বিশ্বের জনপ্রিয় মৌসুমি ফুলের মধ্যে অন্যতম হলো চন্দ্রমল্লিকা ( Chrysanthemum ) | এটি বিভিন্ন বর্ণ ও রঙের হয়ে থাকে। তাই একে ‘শরৎ রানি’ও বলা হয়। জনপ্রিয়তার দিক থেকে গোলাপের পরই এর স্থান। এটি মূলত জাপান ও চীনের ফুল |বিভিন্ন জাতের চন্দ্রমল্লিকার ফুলের আকার, রঙ ইত্যাদির প্রকারভেদ আছে। এর মধ্যে তামাটে, সোনালি, হলুদ, বেগুনি, লাল, খয়েরি এবং “গ্রিন গডেস” নামের সবুজ চন্দ্রমল্লিকা অত্যন্ত জনপ্রিয়। চন্দ্রমল্লিকা ফুলের বাজারে চাহিদা থাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই ফুলের চাষ (Chrysanthemum cultivation) খুবই গুরুত্বপূর্ণ |
তবে, জেনে নেওয়া যাক এই ফুল চাষের কিছু নিয়ম,
জলবায়ু (Climate):
প্রধানত, চন্দ্রমল্লিকা তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা আবহাওয়া এবং রৌদ্রোজ্জ্বল জায়গায় ভালোভাবে জন্মায় |
মাটি (Soil):
জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ সুনিষ্কাশিত দো-আঁশ ও বেলে মাটি চন্দ্রমল্লিকা চাষের জন্য উপযোগী। মাটির পিএইচ ৬.০-৭.০ হওয়া জরুরি।
চারা তৈরী:
সাধারণত, বীজ, সাকার ও শাখা কলম থেকে চন্দ্রমল্লিকার চারা তৈরি করা যায়। বীজ থেকে চারা করলে তা থেকে ভাল ফুল পাওয়া যায় না এবং ফুল পেতে অনেক দিন লেগে যায়। অন্য দিকে ডাল কেটে শাখা কলম করলে বা সাকার থেকে চারা করলে এই সমস্যা থাকে না। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে শাখা কলম করা শুরু হয়। এক বছর বয়সী সতেজ সবল ডাল থেকে ৮-১০ সেমি লম্বা ডাল তেরচাভাবে কেটে জমিতে বা বালতিতে বসিয়ে দিলে তাতে শিকড় গজায়। ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে যখন ফুল দেওয়া শেষ হয়ে যায় তখন গাছগুলোকে মাটির উপর থেকে ১৫-২০ সেমি রেখে কেটে দিতে হয়। কিছু দিন পর ওসব কাটা জায়গার গোড়া থেকে কিছু সাকার বের হয়। এসব সাকার ৫-৭ সেমি লম্বা হলে মা গাছ থেকে ওদের আলাদা করে ছায়াময় বীজতলায় বা টবে লাগাতে হয় । মে- জুলাই মাসে চারাকে বৃষ্টি ও কড়া রোদ থেকে বাঁচানোর ব্যবস্থা করা জরুরি ।
রোপণ:
শেষবারের মতো নির্দিষ্ট স্থানে কিংবা টবে রোপণের আগে চারাগুলোকে স্বতন্ত্র জমিতে বা টবে পাল্টিয়ে নিয়ে তাদের ফুল উৎপাদনের উপযুক্ততা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। জমি কিংবা টবে চারা রোপণের উপযুক্ত সময় অক্টেবর-নভেম্বর। জাতভেদে ৩০x২৫ অন্তর চন্দ্রমল্লিকা রোপণ করতে হবে।
সার প্রয়োগ:
চন্দ্রমল্লিকা গাছ মাটি থেকে প্রচুর পরিমাণে খাদ্য উপাদন শোষণ করে থাকে। এ কারণে জৈব ও রাসায়নিক খাদ্যযুক্ত মাটিতে এ গাছ খুব ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়। প্রতি হেক্টরে ১০ টন পচা গোবর বা কম্পোস্ট, ৪০০ কেজি ইউরিয়া, ২৭৫ কেজি টিএসপি, ৩০০ কেজি মিউরেট অব পটাশ, ১৬৫ কেজি জিপসাম, ১২ কেজি বোরিক অ্যাসিড ও জিংক অক্সাইড মিশিয়ে সার হিসাবে প্রয়োগ করতে হবে। সাকার রোপণের ১০-১৫ দিন আগে পচা গোবর বা কম্পোস্ট এবং ইউরিয়া বাদে অন্যান্য সার ৭-১০ দিন আগে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। সাকার রোপণের ২৫-৩০ দিন পর ইউরিয়া সারের অর্ধেক প্রয়োগ করতে হবে এবং বাকি অর্ধেক সার সাকার রোপণের ৪৫-৫০ দিন পর গাছের গোড়ার চারপাশে একটু দূর দিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। উপরি প্রয়োগের পর সার মাটির সাথে মিশিয়ে সেচ দিতে হবে।
সেচ:
চন্দ্রমল্লিকার চারা বিকেলে লাগিয়ে গোড়ার মাটি চেপে দিতে হয়। চারা লাগানোর পর হালকা সেচ দিতে হয়। এই গাছ কখনো বেশি জল সহ্য করতে পারে না। তাই এমনভাবে জল দিতে হবে যেন গোড়ায় বেশিক্ষণ জল জমে না থাকে। চারা রোপণের আগে এবং পরে প্রতিদিন নিয়মিতভাবে পরিমাণমতো জল সেচ জরুরি।
কুঁড়ি অপসারণ:
সাধারণত, অপরিপক্ক ফুলের কুঁড়ি অপসারণ করাকে কুঁড়ি অপসারণ বলা হয়। চারা গাছে তাড়াতাড়ি ফুল আসলে তা সঙ্গে সঙ্গে অপসারণ করতে হবে। বড় আকারের ফুল পেতে হলে ডিসবাডিং করা উচিৎ অর্থাৎ মাঝের কুঁড়িটি রেখে পাশের দুটি কুঁড়ি কেটে ফেলতে হয়। আর মধ্যম আকারের ফুল পেতে চাইলে মাঝের কুড়িটি অপসারন করা উচিত।
আরও পড়ুন - জানুন এলাচ চাষের জন্য কেমন মৃত্তিকার প্রয়োজন ও তার চাষের পদ্ধতি
রোগ ও প্রতিকার (Disease Management System):
জাবপোকা:
এ পোকা খুব ছোট আকৃতির ও কালো-সবুজ বর্ণের। শীতকালে এর প্রকোপ খুব বেড়ে যায়। এ পোকা গাছের পাতা, ডগা এবং ফুল থেকে রস চুষে খেয়ে গাছের ক্ষতি করে। আক্রান্ত নতুন কুঁড়ি ও পাতা কুঁকড়ে যায়।
দমন:
প্রথমত, আক্রান্ত পাতা বা ফুল ছিঁড়ে ফেলে পোকাসহ ধ্বংস করা উচিত।সাবান গুঁড়ো ৫ গ্রাম/লিটার জলে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করেও এ পোকা দমন করা যেতে পারে।
শোষক পোকা:
এ পোকা পাতা ও ফুলের রস শোষন করে। ফলে আক্রান্ত পাতা ও ফুলে দাগ পড়ে। এমনকি ফুল এবং গাছও শুকিয়ে যায়।
দমন:
এ পোকা দমনের জন্য ২ মিলি ম্যালাথিয়ন ১ লিটার জলে মিশিয়ে ৭-১০ দিন অন্তর স্প্রে করতে হবে|
পাউডারী মিলডিউ:
এ রোগ হলে গাছের পাতার উপর সাদা থেকে ধূসর গুঁড়ার মতো আবরণ পড়ে এবং পাতা কুঁকড়িয়ে নষ্ট হয়ে যায়। বেশি আক্রমণে পাতা শুকিয়ে গাছ মারা যায়। গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এ রোগ দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
দমন:
মাঠে যথাযথ রোপণ দূরত্ব অনুসরণ করে গাছের জন্য পর্যাপ্ত আলো বাতাস সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। সোডিয়াম বাইকার্বোনেট (যেমন-বেকিং সোডা) ১ লিটার জলে ৫ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৭-১০ দিন পর পর ৩-৫ বার স্প্রে করতে হবে।
ফুল সংগ্রহ:
ফলন নির্ভর করে বিভিন্ন জাতের ওপর ও জাতভেদে ফলন কমবেশি হয়। গাছ প্রতি বছরে গড়ে ৩০-৪০টি ফুল পাওয়া যায়। বাইরের পাপড়িগুলো সম্পূর্ণ খুললে এবং মাঝের পাপড়িগুলো ফুটতে শুরু করলে খুব সকালে বা বিকেলে ছুরি দিয়ে দীর্ঘ বোঁটাসহ কেটে ফুল তোলা উচিত।
নিবন্ধ: রায়না ঘোষ
আরও পড়ুন - জেনে নিন সারাবছর ভুট্টা চাষের সহজ উপায়