ভারতবর্ষ মূলত কৃষি প্রধান দেশ। কৃষিই দেশের ক্রমবর্ধিত জনসংখ্যার জন্য নিরন্তর খাদ্যের যোগানকে সুনিশ্চিত করে। ডাল শস্য হল মূলত শুটি জাতীয় একটি ফসল। মানব শরীরে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন সরবরাহে ডাল মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ভারতবর্ষে মূলত গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন এই দুই ধরনের ডাল শস্য চাষ হয়ে থাকে। শীতকালীন ডালের মধ্যে মুসুর , খেসারি, ছোলা ও মটরের ডাল উল্লেখযোগ্য। ডালের বিবিধ গুণাবলীর মধ্যে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ। ডাল জাতীয় ফসলের গাছের শিকড়ে অবস্থিত গুটির মধ্যে থাকা রাইজোবিয়াম জীবাণু বাতাসের নাইট্রোজেন সংগ্রহ করে প্রতি হেক্টরে প্রায় ৪০- ৬০ কেজি নাইট্রোজেন যোগ করে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে । এছাড়াও ডালের খোসা গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবেও কাজে লাগে।
পতিত জমিতে ডাল শস্য চাষের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। ভারতবর্ষে প্রধানত বর্ষাকালীন ধান চাষের পরবর্তী সময়ে নিচু জমি গুলি ফাঁকা পড়ে থাকে। মূলত বর্ষাকাল চলে যাওয়ার পর জলের অভাবে অর্থকারী অন্যান্য ফসল চাষ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে চাষি ভাইদের কাছে । দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় ১৫ মিলিয়ন হেক্টর পতিত জমির মধ্যে ভারতেই প্রায় ৭৯ % ( ১১.৬৫ মিলিয়ন হেক্টর ) এহেন পতিত জমি বিদ্যমান। এখানেই শীতকালীন ডাল শস্যের কার্যকারিতা , কারণ ধান চাষের পরবর্তী সময়ে পতিত জমিতে যে অবশিষ্ট আর্দ্রতা থাকে শুধুমাত্র সেইটুকু আদ্রতায় ডাল শস্য চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জলের অনেকাংশেই যোগান দিয়ে থাকে । পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন জেলাতে পতিত জমির আধিক্য রয়েছে। এরমধ্যে নদিয়া, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পূর্ব বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর উল্লেখযোগ্য, যেখানে শীতকালীন ডালশস্য চাষের গুরুত্ব অপরিসীম ।
মুসুর ডাল পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতবর্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ ডাল শস্য কারণ এতে প্রায় ২৫-২৬ % শতাংশ প্রোটিন থাকায় খাদ্যগুণ অনেক। ভারতবর্ষে প্রায় ১৬ লক্ষ হেক্টর জমিতে মুসুর ডাল চাষ হয় এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৯.৫ লক্ষ টন। ২০১৯ -২০ সালে পশ্চিমবঙ্গে ০.১৭ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ০.১৪ মিলিয়ন টন মুসুর উৎপাদিত হয়েছে। রবি মরশুমে ধান পরবর্তী পতিত জমিতে মুসুর চাষ বর্তমানে ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে পতিত জমিতে শীতকালীন মুসুর ডাল চাষের প্রযুক্তিগত পদ্ধতি গুলির সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ :
জমি নির্বাচন (Land selection) –
জলা জমিতে মুসুর চাষ ভাল হয় না। তাই জল নিকাশের সুবিধাযুক্ত দোয়াশ বা বেলে মাটি দরকার।
জলবায়ু (Climate) –
২০ - ২৯ ° সেলসিয়াস তাপমাত্রা মুসুর চাষের জন্য অনুকূল। শীতকালীন ফসল হওয়া সত্ত্বেও এদের বৃদ্ধি ৪.৫ ° সেলসিয়াস তাপমাত্রার নীচে স্তব্ধ হয়ে যায়। ৪০ ° সেলসিয়াস তাপমাত্রার ঊর্ধ্বে ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুসুর চাষে ফুল আসার সময় বৃষ্টি অথবা জলসেচ দেওয়া হলে বৃদ্ধি দশা পুনরায় ফিরে আসে এবং ফলনের ক্ষতি করে।
পয়রা ফসল হিসেবে মুসুর চাষের পদ্ধতি (Cultivation Method) :
বর্ষাকালীন বা খরিফ মরসুমের ধান কাটার অন্তত ১০-১২ দিন আগে ওই একই জমিতে পরবর্তী ফসল হিসেবে মুসুরের বীজ ছিটিয়ে বোনা হয়, যাতে জমি পতিত পড়ে না থাকে এবং জমির অবশিষ্ট আর্দ্রতায় বীজগুলি অঙ্কুরিত হতে পারে। ইহাই ‘পয়রা ফসল চাষ পদ্ধতি’।
জাত (Variety) –
পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বর্তমান চাষ হওয়া মুসুরের কিছু উন্নত জাত হলো মৈত্রী (WBL77), সুব্রত (WBL 58), এইচ ইউ এল ৫৭, পিএল ৪০৬, এল ৪৭১৭, এল ৪৭২৭, আইপিএল ২২০, আইপিএল ৫২৬ ইত্যাদি ।
বীজ শোধন -
ছত্রাকের আক্রমণ দমন করার জন্য মুসুরের বীজ বপন করার প্রায় এক সপ্তাহ আগে প্রতি কেজি বীজের জন্য কার্বেন্ডাজিম ; থাইরাম ১ : ২ অনুপাতে মিশ্রণ প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে শোধন করা দরকারি।
জীবাণু সার –
রাইজোবিয়াম লেগুমিনোসেরাম মোটামুটি ৪ কেজি বীজের জন্য ২০০ গ্রাম জীবাণু সার জলের সাথে মিশিয়ে অথবা গুড় বা আঠাজাতীয় দ্রব্যের সাথে নিয়ে লেই তৈরি করে বীজের গায়ে মাখিয়ে কিছুক্ষণ ছায়াযুক্ত জায়গাতে শুকিয়ে নিতে হবে।
বীজ বপন (Seed Sowing) –
কার্তিক মাসের মাঝামাঝি থেকে অঘ্রানের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিঘা প্রতি ৪-৬ কেজি বীজ ছিটিয়ে কিংবা সারিতে দূরত্ব বজায় রেখে পতিত জমিতে বোনা হয়।
সার প্রয়োগ –
২০ : ৪০ : ৪০ কেজি নাইট্রোজেন : ফসফরাস : পটাশ প্রতি হেক্টর জমিতে মূল সার হিসেবে জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে ইউরিয়া, সিঙ্গেল সুপার ফসফেট ও মিউরিয়েট অফ পটাশ সারের মাধ্যমে। এছাড়াও পয়রা পদ্ধতিতে বোনার ক্ষেত্রে ২ % ইউরিয়া দ্রবণ বোনার ৪৫ - ৫০ দিন পর ফুল আসার আগে ভালো করে স্প্রে করলে ফলন অধিক পাওয়া যায় ।
অনুখাদ্য –
৪০ - ৫০ দিনের মাথায় ০.২ % বোরাক্স এবং ০.৫ % জিংক সালফেট জলে মিশিয়ে স্প্রে করা উচিত।
জলসেচ –
জমিতে রস না থাকলে বা কম থাকলে একটি হালকা সেচ দিয়ে বীজ বোনা যেতে পারে। ফুল আসার আগে একবার হালকা সেচ দিলে ফলন অনেক সময় ভালো হয়।
অন্তর্বর্তী পরিচর্যা -
বীজ বপনের ৩০ ও ৬০ দিনের মাথায় নিড়ানির সাহায্যে আগাছা পরিষ্কার আবশ্যক। প্রথম নিড়ানির সময় সবল গাছগুলির নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বাকি গাছ পাতলা করে দিতে হবে।
রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ -
১. ছত্রাকজনিত গাছ ঝলসানো রোগ নিয়ন্ত্রণ - ম্যানকোজেব (২.৫ গ্রাম) / কবজ (২ গ্রাম) প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ।
২. ঢলে পড়া রোগ নিয়ন্ত্রণ - কার্বেন্ডাজিম (১ গ্রাম) বা ম্যানকোজেব (২.৫ গ্রাম) প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে ।
পোকার মধ্যে শুটি ছিদ্রকারী পোকা ও বাদামি জাব পোকা দমনের জন্য এসিফেট (০.৭৫ গ্রাম) বা ইমিডাক্লোপ্রিড (০.২ মিলিলিটার) প্রতি লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে।
ফসল তোলা –
শুটি পেকে গেলে বাদামি বর্ণ হয় এবং পাতা শুকিয়ে যেতে থাকে। এই সময় ফসল ভোরের দিকে কেটে নিলে ফলন ভালো হয়। কাটা ফসল ভালোভাবে ঝাড়াই করে দানা আলাদা করে নিতে হয় ।
আরও পড়ুন - Dry Land Farming - খরা প্রবণ অঞ্চলে কৃষকরা কীভাবে কৃষিকাজ করবেন? রইল বিস্তারিত পদ্ধতি
ফলন –
উপরোক্ত প্রযুক্তিগত পদ্ধতি অবলম্বন করলে ধান পরবর্তী পতিত জমিতে শীতকালীন মুসুর চাষ করে ১১০-১২০ দিনে বিঘা প্রতি ১৫০-১৬০ কেজি ফলন পাওয়া যায় যা ৬০ - ৭০ টাকা কেজি দামে বিক্রি করা যায়।
আরও পড়ুন - Moringa Cultivation – বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে লাভজনক সজিনা চাষের নির্দেশিকা
Share your comments