সোনালী ফসল পাট চাষে বাংলাদেশ আর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রতিযোগিতা বহুদিনের। বর্ষার এই ফসল অর্থাৎ পাট চাষ দুই বাংলারই প্রাচীন ঐতিহ্য। দেশের দিক থেকে দেখলে পাট আমাদের রাজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়াও পাটের চাষ চীন, উজবেকিস্তান, নেপাল, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড এবং মিশরে প্রচুর পরিমাণে হয়। পাটের অনেকরকম শ্রেণী আছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে মূলত দুই ধরনের শ্রেণীর চাষ হয়। মিঠা পাট ও তিতা পাট। মিঠা পাটের জাতগুলির মধ্যে-- বাসুদেব, চৈতালি, গবীন, বৈশাখী উল্লেখযোগ্য। তিতা পাটের মধ্যে-- সবুজ সোনা, শ্যামলি, সোনালি এই তিন ধরনের জাতের চাষ পশ্চিমবঙ্গে অধিক পরিমাণে হয়।
পাট চাষের উপযুক্ত জলবায়ু ( Proper Climate for Jute Cultivation):
পাটের ফলও বর্ষাকালে ভালো হয়। পাট চাষের জন্য বছরে কম করে ৬০-৭০ সেমি বৃষ্টিপাতের দরকার। আর্দ্র ও উষ্ণ আবহাওয়া পাট চাষের জন্য সবথেকে ভালো বলে বিবেচিত হয়।
পাট চাষে উপযুক্ত মাটি (Soil):
যেই মাটিতে কিছুটা হলেও ক্ষার রয়েছে সেই জমিতে পাটের চাষ ভালো হয়। কিন্তু উন্নত জাতের পাটের আঁশ পেতে গেলে জন্য পলিময় উর্বর মাটিতে এই চাষ করা উচিত। দোআঁশ মাটিতেও পাটের চাষ হয়। উঁচু জমিতে মিঠা পাটের চাষ সবথেকে ভালো হয়। তিতা পাট চাষের জন্য উঁচু এবং নিচু জমিই আদর্শ।
জমি প্রস্তুত (Land Preparation):
ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস নাগাদ মরসুমের প্রথম বৃষ্টি পড়লেই পাট চাষের জমিতে কর্ষণ করা উচিত। পাট চাষের জন্য জমি গভীর করে ৪ থেকে ৫ বার সােজাসুজি ও আড়াআড়িভাবে করে কর্ষণ করে নিতে হবে। এরপর মাটিতে সঠিক ভাবে মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নেওয়া উচিত। পাটের জমি পরিষ্কার রাখা ভীষণ ভাবে দরকার। শেষবার চাষ দেওয়ার সময়, মাটির সঙ্গে গোবর সার পর্যাপ্ত পরিমাণে মেশাতে হবে। ফসফেট ও পটাশ সে বার চাষের সময় মূল সার জমিতে প্রয়োগ করে নিতে হবে।
বীজবপন (Sowing of seeds):
ক্ষেতে পাটের বীজ বপন করার আগে সেগুলি ভালো ভাবে শােধন করে নেওয়া উচিত। একজন কৃষক সরাসরি জমিতে পাটের বীজ পুঁততে পারেন। মার্চ মাস থেকে মে মাস পাটের বীজ পোঁতার উপযুক্ত সময়। হাত দিয়ে ছিটিয়ে অথবা বীজবপন যন্ত্র দুইয়েরই মাধ্যমে বীজ বপন করা যেতে পারে।
সার প্রয়োগ: (Fertilizer)
উপযুক্ত মাত্রায় সার দিলে পাটের ফলন দ্বিগুন হয়। নাইট্রোজেনঘটিত সারের কিছুটা মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে বাকিটা ইউরিয়া দ্রবণে মিশিয়ে পাটের পাতায় স্প্রে করে দেওয়াই হল বুদ্ধিমানের কাজ. এতে ফলন অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।
সেচ পদ্ধতি (Irrigation):
বৃষ্টি পড়লে ভালো নাহলে জমিতে সেচ অবশ্যই দিতে হবে। এরপরেই পাট বোনের পালা শুরু করা উচিত। বীজ বোনা হয়ে গেল অথচ বর্ষা এল না, এই ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০ দিন পর পর নিয়ম মেনে প্রয়োজনমাফিক সেচ দেওয়া শুরু করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে জমিতে যাতে বেশিমাত্রায় জল না দঁড়াতে পারে।
জমির পরিচর্যা (Land Caring):
নিড়ানি দিয়ে মাটি সময়ানুসারে হাল্কা করে দিতে হবে। যখন পাটগাছ ছোট থাকবে তখন এই কাজটি করা উচিত। জমিতে যাতে আগাছা না জন্মায় তার খেয়াল রাখতে হবে। নিয়মমাফিক কীটনাশক স্প্রে করে পোকামাকড় দূর করতে হবে। বিছেপােকা, লাল মাকড়, ঘোড়াপোকা পাট ক্ষেতকে ক্ষতির মুখে ফেলতে পারে, যদি সময় করে কীটনাশক না দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: Fish Farming: মাছ চাষের সম্পূর্ণ পদ্ধতি, দেখে নিন কি কি করণীয়
ফসল তোলা (Harvesting):
পাট গাছে ফুল ফোটার সময় ফসল কেটে নিলে ফলন কমে যায়, কিন্তু অশি উন্নতমানের মেলে। ফুল থেকে যখন ফল ধরছে সে সময়েও অনেক চাষি ভাই পাট কেটে নেন। এই সময়ে পাট কাটলে ফলন ভালো মেলে ও আঁশও উন্নত মানের পাওয়া যায়। ফল পাকার সময়ে পাট না কাটাই ভালো। এই সময় পাট কাটলে ফলন বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু পাটের গুণগত মান ভালো হয় না।
পাট ঠিকঠাক পচলেই পাটের আঁশের মান ভালো হবে। পাট আঁটি করে বেঁধে জলে পচানোর জন্য ফেলে দেওয়া হয়। দু'সপ্তাহের মধ্যেই প্রয়োজন মতো উষ্ণতা পেলে পাট পচে ওঠে। পাট পচে ওঠার পর পাট কাঠি থেকে আঁশ ছাড়িয়ে নিতে হবে। আঁশগুলোকে পরিষ্কার জলে এরপর ভালো করে ধুয়ে নিয়ে দড়িতে টাঙিয়ে রোদে শুকিয়ে নেওয়া হয়। ৩ থেকে ৪ দিন শুকিয়ে নিলেই অশি প্রস্তুত।
পাটের আঁশ থেকে আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাই। পাপোশ, দড়ি, থলে বিভিন্ন জিনিস পাটের থেকেই উৎপন্ন হয়। উন্নত মানের পাট থেকে কার্পেট, ঘর সাজানোর জিনিসের মতো সৌখিন দ্রব্যও বানানো হয়।
পাটকাঠিও বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। বেড়া দেওয়া থেকে শুরু করে, জ্বালানির কাজে পাটের ব্যবহার দেশের মানুষ বহুদিন ধরেই করে আসছে। এছাড়াও পানের বরজ তৈরী করতে অথবা কাগজ বানানোর অন্যতম কাঁচামাল হিসাবে পাটের ব্যবহার যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন:Pomegranate Farming: বেদনা চাষে লাখ টাকা উপার্জন সফল চাষী মোকাররমের
Share your comments