সকল কৃষক ভাইদের নিজস্ব জমি থাকে না, অনেকেই চুক্তিগতভাবে চাষ করে থাকেন, পরবর্তীতে সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী জমি ক্রয় করেন। শুধু কৃষকবন্ধুরাই নয়, আমরাও অনেক সময় জমি কিনে নিজেদের বসত বাড়ি তৈরি করি। কিন্তু এ সম্পর্কে সকল তথ্য অবগত না হওয়ায় সম্ভবনা রয়েছে ঠকে যাওয়ার বা কারোর ভ্রান্ত তথ্যের শিকার হওয়ার। তাই জমি ক্রয়ের আগে জেনে নিন জমি সংক্রান্ত এই বিশেষ পরিভাষাগুলি।
খতিয়ান (Khatiyan) –
মৌজা ভিত্তিক এক বা একাধিক ভূমি মালিকের ভূ-সম্পত্তির বিবরণ সহ যে ভূমি রেকর্ড (Land Record) জরিপকালে প্রস্ত্তত করা হয় তাকে খতিয়ান বলে। এতে ভূমধ্যাধিকারীর নাম ও প্রজার নাম, জমির দাগ নং, পরিমাণ, প্রকৃতি, খাজনার হার ইত্যাদি লিপিবদ্ধ থাকে। আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের খতিয়ানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তন্মধ্যে সিএস, এসএ এবং আরএস উল্লেখযোগ্য। ভূমি জরিপকালে ভূমি মালিকের মালিকানা নিয়ে যে বিবরণ প্রস্তুত করা হয় তাকে “থতিয়ান” বলে। খতিয়ান প্রস্তত করা হয় মৌজা ভিত্তিক।
সি এস খতিয়ান –
১৯১০-২০ সনের মধ্যে সরকারি আমিনগণ প্রতিটি ভূমিখণ্ড পরিমাপ করে উহার আয়তন, অবস্থান ও ব্যবহারের প্রকৃতি নির্দেশক মৌজা নকশা এবং প্রতিটি ভূমিখন্ডের মালিক দখলকারের বিররণ সংবলিত যে খতিয়ান তৈরি করেন সিএস খতিয়ান নামে পরিচিত।
এস এ খতিয়ান -
১৯৫০ সালের জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাসের পর সরকার জমিদারি অধিগ্রহণ করেন। তৎপর সরকারি জরিপ কর্মচারীরা সরেজমিনে মাঠে না গিয়ে সিএস খতিয়ান সংশোধন করে যে খতিয়ান প্রস্তুত করেন তা এসএ খতিয়ান নামে পরিচিত। কোনো অঞ্চলে এ খতিয়ান আর এস খতিয়ান নামেও পরিচিত। বাংলা ১৩৬২ সালে এই খতিয়ান প্রস্তুত হয় বলে বেশির ভাগ মানুষের কাছে এসএ খতিয়ান ৬২র খতিয়ান নামেও পরিচিত।
আর এস খতিয়ান -
একবার জরিপ হওয়ার পর তাতে উল্লেখিত ভুলত্রুটি সংশোধনের জন্য পরবর্তীতে যে জরিপ করা হয় তা আরএস খতিয়ান নামে পরিচিত। দেখা যায় যে, এসএ জরিপের আলোকে প্রস্তুতকৃত খতিয়ান প্রস্তুতের সময় জরিপ কর্মচারীরা সরেজমিনে তদন্ত করেনি। তাতে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়ে গেছে। ওই ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার জন্য সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরেজমিনে ভূমি মাপ-ঝোঁক করে পুনরায় খতিয়ান প্রস্তুত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই খতিয়ান আরএস খতিয়ান নামে পরিচিত। সারাদেশে এখন পর্যন্ত তা সমাপ্ত না হলেও অনেক জেলাতেই আরএস খতিয়ান চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
সরকারি আমিনরা মাঠে গিয়ে সরেজমিনে জমি মাপামাপি করে এই খতিয়ান প্রস্তুত করেন বলে তাতে ভুলত্রুটি কম লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের অনেক এলাকায় এই খতিয়ান বি এস খতিয়ান নামেও পরিচিত।
বি এস খতিয়ান -
সর্বশেষ এই জরিপ ১৯৯০ সালে পরিচালিত হয়। ঢাকা অঞ্চলে মহানগর জরিপ হিসাবেও পরিচিত।
দলিল (Land Record) -
যে কোন লিখিত বিবরণ আইনগত সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণযোগ্য তাকে দলিল বলা হয়। তবে রেজিস্ট্রেশন আইনের বিধান মোতাবেক জমি ক্রেতা এবং বিক্রেতা সম্পত্তি হস্তান্তর করার জন্য যে চুক্তিপত্র সম্পাদন ও রেজিস্ট্রি করেন সাধারন ভাবেতাকে দলিল বলে।
খানাপুরি -
জরিপের সময় মৌজা নক্সা প্রস্তুত করার পর খতিয়ান প্রস্তুতকালে খতিয়ান ফর্মের প্রত্যেকটি কলাম জরিপ কর্মচারী কর্তৃক পূরন করার প্রক্রিয়াকে খানাপুরি বলে।
নামজারি -
ক্রয়সূত্রে/উত্তরাধিকার সূত্রে অথবা যেকোন সূত্রে জমির নতুন মালিক হলে নতুন মালিকের নাম সরকারি খতিয়ানভুক্ত করার প্রক্রিয়াকে নামজারী বলা হয়।
তফসিল -
জমির পরিচয় বহন করে এমন বিস্তারিত বিবরণকে “তফসিল” বলে। তফসিলে, মৌজার নাম, নাম্বার, খতিয়ার নাম্বার, দাগ নাম্বার, জমির চৌহদ্দি, জমির পরিমাণ সহ ইত্যাদি তথ্য সন্নিবেশ থাকে।
“দাগ” নাম্বার/ কিত্তা -
দাগ শব্দের অর্থ ভূমিখ-। ভূমির ভাগ বা অংশ বা পরিমাপ করা হয়েছে এবং যে সময়ে পরিমাপ করা হয়েছিল সেই সময়ে ক্রম অনুসারে প্রদত্ত ওই পরিমাপ সম্পর্কিত নম্বর বা চিহ্ন।
যখন জরিপ ম্যাপ প্রস্তুত করা হয় তখন মৌজা নক্সায় ভূমির সীমানা চিহ্নিত বা সনাক্ত করার লক্ষ্যে প্রত্যেকটি ভূমি খন্ডকে আলাদা আলাদ নাম্বার দেয়া হয়। আর এই নাম্বারকে দাগ নাম্বার বলে। একেক দাগ নাম্বারে বিভিন্ন পরিমাণ ভূমি থাকতে পারে। মূলত, দাগ নাম্বার অনুসারে একটি মৌজার অধীনে ভূমি মালিকের সীমানা খূটিঁ বা আইল দিয়ে সরেজমিন প্রর্দশন করা হয়। দাগকে কোথাও কিত্তা বলা হয়।
“ছুটা দাগ” -
ভূমি জরিপকালে প্রাথমিক অবস্থায় নকশা প্রস্তুত অথবা সংশোধনের সময় নকশার প্রতিটি ভূমি এককে যে নাম্বার দেওয়া হয় সে সময় যদি কোন নাম্বার ভুলে বাদ পড়ে তাবে ছুটা দাগ বলে। আবার প্রাথমিক পর্যায়ে যদি দুটি দাগ একত্রিত করে নকশা পুন: সংশোধন করা হয় তখন যে দাগ নাম্বার বাদ যায় তাকেও ছুটা দাগ বলে।
পর্চা -
ভূমি জরিপকালে চূড়ান্ত খতিয়ান প্রস্তত করার পূর্বে ভূমি মালিকদের নিকট খসড়া খতিয়ানের যে অনুলিপি ভুমি মালিকদের প্রদান করা করা হয় তাকে “মাঠ পর্চা” বলে। এই মাঠ পর্চা রেভিনিউ/রাজস্ব অফিসার কর্তৃক তসদিব বা সত্যায়ন হওয়ার পর যদি কারো কোন আপত্তি থাকে তাহলে তা শোনানির পর খতিয়ান চুড়ান্তভাবে প্রকাশ করা হয়। আর চুড়ান্ত খতিয়ানের অনুলিপিকে “পর্চা” বলে।
চিটা -
একটি ক্ষুদ্র ভূমির পরিমাণ, রকম ইত্যাদির পূর্ণ বিবরণ চিটা নামে পরিচিত। বাটোয়ারা মামলায় প্রাথমিক ডিক্রি দেয়ার পর তাকে ফাইনাল ডিক্রিতে পরিণত করার আগে অ্যাডভোকেট কমিশনার সরেজমিন জমি পরিমাপ করে প্রাথমিক ডিক্রি মতে সম্পত্তি এমনি করে পক্ষদের বুঝায়ে দেন। ওই সময় তিনি যে খসড়া ম্যাপ প্রস্তুত করেন তা চিটা বা চিটাদাগ নামে পরিচিত।
দখলনামা -
দখল হস্তান্তরের সনদপত্র। সার্টিফিকেট জারীর মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি কোনো সম্পত্তি নিলাম খরিদ করে নিলে সরকার পক্ষ সম্পত্তির ক্রেতাকে দখল বুঝিয়ে দেয়ার পর যে সনদপত্র প্রদান করেন তাকে দখলনামা বলে।
সরকারের লোক সরেজমিনে গিয়ে ঢোল পিটিয়ে, লাল নিশান উড়ায়ে বা বাঁশ গেড়ে দখল প্রদান করেন। কোনো ডিক্রিজারির ক্ষেত্রে কোনো সম্পত্তি নিলাম বিক্রয় হলে আদালত ওই সম্পত্তির ক্রেতাকে দখল বুঝিয়ে দিয়ে যে সার্টিফিকেট প্রদান করেন তাকেও দখলনামা বলা হয়। যিনি সরকার অথবা আদালতের নিকট থেকে কোনো সম্পত্তির দখলনামা প্রাপ্ত হন, ধরে নিতে হবে যে, দখলনামা প্রাপ্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট সম্পত্তিতে দখল আছে।
“খাজনা” -
সরকার বার্ষিক ভিত্তিতে যে প্রজার নিকট থেকে ভূমি ব্যবহারের জন্য যে কর আদায় করে তাকে খাজনা বলে।
বয়নামা -
১৯০৮ সালের দেওয়ানি কার্যবিধির ২১ আদেশের ৯৪ নিয়ম অনুসারে কোনো স্থাবর সম্পত্তির নিলাম বিক্রয় চূড়ান্ত হলে আদালত নিলাম ক্রেতাকে নিলামকৃত সম্পত্তির বিবরণ সংবলিত যে সনদ দেন তা বায়নামা নামে পরিচিত।বায়নামায় নিলাম ক্রেতার নামসহ অন্যান্য তথ্যাবলি লিপিবদ্ধ থাকে। কোনো নিলাম বিক্রয় চূড়ান্ত হলে ক্রেতার অনুকূলে অবশ্যই বায়নামা দিতে হবে। যে তারিখে নিলাম বিক্রয় চূড়ান্ত হয় বায়নামায় সে তারিখ উল্লেখ করতে হয়।
জমাবন্দি -
জমিদারি আমলে জমিদার বা তালুকদারের সেরেস্তায় প্রজার নাম, জমি ও খাজনার বিবরণী লিপিবদ্ধ করার নিয়ম জমাবন্দি নামে পরিচিত। বর্তমানে তহশিল অফিসে অনুরূপ রেকর্ড রাখা হয় এবং তা জমাবন্দি নামে পরিচিত।
দাখিলা -
সরকার বা সম্পত্তির মালিককে খাজনা দিলে যে নির্দিষ্ট ফর্ম বা রশিদ ( ফর্ম নং১০৭৭) প্রদান করা হয় তা দাখিলা বা খাজনার রশিদ নামে পরিচিত। দাখিলা কোনো স্বত্বের দলিল নয়, তবে তা দখল সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ বহন করে।
DCR -
ভূমি কর ব্যতিত আন্যান্য সরকারি পাওনা আদায় করার পর যে নির্ধারিত ফর্মে (ফর্ম নং ২২২) রশিদ দেওয়া হয় তাকে DCR বলে।
“কবুলিয়ত” -
সরকার কর্তৃক কৃষককে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার প্রস্তাব প্রজা কর্তৃক গ্রহণ করে খাজনা প্রদানের যে অঙ্গিকার পত্র দেওয়া হয় তাকে কবুলিয়ত বলে।
“ফারায়েজ” -
ইসলামি বিধান মোতাবেক মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি বন্টন করার নিয়ম ও প্রক্রিয়াকে ফারায়েজ বলে।
“ওয়ারিশ” -
ওয়ারিশ অর্থ উত্তরাধিকারী । ধর্মীয় বিধানের অনুয়ায়ী কোন ব্যক্তি উইল না করে মৃত্যু বরন করলেতার স্ত্রী, সন্তান বা নিকট আত্মীয়দের মধ্যে যারা তার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে মালিক হওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণকে ওয়ারিশ বলে।
হুকুমনামা -
আমলনামা বা হুকুমনামা বলতে জমিদারের কাছ থেকে জমি বন্দোবস্ত নেয়ার পর প্রজার স্বত্ব দখল প্রমাণের দলিলকে বুঝায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে জমিদার কর্তৃক প্রজার বরাবরে দেয়া জমির বন্দোবস্ত সংক্রান্ত নির্দেশপত্রই আমলনামা।
জমা -
জমা খারিজ অর্থ যৌথ জমা বিভক্ত করে আলাদা করে নতুন খতিয়ান সৃষ্টি করা। প্রজার কোন জোতের কোন জমি হস্তান্তর বা বন্টনের কারনে মূল খতিয়ান থেকে কিছু জমি নিয়ে নুতন জোত বা খতিয়ান খোলাকে জমা খারিজ বলা হয়। অন্য কথায় মূল খতিয়ান থেকে কিছু জমির অংশ নিয়ে নতুন জোত বা খতিয়ান সৃষ্টি করাকে জমা খারিজ বলে।
“মৌজা” -
CS জরিপ / ক্যাডষ্টাল জরিপ করা হয় তখন থানা ভিত্তিক এক বা একাধিক গ্রাম, ইউনিয়ন, পাড়া, মহল্লা আলাদা করে বিভিন্ন এককে ভাগ করে ক্রমিক নাম্বার দিয়ে চিহ্তি করা হয়েছে। আর বিভক্তকৃত এই প্রত্যেকটি একককে মৌজা বলে।। এক বা একাধিক গ্রাম বা পাড়া নিয়ে একটি মৌজা গঠিত হয়।
“আমিন” -
ভূমি জরিপের মাধ্যমে নক্সা ও খতিয়ান প্রস্তত ও ভূমি জরিপ কাজে নিজুক্ত কর্মচারীকে আমিন বলে।
“কিস্তোয়ার” -
ভূমি জরিপ কালে চতুর্ভুজ ও মোরব্বা প্রস্তত করার পর সিকমি লাইনে চেইন চালিয়ে সঠিকভাবে খন্ড খন্ড ভুমির বাস্তব ভৌগলিক চিত্র অঙ্কনের মাধ্যমে নকশা প্রস্তুতের পদ্ধতিকে কিস্তোয়ার বলে।
“সিকস্তি” -
নদী ভাংঙ্গনের ফলে যে জমি নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যায় তাকে সিকন্তি বলে। সিকস্তি জমি যদি ৩০ বছরের মধ্যে স্বস্থানে পয়ন্তি হয় তাহলে সিকস্তি হওয়ার প্রাক্কালে যিনি ভূমি মালিক ছিলেন তিনি বা তাহার উত্তরাধিকারগন উক্ত জমির মালিকানা শর্ত সাপেক্ষ্যে প্রাপ্য হবেন।
“পয়ন্তি” -
নদী গর্ভ থেকে পলি মাটির চর পড়ে জমির সৃষ্টি হওয়াকে পয়ন্তি বলে।
Share your comments