আমাদের শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও পরিস্ফুটনের জন্য দরকার সঠিক মাত্রায় সুষম খাবার। আর এই সুষম খাবারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হল সবজি। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চের নির্দেশ অনুযায়ী সুষম খাবারে অতিঅবশ্যই থাকতে হবে দৈনিক ২৮৫ থেকে ৩০০ গ্রাম পরিমাণ টাটকা ও রাসায়নিক বিষমুক্ত সবজি। সবজি হল খনিজ মৌল এবং ভিটামিনের মত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যোপাদানে সমৃদ্ধ যাকিনা আমাদের দেহের মধ্যে রোগ প্রতিরোধক শক্তি জোগাতে ভীষণভাবে সাহায্য করে।
এখন সমস্যা হল হাটওবাজার থেকে টাটকা ও ক্ষতিকারক রাসায়নিক বিষমুক্ত সবজি পাওয়া। বিগত কয়েক বছর থেকে শুরু হয়েছে সবজির সাথে শারীরের পক্ষে একেবারে ক্ষতিকারক রাসায়নিক রঙ মেশানো। এদের বলা হয় ভেজাল রাসায়নিক খাদ্যরঙ বা অ্যাডালটারেন্ট ফুড কালার্যান্ট। আর এই মারাত্মক খারাপ কাজটি করে থাকেন সবজি মজুতদার ও বিক্রেতা ব্যবসায়ীরা। দিনে দিনে ক্রমশ সবজির সঙ্গে ভেজাল রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর প্রবণতা বেড়েই চলেছে, যেটা যথেষ্ট বিপদ ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারন এতি স্বাস্থ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।
সবজির সাথে রাসায়নিক রঙ মেশানোর মূল কারণ গুলি হলঃ-
-
সবজিগুলির বাহ্যিক রঙ ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা যাতে সহজেই ক্রেতারা আকৃষ্ট হতে পারেন এবং সবজি কেনেন।
-
সবজিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য চকচকে ও রঙীন করে রাখা।
-
সবজিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ফ্রেশ বা টাটকা ও সতেজ করে রাখা এবং সবজির আসল প্রাকৃতিক রঙ নষ্ট হয়ে যাওয়াকে ঠেকানো।
-
সবজির উপরিভাগে থাকা যেকোনো ধরনের খুঁত বা ডিফেক্ট গুলিকে ঢেকে দেওয়া, যাতে কিনা ক্রেতারা বুঝতে না পারেন অর্থাৎ ক্রেতাকে সরাসরি ঠকানোর কৌশল।
নানান ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ভেজাল খাদ্যরঙ হিসেবে সবজির সাথে মেশানোর জন্য বাজারে ব্যবহারের রেওয়াজ আছে। বাজারে যেসব রাসায়নিক রঙগুলি সবজির সাথে মেশানো হয় সেগুলি হল, কপারসালফেট বা তুঁতে, ম্যালাচাইট গ্রীন, রোডামিন-বি, এবং এরিথ্রোসিন। এই সব ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ সবজিতে ভেজাল রঙ হিসেবে মেশানোর পরে এই সব রঙ মেশানো সবজি খেলে দেহে নানান রকমের দৈহিক সমস্যা ও মারাত্মক রোগব্যাধি তৈরী হয়, এমনকি মারাও যেতে পারেন।
আরও পড়ুনঃ কম খরচে বেশি লাভের জন্য বেছে নিন বিশ্বের সবচেয়ে ছোট ৭টি গরুর জাত
বাজারে নানান রাসায়নিক রঙের মধ্যে লালরঙ সর্বাধিক পরিমানে খাবারে ভেজাল পদার্থ হিসেবে মেশানো হয়। এরপরেই আছে সবুজ রঙের রাসায়নিক পদার্থ। নীল রঙের পদার্থ সবচেয়ে কম পরিমাণে ভেজাল হিসাবে সবজির সাথে মেশানো হয়। বাজারে যেসব সবজিতে রঙ সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করার চলন আছে সেগুলি হল বেগুন, উচ্ছে-করোলা, পটল, টমেটো, কাঁচালঙ্কা, শসা, ঢেঁড়স, মটরশুটি, লাউ এবং মিষ্টি আলু বা রাঙাআলু।
কপার সালফেট বা তুঁতে
এই রাসায়নিক যৌগটি মূলতঃ ব্যবহার করা হয় ছত্রাকনাশক, শেওলানাশক এবং আগাছানাশক হিসেবে। এর ক্রিস্টাল পদার্থ জলের সাথে মিশিয়ে গাঢ়ো নীলাভ সবুজ রঙের দ্রবন তৈরী করা হয়। এই দ্রবণের মধ্যে সবজি ডুবিয়ে রাখলে কিছু সময়ের মধ্যে সবজির গাঢ় সবুজ রঙ ধারণ করবে এবং মনে হবে সত্যিকারে এগুলি টাটকা ও সতেজ। শসা, উচ্ছে, করোলা, ঢেঁড়স ও পটল প্রভৃতি সবজিতে এই রঙ ব্যবহার করা হয়। পেট ব্যথা, বমি বমি ভাব এবং গ্যাস্ট্রো ইনটেসটিনাল প্রভৃতি সমস্যা এই রঙের জন্য হতে পারে। কপার সালফেটে রঙ করা সবজি কেনা থেকে বিরত এবং সাবধান থাকুন। সবজিতে কপার সালফেট এর দ্রবন মেশানো হয়েছে কিনা বুঝতে হলে জলে ভিজিয়ে নেওয়া পরিষ্কার সাদা তুলোর প্যাড দিয়ে কেনা সবজির উপরিভাগে আলতো করে ঘষে নিন। যদি দেখেন তুলাতে সবুজ রং লেগেছে তাহলেই বুঝতে পারবেন আপনার কেনা সবজি কপার সালফেটের রঙ মেশানো হয়েছে এবং এমন সবজি একদম ব্যবহার করা যাবে না।
আরও পড়ুনঃ মাশরুম খাওয়ার ৭টি দারুণ উপকারিতা, যা সবার জানা জরুরি!
ম্যালাচাইট গ্রীনঃ মূলত রাসায়নিক শিল্পে এই পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এই যৌগটি ১৮৭৭ সালে সর্বপ্রথম প্রস্তুত করেন হারম্যান ফিশচার। অসাধু ব্যবসায়ীরা সবজিকে রঙে চকচকে ও সতেজ দেখাবার জন্য দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক এই রাসায়নিক যৌগটিকে ব্যবহার করছেন। মাছ চাষের ক্ষেত্রে এটি ছত্রাকনাশক হিসেবে চাষীরা ব্যবহার করেন।ম্যালাচাইট গ্রীন মূলতঃ মটরশুঁটি, কাঁচালঙ্কা, শসা, পালং শাক ও ঢ্যাড়সকে সবুজ, চকচকে ও সতেজ করে ক্রেতাদের চোখে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এই ভেজাল রঙ ব্যবহার করেন। এই রাসায়নিক যৌগটি ব্যবহার করা হয়েছে কিনা এটা বুঝতে হলে জলে ভেজানো পরিষ্কার তুলার প্যাড নিয়ে কেনা সবজির উপরিভাগে ঘষে নিতে হবে। যদি সাদা তুলো সবুজ রঙের হয়ে যায় তাহলে বুঝতে হবে এই সবজিতে ক্ষতিকারক ম্যালাচাইট গ্রীন ব্যবহার করা হয়েছে। তাহলেই এই সবজি ব্যবহার করা থেকে সাবধান হতে হবে। এই রাসায়নিক যৌগ ব্যবহার করা সবজি খেলে ডায়োরিয়া, শ্বাসতন্ত্রের নানান সমস্যা, নার্ভজনিত রোগ এবং এমনকি ক্যানসারও পর্যন্ত হতে পারে।
বাজারে গোটা মটরশুটির সাথে সাথে টাটকা সবুজ রঙের ছাড়ানো মটরশুটির দানাও বিক্রী হয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা শুকিয়ে যাওয়া এবং বিক্রি না হওয়া মটরদানাগুলিকে ম্যালাচাইট গ্রীন রাসায়নিক রঙের দ্রবনে ডুবিয়ে সতেজ, টাটকা ও চকচকে করে বিক্রি করে থাকেন। ছড়ানো মটরশুটি কেনার ব্যাপারেও সাবধান ও সতর্ক থাকবেন। একটি পরিষ্কার কাঁচের গ্লাসে বাজার থেকে কেনা মটরশুঁটির কয়েকটি দানা ফেলে গ্লাসে পরিষ্কার জল ভর্তি করে দিন। কিছু সময় পরে যদি গ্লাসের জল সবুজ রঙ ধারণ করে তবে বুঝবেন দানাগুলিতে ম্যালাচাইট গ্রীন মিশ্রিত করা হয়েছে। এমন মটরশুঁটির দানা একদম খাবেন না।
লেখক- সৌমেন্দ্র নাথ দাস