
বাগান করা বা গাছের পরিচর্যা করা মানুষের একটা খুব সাধারণ শখ। অনেকেই দুর্লভ প্রজাতির গাছ নিজেদের সংগ্রহে রাখতে ভালবাসেন। কিন্তু বিশাল বড় বড় আকৃতির গাছকে ছোট আকারে পরিণত করে সেটাকে টবে সাজিয়ে রাখাও একটা শখ বা শিল্প।
এই শিল্পের নাম বনসাই । বনসাই শব্দটি সম্ভবত অনেকের কাছেই পরিচিত। অনেকে বাহারি দোকান থেকে মনোরম বনসাই কিনে বারান্দায় কী ঘরের কোনার শোভা বর্ধন করেন। ছোট এই বামনাকারের গাছ তৈরির পেছনেও কিন্তু রয়েছে ইতিহাস।
বনসাই (বানজাই বা বনজাই) শব্দটি একটি জাপানি শব্দ, যার বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘জীবন্ত ভাস্কর্য’। স্বাভাবিকভাবে তাই বনসাইকে জাপানে উদ্ভূত একটি শিল্প বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু খুব অবাক করা ব্যাপার হলো, বনসাইয়ের প্রচলন আসলে শুরু হয় চীন দেশে। প্রায় ২০০০ বছরেরও বেশি সময় আগে থেকে চৈনিক সাম্রাজ্যের সময়ে সেখানকার লোকজন ছোট ছোট পাত্রে খর্বাকৃতির গাছ চাষের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে জাপানি জেন বৌদ্ধগোষ্ঠী একে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যায়।

যে দেশের মানুষের ফুল আর উদ্যানের প্রতি বরাবর দুর্বলতা, সে দেশে বনসাইয়ের মতন একটা শিল্পের আবিষ্কার কাকতালীয় কিছু নয়, বরঞ্চ এটাই স্বাভাবিক। তবে বনসাইয়ের আবির্ভাব নিয়ে অনেক চমকপ্রদ কিছু ধারণা রয়েছে চীনাদের মধ্যে।
অনেককাল আগে চীনের আকাশসমান উঁচু পাহাড়গুলোতে ছোট ছোট কিছু গাছের জন্ম হতো। আকারে ছোট হলেও সেগুলোর চেহারা বড় বড় গাছের মতোই। সংগ্রহ করা প্রায় অসাধ্য বিধায় এই গাছগুলো ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। তখনকার চীনের ‘তাও’ ধর্মাবলম্বীরা মনে করতেন, যদি মানুষের হাত দিয়ে বৃহদাকার গাছের অতিক্ষুদ্র প্রতিরূপ তৈরি করা যায়, তাতে এর মধ্যে একধরনের অতিপ্রাকৃতিক শক্তি এসে জমা হবে। এভাবে ধীরে ধীরে প্রচলন হলো ‘পেনজাই’ বা ‘পোনজাই’ শিল্পের।

‘পেন’ বা ‘প্যান’ মানে হলো একধরনের বারকোশ, ইংরেজিতে যাকে আমরা ট্রে বলে জানি। তবে এই বিশেষ ট্রে তৈরি হত সাধারণ মাটি বা পোড়ামাটি দিয়ে। প্রায় ৫০০০ বছরেরও বেশি আগে চীনারা মৃৎশিল্পে অনেক এগিয়ে যায় অন্যদের তুলনায়। চৈনিক ‘পেনজাই’ শব্দের মানে দাঁড়ায় ট্রে-তে চাষ করা বৃক্ষ। ছোট ছোট ট্রে-তে বামনাকৃতির গাছ বৃদ্ধির সাথে সেখানে পাথর, মাটি আর ঘাস দিয়ে ছোটখাট একটি ভূদৃশ্যের অবতারণা করা হতো।
চীনারা ইচ্ছে করেই বনসাই গাছগুলোকে এমনভাবে বাঁধতেন আর ছাঁটাই করতেন যেন এগুলো দেখে বয়স্ক মনে হয়। সত্যিই, মোচড়ানো চামড়া আর সর্পিল শেকড়-বাকড় দেখে বনসাইকে মনে হয় অশীতিপর বৃদ্ধের তোবড়ানো গাল। অনেকে আবার মনে করেন, তাও ধর্মের লোকেরা ইচ্ছাকৃতভাবে গাছের ডালপালা, কান্ড আর শেকড়ের গঠন এভাবে তৈরি করেন, যেন তা চীনদেশের পৌরাণিক ড্রাগন, সাপ ও অন্যান্য জীবের সাথে মিলে যায়। অবশ্য অনেকের ধারণা, বনসাইয়ের এমন মোচড়ানো আকৃতি নাকি আসলে ইয়োগা বা যোগব্যায়ামের বিভিন্ন কসরতের সঙ্গে মিলিয়ে বানানো হয়েছে।
- রুনা নাথ
Share your comments