সজিনার গাছটির প্রতি আমাদের তেমন আগ্রহ না থাকলেও এর ডাঁটার প্রতি আগ্রহ নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমরা জানি সবজি মাত্রই পুষ্টিকর খাদ্য। তবে সজিনা শুধু পুষ্টিকর সবজি নয়, এটি ঔষধি বৃক্ষও বটে। এছাড়া সজিনার ফুল ও পাতা শুধু শাক হিসেবেই নয়, পশু খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার হয়ে থাকে।
সজিনা সবজিতে ক্যালসিয়াম, খনিজ লবণ আয়রণসহ প্রোটিন ও শর্করা জাতীয় উপাদান রয়েছে। এ ছাড়া ভিটামিন এ বি সি সমৃদ্ধ সজনে ডাঁটা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত উপকারি। সজনের বাকল, শিকড়, ফুল, ফল, পাতা, বীজ এমনকি এর আঠাতেও ওষুধি গুণ আছে। সজনে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করে। সজনের ডাঁটা পক্স বা বসন্ত রোগের প্রতিরোধক হিসেবে খুবই উপযোগী।শ্বাসকষ্ট, মাথাধরা এবং মাইগ্রেন চিকিৎসায় সজনে ভাল কাজ করে। সজনের কচি পাতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর পাতা শাক হিসেবে ব্যবহার করা যায়, এতে শারীরিক শক্তি ও আহারের রুচির উন্নতি হয়। পোকার কামড়ে অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে সজনে পাতার রস ব্যবহার হয়। শরীরের পুষ্টির জন্য গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়েদের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে বলে সজনে ডাঁটা ঔষধি সবজি হিসাবেও এর চাহিদা অপরিসীম। এছাড়া গাছের বাকল ও পাতা রক্তামাশায় পেটের পীড়া, উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে মাথা ব্যথায় সজনের কচি পাতা কপালের দুই পাশে ঘষলে ব্যথা উপশম হয়। সজনে গ্যাস্টিক রোগের বায়ুনাশক হিসেবে কাজ করে। পাতার রস হৃদরোগ চিকিৎসায় এবং রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যবহার হয়। শ্বেতীরোগ, টাইফয়েড জ্বর, প্যারালাইসিস এবং লিভারের রোগে সজনের রস উপকার। ক্ষতস্থান সারার জন্য সজনে পাতার পেষ্ট কার্যকরি। ভারত, চীনসহ পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে সজনে পাতার পাউডার দিয়ে তৈরি ক্যাপসুল বাণিজ্যিক ভাবে বাজারজাত করছে।
সজনের জাত (Variety) -
আমাদের দেশে সজনে ডাঁটা প্রধানত দুই প্রজাতির। এর মধ্যে এক প্রজাতির সজনে বছরে একবার ফলন পাওয়া যায়। এই সজনের দুটি জনপ্রিয় জাত হল পি.কে.এম -১ ও পি.কে.এম -২ । স্থানীয়ভাবে আরো একটি প্রজাতির নাম বারোমাসি সজনে বা নাজনে। বারোমাসি সজিনার জাত বছরে প্রায় তিন-চার বার ফলন দেয়।
মাটি ও জলবায়ু (Soil & Climate) -
সজিনা চরম প্রাকৃতিক অবস্থা সহ্য করতে সক্ষম, তবে ২০ হতে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সজনে চাষের জন্য উপযোগী। যেসব এলাকায় ২৫০ হতে ১৫০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় সেখানে এই গাছ ভাল জন্মায়। মাটি বেলে দোঁআশ হতে দোয়াঁশ এবং পি.এইচ ৫.০ হতে ৯.০ সম্পন্ন মাটি সহ্য করতে পারে। এটি জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। সজিনা চাষে সারের তেমন প্রয়োজন হয়না। কারণ সজিনার বিস্তৃত ও গভীর শিকড় রয়েছে। তবে ইউরিয়া এবং জৈব সার প্রয়োগ করলে গাছ ভাল হয়। সজনে গাছ যে কোনো পতিত জমি, পুকুর পাড় রাস্তা বা বাঁধের ধারে যে কোনো ফাঁকা জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে লাগানো যায়।
সজিনার বপন/রোপণ প্রযুক্তি (Plantation) -
প্রতিটি লম্বা সজিনার ফলে ১০-১৫ টি বীজ থাকে, এগুলো তিন শিরাবিশিষ্ট এবং ত্রিভুজাকৃতির হয়। বীজ থেকে বংশবিস্তার সম্ভব হলেও অঙ্গজ বা কাটিং (Cutting) থেকে নতুন চারা তৈরি করাই সহজ এবং উত্তম।
বীজ থেকে বংশবিস্তার-
আমাদের দেশে বীজ থেকে চারা তৈরি করে চাষাবাদের রীতি এখনও পর্যন্ত অনুসরণ করা হয়না। কারণ বীজ থেকে চারা তৈরি ব্যয়বহুল, কষ্ঠসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। বীজের মাধ্যমে বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রে এপ্রিল-মে মাসে গাছ থেকে পাকা ফল সংগ্রহ করতে হবে, তারপর সেটিকে হালকা রৌদ্রে শুকিয়ে ফাটলে বীজ পাওয়া যাবে। এ বীজ শুকনো বায়ুরোধী পাত্রে ১-৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখা যায়। তারপর জুলাই-আগষ্ট মাসে বীজ তলায় অথবা পলি ব্যাগে বপন করতে হবে। তবে বীজ বপনের আগে বীজগুলোকে ২৪ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। এতে বীজ থেকে চারা গজাতে সুবিধা হয়। বীজ থেকে চারা বের হতে সময় লাগে ১০ থেকে ২০ দিন। ৫০-৬০ দিন বয়সের চারা মাঠে লাগানোর উপযুক্ত হয়। বীজতলার আকার ১ মিটার প্রস্থ ও জমির আকার অনুযায়ী লম্বা করা যেতে পারে। তবে বেডের চতুর্দিকে ৩০-৫০ সেমি. আকারে ড্রেন রাখতে হবে। অতঃপর বীজ, ১০-১৫ সেমি. দূরে দূরে লাইন করে বপন করতে হবে। চারা বের হবার পর নিয়মিত সেচ, সার প্রয়োগ ও অন্যান্য যত্ন পরিচর্যা করতে হবে। তবে বীজ থেকে তৈরি চারার ফল আসতে তিন-চার বছর সময় লাগে।
কাটিং এর মাধ্যমে বংশবিস্তার (Cutting Method) -
আমাদের দেশে ডাল পুঁতে অঙ্গজ উপায়ে বংশ বিস্তার পদ্ধতিটি বেশি ব্যবহৃত হয়। তার কারণ হল এটি করতে তেমন দক্ষতার প্রয়োজন হয়না আর খরচও কম। কাটিং রোপণের জন্য উত্তম সময় এপ্রিল থেকে মে মাস। কারণ এই সময়ে সজনে ডাঁটা পেড়ে ফেলার পর গাছের ডালপালা ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। এই ছাঁটা ডালকে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে পুঁতে দিলেই নতুন চারা পাওয়া যাবে। তাছাড়াও এ সময়ে অল্পকিছু বৃষ্টি হয়ে থাকে যার ফলে লাগানো ডালটি সহজেই টিকে যায়। সাধারণত রোগ ও পোকামাকড়মুক্ত সতেজ ও স্বাস্থ্যবান শক্ত ২.৫-৩ ফুট (৭৫-৯০ সেমি.) লম্বা ও ৩-১৬ সেমি. ব্যাস বিশিষ্ট ডাল নির্বাচন করা প্রস্তুতকৃত কাটিং সরাসরি মূল জমিতে রোপণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। গর্ত করে এক ঝুড়ি গোবর সার দিয়ে গাছের ডাল পুঁতে ফেলতে হবে। দেড় থেকে দু’মাসের মাথায় ডালে কচি পাতা বার হয়। তিন-চার মাসের মাথায় শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে মাথাচাড়া দেবে গাছ। পৌষ-মাঘ মাসে সজনে গাছে ফুল ফোটে। এক কেজি ফুল ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হয়। ফুল থেকে এক মাসের মধ্যে সরু সুতোর মতো ডাঁটা বের হয় (সজনে ডাঁটা নামে যেটা আমরা খাই, তা গাছের ফল, কুমড়ো বা লাউ ডাঁটার মতো কাণ্ড নয়)। নরম ডাঁটা কেজি প্রতি ১০০-১২০ টাকায় বিক্রি হয়। চৈত্র-বৈশাখ মাসে প্রমাণ আকারের ডাঁটা হয়। এই ডাঁটার দামও কম নয়। গাছ থেকে ডাঁটা পাড়া হয়ে গেলে ডাল ছেঁটে ফেলতে হবে। ফের পুরনো গাছে নতুন করে পাতা, ফুল ও ফল হবে। এই সময় আর একটু জায়গা বার করে ছাঁটা ডালগুলিকে পুঁতে দিতে হবে।
কাটিং রোপণ পদ্ধতি -
এক্ষেত্রে জমি ভালোভাবে চাষ করে ২০ ইঞ্চি-২.৫ ফুট × ২০ ইঞ্চি-২.৫ ফুট × ২০ ইঞ্চি-২.৫ ফুট আকারের গর্ত করতে হবে। ডালটি লাগানোর সময় যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে সেটি হল ডালটি গাছে থাকা অবস্থায় এর আগা বা মাথা এবং গোড়া যে দিকে ছিল রোপণ করার সময় যেন ঠিক সেই ভাবেই থাকে। লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কাটিং গর্তে লাগানোর সময় প্রতিটি কাটিং এর তিন ভাগের এক ভাগ গর্তের মাটির নিচে রাখতে হবে। কাটিং লাগানোর সময় গর্তের মাটির সাথে ৩/৪ টি নিম পাতা এবং ১০ গ্রাম সেভিন গর্তের মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে কাটিং লাগালে মাটিতে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম হয়। গর্তে কাটিং লাগানোর পর কাটিং এর মাথায় আলকাতরা দিয়ে দিতে হবে। এতে কাটিং এর মাথা শুকিয়ে যাবে না।
কীটপতঙ্গ ও রোগ নিয়ন্ত্রণ (Pest & Disease Management) -
সজনে গাছ তুলনামূলক কীটপতঙ্গ ও রোগ সহনশীলভাবে বেড়ে ওঠে। তবে মাঝে মাঝে রোগের প্রার্দুভাব দেখা যায়। যেমন জলাবদ্ধ মাটিতে শিকড় পচা রোগ দেখা দিতে পারে এর কারণ ডিপ্লোডিয়া। কীট পতঙ্গ শুষ্ক ও ঠান্ডায় বেশি আক্রমণ করে। কীট পতঙ্গ দ্বারা গাছে হলুদ রোগ দেখা যায়। কীটপতঙ্গের মধ্যে শুঁয়োপোকার প্রাদুর্ভাব খুব বেশি দেখা যায়, সজনে গাছে যা পাতা খেয়ে ফেলে এবং গাছের ছাল -এরও ক্ষতি করে। এই শুঁয়োপোকা দমনের জন্য ২ গ্রাম কারবারাইল ৫০ ডাবলু.পি ১ লিটার জলে গুলে প্রয়োগ করতে হবে।
পুষ্টি ও ঔষধী গুণ বিবেচনায় এই গাছকে বাড়ির আঙ্গিনায় একটি মাল্টিভিটামিন বৃক্ষ বলা চলে। স্বাদে ও গুনে ভরপুর এ সবজিটির প্রতি আমদের সকলের আগ্রহ থাকলেও এর চাষাবাদের প্রতি আমদের অনাগ্রহের কথা অস্বীকার করা যায়না। তবে এ সবজি চাষে যদি আমরা একটু মনোযোগী হই ,অর্থাৎ এর বানিজ্যিক উৎপাদন সন্বদ্ধে চিন্তা করি তবে অন্যান্য যে কোনো সবজি উৎপাদনের থেকে এটি লাভজনক। কারণ অন্যান্য সবজির মত এর উৎপাদনে তেমন ঝুঁকি নেই ও খরচও কম। গরমে সজনের ডাঁটা দিয়ে পাতলা ঝোল বা শুক্ত শরীরের পক্ষে উপকারী। কিন্তু বাজারে সজনের ডাঁটার দাম চড়া। তাই কেনাকেনির মধ্যে না গিয়ে নিজের বাড়ির চৌহদ্দিতেই লাগিয়ে ফেলুন সজনে গাছ। বৃক্ষ জাতীয় এই গাছ লাগানোর জন্য নির্দিষ্ট কোনও জমির দরকার হয় না। বাড়ির আনাচে-কানাচে, জলাশয়ের ধারে, রাস্তার দু’পাশে উর্বর হোক বা অনুর্বর—একটু জায়গাতেই পুরনো গাছের ডাল কেটে লাগিয়ে দিন। বিশেষ যত্নও নিতে হবে না। গাছের গোড়ায় জল দেওয়া, ছাগল বা গবাদি পশু চারা খেয়ে গেল কি না, সেদিকে নজর রাখা শুধু এই সামান্য পরিচর্যার প্রয়োজন। অনুকূল আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ না হলে বাম্পার ফলন পাওয়া যায়, যা বাড়ির প্রয়োজন মিটিয়ে বাজারে বিক্রি করলে কৃষক বন্ধুরা অত্যন্ত লাভবান হবেন।
অন্যান্য পরিচর্যা -
সজনে গাছের গোড়া সব সময় আগাছা মুক্ত রাখা দরকার। গাছ লাগানোর সাথে সাথে খুঁটি দিয়ে (৪) চার এর মত ‘নট’ করে বেঁধে দিতে হবে। প্রয়োজনে জৈব-অজৈব আগাছানাশক প্রয়োগ করতে হবে। গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে গাছের ভিতর মৃত এবং অপ্রয়োজনীয় কিছু ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে প্রথম বছরে মাটি থেকে ১ মি. দুরত্ব রেখে উপরের অংশ কেটে ফেলা হয়। এই গাছ থেকে ৪-৫ মাসে নতুন কুশি বের হয় এবং নতুন কুশি থেকে ফল দেয়া শুরু করে। তবে কুশির সংখ্যা বেশি হলে ভালো আলো-বাতাস পাওয়ার জন্য কিছু ডাল কেটে বা ভেঙ্গে পাতলা করে দেয়া উচিত। সাধারণত ৩ বার ডাল কেটে দেওয়া হয়, যা ৯ মাস, ১৭ মাস ও ২৫ মাস পর্যন্ত বয়সে করা হয়। তবে বসতবাড়িতে সজিনা গাছের ক্ষেত্রে তেমন কোন নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। এক্ষেত্রে প্রতি বছর সজিনা সংগ্রহের পর বিগত বছরে যে জায়গায় ডাল কাটা হয় তার পরে ৫০-৭৫ সেমি. রেখে ডাল কেটে দেওয়া হয়। প্রতি বছর ডাল কাটার পর কাটা অংশে আলকাতরা দেওয়া ভালো।
আরও পড়ুন - Organic Manure – সহজ পদ্ধতিতে কীভাবে বানাবেন জৈব সার, রইল খুঁটিনাটি
সংগ্রহ ও ফলন-
শাখা কলম থেকে প্রাপ্ত গাছ ১ বছর পরেই সজিনা দেয়া শুরু করে। সজিনা যখন কচি অবস্থা থেকে কিছু শক্ত হতে শুরু করে তখন থেকে সজিনা খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করার উপযুক্ত হয়। প্রথম ২ বছর সাধারণত ফলন কিছুটা কম হয় (৮০-৯০ টি সজিনা/গাছ/বছর)। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে সজিনার পরিমাণও বাড়তে থাকে। একটি বয়স্ক গাছ (৪-৫ বছর) থেকে বছরে ৫০০-৬০০টি সজিনা পাওয়া যায়। সাধারণত ২০টি ডাঁটায় ১ কেজি হয়। বড় ও মাঝারি ধরনের একটি গাছে তিন থেকে চার মণ পর্যন্ত সজনে পাওয়া যায়। সজনে সাধারণত মার্চ-মে এর মধ্যে সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু নাজনে সারা বছরই গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং গাছ লাগানোর ৬ মাসের মধ্যে ফল সংগ্রহ করা সম্ভব। সজিনা গাছ থেকে ২-৩ মাস পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায় এবং প্রজাতিভেদে প্রত্যেক গাছে ২৫০-৪০০ টি সজিনা পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন - Dry Land Farming - খরা প্রবণ অঞ্চলে কৃষকরা কীভাবে কৃষিকাজ করবেন? রইল বিস্তারিত পদ্ধতি
Share your comments