প্রাচীনকাল থেকে কালোজিরা মানবদেহের নানা রোগের চিকিসায় ব্যবহার হয়ে আসছে। শুধু খাবারের স্বাদ বৃদ্ধিতেই নয় এই বীজ থেকে তৈরি তেল শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। কালো জিরায় ক্যান্সার প্রতিরোধক কেরোটিন ও শক্তিশালী হরমোন বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকারী এর বীজ থেকে তেল যা মানব শরীরের জন্য খুব উপকারি। এতে আছে ফসফেট, আয়রন এবং ফসফরাস। এছাড়াও কালোজিরা বিভিন্ন রোগের হাত থেকে দেহকে রক্ষা করে
কালো জিরার গুণাগুণ (Medicinal Properties) :
এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান, পাচক এনজাইম ও অম্লনাশক উপাদান ফসফেট, লৌহ,ফসফরাস, কার্বো-হাইড্রেট ছাড়াও জীবাণু নাশক বিভিন্ন উপাদান সমূহ। এতে রয়েছে ক্যন্সার প্রতিরোধক কেরোটিন ও শক্তিশালী হর্মোন, প্রস্রাব সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান, পাচক এনজাইম ও অম্লনাশক উপাদান এবং অম্লরোগের প্রতিষেধক। তাই বর্ষাকালে শরীর সুস্থ রাখতে কালো জিরার জুড়ি মেলা ভার।
গাছের প্রকৃতি-
কালোজিরা মাঝারী জাতীয় নরম মৌসুমী গাছ। একবার ফুল ও ফল হয়ে মরে যায়। উচ্চতায় ২০-৩০ সেমি (৮-১২ ইঞ্চি), পাতা সরু ও চিকন, সবুজের মধ্যে ছাই রং মেশানো। জোড়া ধরে সোজা হয়ে পাতা জন্মায়। কালোজিরার গাছে স্ত্রী, পুরুষ দুই ধরনের ফুল হয়। নীলচে সাদা (জাত বিশেষ হলুদাভ) রঙ। এতে পাঁচটি পাঁপড়ি থাকে। এর ফল গোলাকার, কিনারায় অাঁকর্শির মত বাড়তি অংশ থাকে। কালো রঙের প্রায় তিন কোণা আকৃতির বীজ। বীজকোষ খাঁজ আকারে ফলের সাথে লম্বালম্বিভাবে থাকে। প্রতিটি ফলে ২০-২৫ টি বীজ থাকতে পারে।
সময়কাল ও জমি (Time & Land Preparation):
শুকনা ও ঠান্ডা আবহাওয়া কালোজিরা আবাদের জন্য উপযুক্ত। ফুল ফোটার সময় বৃষ্টি হলে কালোজিরার ফলন কমে যায়। বীজ বপনের জন্য ৩ থেকে ৪টি চাষ ও আড়াআড়ি মই দিয়ে মাটি ঝুরাঝুরা করতে হয়। এরপর আগাছা পরিষ্কার করে জমি সমতল করে বীজ বপন করতে হয়। অল্প পরিমাণ এক বিঘা বা তার কম জমিতে চাষ করলে ৫ সেন্টিমিটার বা ২ ইঞ্চি উঁচু খন্ডিত বেড তৈরি করা ভালো।
বপন (Plantation) :
অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বীজ বপন করা যায়। তবে নভেম্বর মাসের প্রথম-দ্বিতীয় সপ্তাহ বীজ বপন করার উত্তম সময়। অগ্রহায়ণের শেষ থেকেই বীজ বপন করা যায়। তবে বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকলে পৌষের প্রথমে বপন করা ভালো। সফলভাবে কালোজিরা উৎপাদনের জন্য ১৫ঃ১০ সেন্টিমিটার দূরত্বে লাইনে বীজ বপন করলে ভালো হয়। ১-৪ ইঞ্চি গর্ত করে প্রতি গর্তে ২-৩টি করে বীজ বপণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বীজ যেন বেশী গভীরে না যায়। বীজ বপনের আগে আলাদা করে শোধনের দরকার নেই। তবে বোনার আগে ভালো করে ধুয়ে ধুলাবালি ও চিটা বীজ সরিয়ে নেয়া ভালো। ভেজা বীজ বপন করা উচিত নয়। ১ বিঘা জমিতে ১ কেজি থেকে ১.৫ কেজি বীজ লাগে। আর হেক্টরপ্রতি ৪ থেকে ৬ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। তবে লাইনে লাগালে ৩.৫ কেজি থেকে ৪.৫ কেজি বীজই যথেষ্ট।
সার প্রয়োগ (Fertilizer Application) :
জমি তৈরির সময় ছাড়া পরে আর সার দেওয়ার তেমন প্রয়োজন নেই। জৈব ও অজৈব সারের সমন্বয়ে হেক্টরপ্রতি সারের পরিমাণ হ’ল পচা গোবর ৫ থেকে ১০ মেট্রিক টন, ইউরিয়া ১২৫ কেজি, টিএসপি ৯৫ থেকে ১০০ কেজি, এমওপি ৭৫ কেজি। জমি তৈরি ও শেষ চাষের সময় জৈবসার, অর্ধেক ইউরিয়া, পুরো টিএসপি ও এমওপি মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। বীজ বপনের ৪০ দিন পর বাকী ইউরিয়া উপরিপ্রয়োগ হিসাবে জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে।
পরিচর্যা :
বীজ লাগানোর পরই হালকা করে মাটি দিয়ে গর্ত ঢেকে দিতে হবে। পাখিতে যেন বীজ খেতে না পারে, সেজন্য সতর্ক থাকতে হবে। এছাড়া প্রয়োজন হ’লে আগাছা পরিষ্কার, গাছ পাতলাকরণ কাজ নিয়মিত ও পরিমিতভাবে করতে হবে।
সেচ ও নিষ্কাশন :
সাধারণত সেচের প্রয়োজন নেই। তবে নতুন চারা লাগানোর পর রোদ বেশী হ’লে ছিটিয়ে জল দেওয়া যায়। সন্ধ্যায় জল ছিটিয়ে দেওয়া ভালো। জমিতে রস না থাকলে বীজ বপনের পর হালকা সেচ দিতে হবে। তবে প্লাবন সেচ দিলে বীজ এক জায়গায় জমা হয়ে যেতে পারে। মাটির ধরন ও বৃষ্টির ওপর নির্ভর করে পুরো জীবনকালে ২-৩ বার সেচ দিতে হবে।
রোগবালাই ব্যবস্থাপনা (Disease Managemnt) :
কালোজিরা সহজে তেমন কোন পোকামাকড়ে আক্রমণ করে না। বরং এর স্বাভাবিক পোকামাকড় ধ্বংসের ক্ষমতা আছে। রোগবালাইও তেমন হয় না। মাঝে মাঝে কিছু ছত্রাক আক্রমণ দেখা দিলে রিডোমিল গোল্ড বা ডাইথেন এম ৪৫ প্রতি লিটার জলে ২ গ্রাম হারে মিশিয়ে ২-৩ বার ১০ দিন পরপর ছিটিয়ে দিতে হবে।
জীবনকাল :
অংকুরোদগম-চারা গজাবে- ১২-১৬ দিনে; গাছের বৃদ্ধি পাবে ৩০-৪০ দিনে; ফুল আসবে ৩৫-৪২ দিনে; ফল আসবে ৪২-৫৫ দিনে; ফল পাকবে- ৬০ থেকে ৮৫ দিনে। বীজ বপনের পর সর্বমোট ১৩৫ থেকে ১৪৫ দিনে গাছ হলদে বর্ণ ধারণ করে মরে যায়। ১৫-২০ সপ্তাহের মধ্যে ফসল পাকবে ও তোলার সময় হবে। অর্থাৎ পৌষের প্রথমে চাষ করলে ফাল্গুন-চৈত্রে ফসল তোলা যাবে।
আরও পড়ুন - Kharif Medicinal Crop – জেনে নিন এই মরসুমে কোন কোন ঔষধি উদ্ভিদের চাষ আপনার জন্য সেরা
ফসল সংগ্রহ ও ফলন :
১ বিঘা জমিতে চাষ করলে গড়ে ৯০ থেকে ১১০ কেজি কালোজিরা পাওয়া যাবে। একরপ্রতি ৩০০ কেজি থেকে ৩৪০ কেজি পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। বারি কালোজিরা-১ সঠিক পরিচর্যায় হেক্টরপ্রতি ১ মেট্রিক টন পর্যন্ত ফলন দেয়। ফাল্গুন-চৈত্রে গাছ মরে গেলে গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করে ২ দিন রোদে শুকিয়ে নিয়ে হাতে সাবধানে আঘাত করে মাড়াই করে বা লাঠি দিয়ে বীজ সংগ্রহ করা যায়। গাছে সামান্য রস থাকতেই ফল সংগ্রহ করা উচিত। অন্যথা বীজ জমিতে ঝরে পড়তে পারে। বীজ রোদে শুকিয়ে ঠান্ডা করে কুলা দিয়ে পরিষ্কার করে চটের বস্তায় বা মাটির পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে। এভাবে অন্তত এক বছর পর্যন্ত বীজ ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যায়। মানসম্মত বীজ সংরক্ষণে পাত্র শুকনো, ঠান্ডা, অন্ধকার জায়গায় রাখতে হবে।
আরও পড়ুন - Papaya Farming – অতিরিক্ত আয় করতে খুব সহজেই করুন বাগানে পেঁপে চাষ