার প্রয়োগ:
ভালো ফলন পেতে হলে চীনাবাদাম চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৭ টন পচা গোবর, ২০ থেকে ৩০ কেজি ইউরিয়া, ১৫০ থেকে ১৭০ কেজি টিএসপি, ৮০ থেকে ৯০ কেজি এমওপি, ১৬০ থেকে ১৮০ কেজি জিপসাম, ৪ থেকে ৫ কেজি জিঙ্ক সালফেট এবং ৯ থেকে ১১ কেজি বোরাক্স বা বরিক এসিডের প্রয়োজন হয়। অর্ধেক ইউরিয়া এবং অন্যান্য সার বীজ বপণের আগে শেষ চাষের সময় জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া বপনের ৪০ থেকে ৫০ দিন পর গাছে ফুল আসার সময় প্রয়োগ করতে হবে। তবে প্রতি কেজি বীজে ৭০ গ্রাম অণুবীজ সার ব্যবহার করলে সাধারণত ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয় না।
সেচ:
খারিপ মৌসুমে প্রয়োজনবোধে একটি সেচ দিতে হবে। রবি মৌসুমে উঁচু জমিতে মাটির রস তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় বলে ১ থেকে ২টি সেচ দিতে হবে |
রোগ ও প্রতিকার (Disease management system):
শুঁয়ো পোকা:
প্রতি লিটার জলে প্রোফেনফস ৫০% ইসি ১ মিলি অথবা ডাইক্লোরভস ৭৬% ইসি ১ মিলি অথবা ডায়াফেনথিউরন ৫০% ডব্লুপি ১ গ্রাম গুলে আঠা-সহ বিকেলের দিকে ১০ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে। তিনটির মধ্যে দু’টি কীটনাশক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করলে শুঁয়ো পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। একই ভাবে ‘লিফমাইনর’ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
পাতার দাগ রোগ:
এ রোগের আক্রমণে পাতার ওপর হলদে রেখাবেষ্টিত বাদামি রঙের দাগ সৃষ্টি হয়। দাগ পাতার ওপর ছড়িয়ে পড়ে এবং পাতা ঝরে পড়ে। ব্যাভিস্টিন ৫০ ডবিউপি ১ গ্রাম হারে প্রতি লিটার জলের সঙ্গে মিশিয়ে প্রতি ১২ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
সাদা পোকা:
গাঙ্গেয় সমভূমিতে এই পোকার উপদ্রব খুব বেশি হয় না। তবুও গভীর ভাবে জমি চাষ, আশপাশের ঝোপ পরিষ্কার ইত্যাদি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। দু-একটা গাছ রেখে দিলে সেখানে এই পোকা পূর্ণাঙ্গ দশায় আশ্রয় নেবে। তখন সেখানে ক্লোরোপাইরিফস ২০% ইসি ২.৫ মিলি প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
আরও পড়ুন - বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লাভজনক বেবীকর্ন চাষ
ফসল তোলা:
বাদাম যখন পরিপক্ব হয়, তখন গাছের পাতাগুলো হলদে হতে থাকে এবং নিচের পাতা ঝরতে শুরু করে। এ সময় দু-একটি গাছের গোড়া খুঁড়ে পাকা বাদামের গাঢ় রং ও শিরা পরীক্ষা করে সময়মতো বাদাম তুলতে হবে। তারপর তিন থেকে চার দিন ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে বাদাম সংরক্ষণ করতে হবে। শুকনা বাদামে ১০ শতাংশ অথবা তার কম রস থাকতে হবে। ভালোভাবে যত্ন নিলে খরিপ মৌসুমে হেক্টরপ্রতি ২.০ থেকে ২.৫ টন চীনাবাদামের ফলন পাওয়া যায়।
নিবন্ধ: রায়না ঘোষ
আরও পড়ুন - Mushroom Cultivation: শিখে নিন বাড়িতে মাশরুম চাষের দুর্দান্ত পদ্ধতি