আদার (Ginger Farming) বৈজ্ঞানিক নাম Zingiber officinale । বাঙালির রান্নায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত উপাদান গুলির মধ্যে আদা অন্যতম। বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আদার উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে আদা বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।
আদা উৎকৃষ্ট ভেষজ গুণসম্পন্ন মসলা জাতীয় ফসল। আদা দেহের অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে। আদার রস রুচিবর্ধক হিসেবে কাজ করে। আদার রস মধু মিশিয়ে খেলে কাশি দূর হয়। আদার রস পেট ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। আদা পাকস্থলী ও লিভারের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি ছাড়াও স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে। আদা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে এবং রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা কার্যকরভাবে কমাতে সাহায্য করে। আদা মানবদেহে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
আদার জাত (Variety) -
উচ্চফলনশীল জাতসম্পূর্ণ গাছগুলির উচ্চতা প্রায় ৮০ সেমি। প্রতি গোছায় পাতার সংখ্যা ২১-২৫টি এবং পাতাগুলি আংশিক খাড়া প্রাকৃতির। প্রতি গোছায় টিলারের সংখ্যা ১০-১২টি। প্রতিটি গোছায় রাইজোমের ওজন ৪০০-৪৫০ গ্রাম। প্রচলিত জাতগুলির চেয়ে এর ফলন তুলনামূলকভাবে বেশি। স্থানীয় জাতের মতো বারি আদা-১ সহজে সংরক্ষণ করা যায়। বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকাতেই আদার এ জাতটি চাষ করা সম্ভব।
চাষের সময় ও জমি তৈরি (Plantation & Land Preparation) -
মার্চ-এপ্রিল মাসে বৃষ্টি হওয়ার পর জমি যখন জো অবস্থায় আসে তখন ৬-৮ টি চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করা হয়। এরপর ৪ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ২ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট বেডের চারিদিকে পানি সেচ ও নিষ্কাশনের সুবিধার জন্য ৫০ সেমি চওড়া নালা তৈরি করতে হবে।
আদা চাষে জলবায়ু ও মাটিঃ
আদা চাষ করার জন্য উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু পূর্ণ আবহাওয় দরকার। সামান্য ছায়াযুক্ত স্থানে আদা চাষ ভাল হয়। আদা চাষের জন্য ঊর্বর দোআঁশ মাটি সবচেয়ে ভালো। তবে এঁটেল মাটিতে চাষ করলে পানি নিষ্কাশনের খুব ভালো ব্যবস্থা থাকতে হবে।
জমি প্রস্তুতঃ
আদা চাষের জন্য জমিতে ভালো করে ৫/৬টি চাষ ও মই দিয়ে এবং মাটি ঝুরঝুরে করে জমি প্রস্তুত করতে হবে। আদা চাষ করার জন্য উঁচু অথবা মাঝারী উঁচু জমি নির্বাচন করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে আদা চাষ করার জমিতে যেন পানি না জমে।
আদা রোপণের সময়:
এপ্রিলের শুরু থেকে মে মাস পর্যন্ত আদা রোপণ করা যায়। তবে এপ্রিলের শুরুতে রোপণকৃত আদার ফলন সবচেয়ে বেশি হয়।
আদার বীজ শোধন:
পচন রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বীজ আদা শোধন করতে হবে। এজন্য ১০ লিটার পানিতে ১২-১৩ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড বা এক্রোবেট এম জেড বা ডাইথেন এম-৪৫ মিশিয়ে তাতে ১০ কেজি আদা বীজ আধা ঘন্টা পর্যন্ত ভিজিয়ে তুলে ছায়াযুক্ত স্থানে খড়/চট দিয়ে ঢেকে রাখলে ভ্রুণ বের হয়। এ ভ্রুণযুক্ত আদা জমিতে রোপণ করতে হবে।
বীজের হার:
আদার ফলন অনেকাংশে বীজের আকারের উপর নির্ভর করে। বীজ আদার আকার বড় হলে ফলন বেশি হয়। সাধারণত ৩৫-৪০ গ্রাম আকারের বীজ রোপণ করলে আদার ফলন বেশি হয়। এ আকারের বীজ রোপণ করলে হেক্টরপ্রতি ২.০-২.৫ টন আদার প্রয়োজন হয়। অপরদিকে, ছোট (২০-৩০ গ্রাম) আকারের বীজ ব্যবহার করলে খরচ কম হয়। এ আকারের বীজ রোপণ করলে হেক্টরপ্রতি ১.৬-২.৪ টন আদার প্রয়োজন হয়।
আদার বীজ রোপণ পদ্ধতিঃ
সারি ৫০ সেমি এবং কন্দ থেকে কন্দ ২৫ সেমি দূরত্বে রোপণ করা হয়। একক সারি পদ্ধতিতে ৫০ সেমি পরপর ৫-৬ সেমি গভীর করে সারি তৈরি করার পর ২৫ সেমি দূরত্বে বীজ আদা রোপণ করতে হয়। বীজ আদা রোপণের সময় সবগুলো বীজের অঙ্কুরিত মুখ একদিকে রাখতে হবে যাতে বীজ আদা রোপণের ৭৫-৯০ দিন পর সারির এক পার্শ্বের মাটি সরিয়ে সহজেই আদার রাইজোম সংগ্রহ করা যায়।
আদার জমিতে সার প্রয়োগ:
বেশি ফলন পেতে হলে আদার জমিতে জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
আদা চাষের ক্ষেত্রে আন্তঃপরিচর্যা:
রোপণের ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে আদার গাছ বের হয়। আদা রোপণের ৫-৬ সপ্তাহ পর জমির আগাছা নিড়িয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার করে দিতে হবে। এরপর প্রয়োজনমতো আগাছা পুণরায় পরিষ্কার করে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হবে। আদার রাইজমের বৃদ্ধি এবং পানি নিষ্কাশনের জন্য ২-৩ বারে সারির মাঝখানে থেকে মাটি তুলে আদা গাছের গোড়ায় দিতে হবে। অনেক সময় আদা রোপণের পর পাতা/ধানের খড় দিয়ে জমি মালচিং করা হয়। আদার জমিতে ছায়া প্রদানকারী গাছ যেমন- ধইঞ্চা, বকফুল ইত্যাদি বীজ লাগানো যায়। এ সমস্ত গাছ ১.৫-২.৫ মিটার উঁচু হলে আগা কেটে দিয়ে শাখা প্রশাখা বৃদ্ধি করে ছায়ার ব্যবস্থা করা হয়।
আদার চাষে সাথী ফসলঃ
আদার জমিতে সাথী ফসল যেমন-মাচার লাউ, মিষ্টি কুমড়া, পটল, শিম, বরবটি ইত্যাদি ছায়ার গাছ হিসেবে আবাদ করে বাড়তি উপার্জন করা যায়।
আদার রোগ ও পোকামাকড়ঃ
রাইজম রট রোগঃ পিথিয়াম এফানিডারমেটাম নামক ছত্রাকের আক্রমণের কারনে এ রোগ হয়। এ রোগ রাইজমে আক্রমণ করে বলে আদা বড় হতে পারে না ও গাছ দ্রুত মরে যায়।
লক্ষণঃ প্রথমে পাতা হলুদ হয়ে যায় কিন্তু পাতায় কোন দাগ থাকে না। পরবর্তীতে গাছ ঢলে পড়ে ও শুকিয়ে মরে যায়। রাইজম (আদা) পচে যায় ও ফলন মারাত্মক ভাবে কমে যায়। ভেজা ও স্যাঁত স্যাঁতে আবহাওয়ায় এ রোগ বেশী দেখা যায়। বর্ষাকাল বা জলাবদ্ধতা থাকলে এ রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। এ রোগ বীজ, পানি ও মাটির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে।
ব্যবস্থাপনাঃ
আক্রান্ত গাছ রাইজোমসহ সম্পূর্ণরূপে তুলে ধ্বংস করতে হবে।
রোপণের পূর্বে প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম রিডোমিল গোল্ড বা ১ গ্রাম অটোস্টিন মিশ্রিত দ্রবণে বীজকন্দ ৩০ মিনিট ডুবিয়ে ছায়ার নিচে শুকিয়ে রোপণ করতে হবে।
সুষম সার ব্যবহার করতে হবে। একই জমিতে বার বার আদা চাষ করা যাবে না।
অর্ধপচা মুরগির বিষ্ঠা প্রতি হেক্টরে ১০ টন হারে আদা লাগানোর ২১ দিন পূর্বে মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে।
কন্দ পচা রোগ দ্বারা আক্রান্তের প্রাথমিক পর্যায়ে কপার অক্সিক্লোরাইড ৫০% ডব্লিউপি প্রতি লিটার পানিতে ৪ গ্রাম বা রিডোমিল গোল্ড প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম মিশিয়ে মাটির সংযোগ স্থলে ১৫-২০ দিন অন্তর অন্তর প্রয়োগ করে রোগ প্রতিরোধ করা যাবে।
পাতা ঝলসানো রোগঃ প্রাথমিক অবস্থায় পাতায় ফ্যাকাশে হলুদ বর্ণের ডিম্বাকৃতির দাগ পড়ে। এসব দাগগুলোর মধ্যে ধূসর বর্ণ হয় এবং চারপাশে গাঢ় বাদামি আবরণ থাকে। রোগের প্রকোপ বেশি হলে দাগগুলো বড় হতে থাকে এবং একত্রিত হয়ে যায়।
প্রতিকারঃ
বীজ লাগানোর সময় রোগ ও পোকা মুক্ত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
প্রতি লিটার পানিতে ২.৫ গ্রাম ডাইথেন এম-৪৫ মিশিয়ে ২-৩ বার ১৫ দিন পরপর স্প্রে করা যেতে পারে।
ডগা বা কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকাঃ কান্ড আক্রমণ করে বলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলে উৎপাদন কম হয়। এ পোকার মথ কমলা হলুদ রঙের এবং পাখার উপর কালো বর্ণের ফোটা থাকে। কীড়া হালকা বাদামি বর্ণের। গায়ে সুক্ষ্ণ শুং থাকে।
লক্ষণঃ পোকা কান্ড ছিদ্র করে ভিতরের দিকে খায় বলে পাতা হলুদ হয়ে যায়। অনেক সময় ডেড হার্ট লক্ষণ দেখা যায়। আক্রান্ত কান্ডে ছিদ্র ও কীড়ার মল দেখা যায়। আর্দ্র আবহাওয়ায় এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়।
ব্যবস্থাপনাঃ
পোকার আক্রমণ বেশি হলে, সুমিথিয়ন ৫০ ইসি ২০ মিলি হারে প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ব্যবহার করা যায়। অথবা
ডারসবান বা ডাইমেক্রণ প্রতি লিটার পানিতে ০.৫ মিলি হারে মিশিয়ে স্প্রে করা যাবে। অথবা নুভাক্রন ১০০ ইসি ১ মিলি/ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১৫ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হবে।
আরও পড়ুন - সুস্থায়ী পদ্ধতিতে ফসলের সাদা মাছি নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
আদা সংগ্রহ ও সংরক্ষণঃ
কন্দ রোপণের প্রায় ৯-১০ মাস পর পাতা এবং গাছ হলুদ হয়ে শুকিয়ে যায়। সাধারণত ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে কোদাল দিয়ে মাটি আলাদা করে আদা উত্তোলন করা হয়। ফসল সংগ্রহের পর মাটি পরিষ্কার করে আদা সংরক্ষণ করা হয়। আদা উঠানোর পর ছায়াযুক্ত স্থানে বা ঘরের মেঝেতে গর্ত করে গর্তের নিচে বালির ২ ইঞ্চি পুরু স্তর করে তার উপর আদা রাখার পর বালি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। পরে খড় বিছিয়ে দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। এতে আদার গুণাগুণ এবং ওজন ভালো থাকে।
আদার ফলনঃ
উন্নত পদ্ধতিতে আদার চাষ করলে হেক্টরপ্রতি ২০ থেকে ২৫ টন ফলন পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন - মাচা তৈরির মাধ্যমে পটলের চাষ পদ্ধতি ও পোকাদমন ব্যবস্থাপনা