উত্তর চব্বিশ পরগণার হিঙ্গলগঞ্জের মামুদপুরে কৃষি জমিতে একই সঙ্গে দেশি জাতের ধানের সঙ্গে সব্জি-ডাল-সরিষা-পাটের পাশাপাশি জমিতে ছোট ছোট পুকুরে চলছে মাছ চাষ। ২০১৬ সাল অবধি মোট ৪,১৯১ জন চাষী তাদের ৩,৩৬৮.২ একর জমিতে জৈব উপায়ে ৫১ প্রকার দেশী জাতের ধান চাষ করে চলেছেন। এছাড়া ৪ টি বীজ ভাণ্ডারে ৩০০ প্রকার দেশী ধানের বীজ সংরক্ষণ করা আছে। যে কোন উৎসাহী চাষী বীজ ভাণ্ডার থেকে উপযুক্ত মূল্যের বিনিময়ে বীজ সংগ্রহ করতে পারে। আলাউদ্দিন আহমেদ মামুদপুর গ্রামের তুষারকান্তি দাস-এর সঙ্গে পরিচয় করালেন। তুষারবাবু মামুদপুর গ্রাম নবদিগন্ত জৈব কৃষক সংঘের নেতা। তুষারবাবু জানালেন, আমাদের গ্রামে খুবই কম সংখ্যক লোক চাকুরীজীবী, বেশীরভাগই কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের এখানে পাটনাই, আসফলে, লালগেঁতু, সাদাগেঁতু, হলদেবাটন, তালমুগুর, হামাই, রূপসাল, দারশাল সহ আরও অনেক রকমের দেশী ধানের চাষ হত। কিন্তু সেই দেশী ধানগুলি হারিয়ে গিয়েছে। তার বদলে চলে এল স্বর্ণ মাসুরীখ, স্বর্ণ প্রতীক্ষা, স্বর্ণ শ্রাবণ, ছিয়ার প্রভৃতি নানান শঙ্কর জাতীয় দেশী ধান। আর এল রাসায়নিক, নানা ধরণের সার ও প্রাণঘাতক কীটনাশক ঔষধ।

এই সকল কীটনাশক মানুষের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের আজকের পরিবেশের নানান ধরণের মাছ, শামুক, গেঁড়ি, পাখী সবই আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। আজকের চাষী জমিতে ৫ কেজির জায়গায় ৩০ কেজি সার দেওয়া সত্ত্বেও চাষীর ফলন দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং নানান ধরণের অসুখে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে এবং কৃষক তার পরিবার ছেড়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। এই গ্রামে ছোট ছোট জমিতে পুকুর কেটে আইল বাঁধ উঁচু করে একই জমিতে দেশীয় ধান-সবজি-ডাল-সরিষা-পাট এবং মাছ চাষের মাধ্যমে মামুদপুর গ্রামের চাষীরা তাদের আয়কে তিনগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। এই গ্রামে প্রতিটি ঘরে ঘুরে দেখা গেল নবদিগন্ত জৈব কৃষক সংঘের উদ্যোগে প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে কম্পোস্ট সার, ভার্মি কম্পোস্ট সার, তরলসার, পঞ্চ গব্য, শস্য গব্য – এই জাতীয় সহজ সরল সার কৃষকরা যাতে তৈরী করে ব্যবহার করতে পারে, তার ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। শেখানো হয় বীজ বাছাই ও শোধন প্রক্রিয়া। গ্রামের মধ্যে চোখে পড়ল স্থানীয় চাষী ও কৃষকদের নেতা তুষারকান্তি দাসের বারিতে বীজ ভাণ্ডার। সেখানে ৩০ রকমের বিভিন্ন দেশীয় ধান বীজ যথা – ধুদেশ্বর, রূপশাল, দারশাল, গোবিন্দভোগ, রাধুনি পাগল, কালা ভাতে খাড়া, রাধাতিলক, কেরালা সুন্দরি, তুলাইপঞ্জি, মুক্তশ্রী, হামাই, তালমুগুর, হরসানোনা, বহুরুপি, কবিরাজশাল ইত্যাদি দেশী ধান বীজ এবং সবজি বীজ সংরক্ষিত আছে। উক্ত বীজ নির্বাচন ও সংরক্ষণের জন্য একটি জমিকে বেছে নিয়ে ‘ধান বৈচিত্র্য এলাকা’ (Rice Biodiversity Block) গড়ে উঠেছে।

এখানে উল্লেখ্য, ধান কাটার এক সপ্তাহ আগে জমিতে কোন সেচ এবং চাষ না দিয়ে জল এবং তৈল বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়, একে বলা হয় গ্রাম বাংলায় – ‘পয়রা চাষ’। এলাকার চাষী প্রভাষ পণ্ডিত জানালেন – ‘ আমার তিন বিঘা জমিতে ইতিমধ্যে ২৫,০০০ টাকার সবজি বিক্রি হয়েছে। ধান কাটার পর ধানের মূল্য হিসাবে আনুমানিক আরও ২৫,০০০ টাকা পেতে পারি। এছাড়াও আছে মাছ বিক্রির টাকা। জমির মধ্যে ছোট ছোট পুকুরগুলিতে চাষ হয় – গলদা চিংড়ি, মৌরলা, শোল, কই, ট্যাংরা ও সাদা মাছ (পোনা) ইত্যাদি। এগুলি বাজারজাত করে এখান থেকেও আয় হয়। মামুদপুর গ্রামে নবদিগন্ত জৈব কৃষক সংঘের উদ্যোগে চাষ আবাদ হয় সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতি অবলম্বন করে। কোন রাসায়নিক সার এবং কোন রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে এই চাষ আবাদ হয়। এটি পশ্চিমবঙ্গের চাষী ভাইদের কাছে এক নতুন দৃষ্টান্ত। এলাকার চাষীরা একত্রে বলেন- "আলাউদ্দিন আহমেদ সাহেব আমাদের ধান চাষের সঙ্গে সবজি ও মাছ চাষের যে নতুন দিশা দেখিয়েছেন, সেজন্য আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ”।

তবে তাঁরা জানান যে তাঁদের দুঃখ হল – "ধান, সবজি বিক্রির জন্য স্থানীয় ভাবে কোন বাজার না থাকায় আমরা ফসল উৎপাদন করেও উপযুক্ত দাম পাচ্ছি না। সরকারের কাছে আমাদের দাবি – ‘আমরা যাতে আমাদের উৎপাদিত ফসলের উপযুক্ত দাম পাই, তার সুব্যবস্থা সরকারী ভাবে হলে ভালো হয়’। উৎসাহী যে কোন চাষী এই নতুন পদ্ধতির বিষয়ে বিশদে জানতে যোগাযোগ করতে পারেন- তুষারকান্তি দাস (মামুদপুর, নবদিগন্ত জৈব কৃষক সংঘ) –এর সঙ্গে। চলভাষ – ৯০৬৪৫৫৪১৫০।
স্বপ্নম সেন (swapnam@krishijagran.com)
তথ্যসূত্র - ইকবাল দরগাই
Share your comments