
শেডনেটের (Shade Net) ভিতরে ফসল চাষের ক্ষেত্রে শুরু থেকেই বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি অবলম্বন করলে এবং সঠিক ফসল নির্বাচনের মাধ্যমে অধিক লাভ করা সম্ভব। এখন প্রকৃতির চরমভাব ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে তাপমাত্রা বাড়ছে। তাছাড়া প্রযুক্তিটি এসে গেছে হাতের নাগালে। তাই এই প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষকরা এখন বেশ কিছুটা বেশী অর্থ উপার্জন করতে পারেন।
তবে শুধু আধুনিক প্রযুক্তিতে চাষ করার ইচ্ছে থাকলেই হবে না, জানতে হবে প্রযুক্তিটি সম্পর্কে বিশদে। আজ আমরা এই নিবন্ধে শেডনেটের কাঠামোয় চাষের প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে চলেছি। কত খরচ হয় এতে, কীভাবে করবেন সমস্ত কিছু সম্পর্কে চলুন জেনে নেওয়া যাক।
স্থান নির্বাচন (Location selection) -
খামারের সবথেকে উঁচু অবস্থানের জমিতেই সাধারণভাবে ছায়াজালের কাঠামো গড়ে তোলা হয় যাতে বৃষ্টির জলে এই জমির কোনও অংশ যেন ডুবে না যায়।তাই ভাল নিকাশী ব্যবস্থাযুক্ত এবং তীব্র বায়ু প্রবাহ থাকে না এমন জায়গায় শেডনেট ঘর তৈরি করা যাবে। দক্ষিণ পশ্চিম দিকে সম্ভব হলে শেডনেট ঘরের চারপাশে সামান্য দূরে দ্রুতবর্ধনশীল বায়ু প্রতিরোধী গাছ যেমন সুবাবুল, সুপারি ইত্যাদি লাগানো যেতে পারে। এই গাছগুলি একদিকে যেমন উইন্ডব্রেকের কাজ করে, অন্যদিকে এগুলি থেকে বাড়তি আয় করা যেতে পারে।
মাটি (Soil) -
মাটি শোধন করে তারপর ব্যবহার করা উচিত। মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য সমান পরিমান মাটি ও জৈব সার, কেঁচোসার ও নিমখোল দিতে হবে। মাটি নোনা, আম্লিক বা ক্ষারীয় হওয়া চলবে না।অনেক ক্ষেত্রে বাইরে থেকে মাটি নিয়ে এসে যে-কোন এলাকতেই এই কাঠামো তৈরি করে ফসল চাষ করা যেতে পারে।মাটি থেকে কমপক্ষে ৩০-৪০ সে.মি. উচু এবং এক থেকে দেড় মিটার চওড়া বেড তৈরী করতে হবে। দুটি বেডের মাঝে ৪৫-৫০ সে.মি. জল নিকাশী ওচলাফেরা করার জন্য ফাকা জায়গা রাখা প্রয়োজন।
আয়তন (Volume) -
শেডনেটের কাঠামো কত বড় হবে তা নির্ভর করবে কৃষকের আর্থিক সামর্থ্য ও কোন ফসল চাষ করা হবে, তার উপরে। লোহা বা জি.আই. পাইপ দিয়ে তৈরি ছায়াজালের আয়তন কমপক্ষে ১০০০ বর্গমিটার (৩৩ শতকে বিঘার হিসাবে প্রায় ১৫ কাঠা বা ২৫ শতক) হওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ এরকম হতে পারে ৪০ মিটার x২৫ মিটার (১০০০ বর্গমিটার) কিংবা ৩৬ মিটার x২৮ মিটার (১০০৮ বর্গমিটার)। বাঁশ দিয়ে তৈরী ছায়াজালের ঘরের আয়তন কমপক্ষে ২০০ বর্গমিটার (৩ কাঠা) হওয়া বাঞ্ছনীয়।
উচ্চতা ও চূড়া (Height) -
শেডনেট এর তৈরি ঘর মোটামুটি ৩.০- ৩.৫০ মিটার (প্রায় ১০-১১ ফুট) উঁচু হওয়া দরকার। তবে বাঁশের কাঠামোতে উচ্চতা ২.৪০-২.৭০ মি (৮-৯ ফুট)। চূড়া সমান, অর্ধচন্দ্রাকৃতি, উল্টানো ইংরাজী ভি আকৃতির তৈরি করা হয়। ছায়াজাল দিয়ে ঢাকা ঘরে বায়ু চলাচলের জন্য ফাকা না রেখে চার পাশে উপরের দিকে থেকে ৩০-৪৫ সে.মি. (এক-দেড় ফুট) জাল ব্যবহার করতে হবে যা পোকামাকড় প্রতিরোধ করতে সাহায্য করবে। অনেকসময়ে ঘরের ভিতরের কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে যাওয়া আটকাতে চার পাশে নীচের দিকে ৯০ সে.মি. (তিন ফুট) চওড়া কালো রঙের পলিথিনের চাদর দেওয়া হয়।
জলসেচ ব্যবস্থা-
ড্রিপ জলসেচ বা অনুসেচ ব্যবস্থার বিন্দু বিন্দু পদ্ধতি অবলম্বন করা আবশ্যক। ড্রিপের পাইপগুলি সারি বরাবর রাখতে হবে ও এই পদ্ধতির মাধ্যমে তরল সার প্রয়োগ (ফার্টিগেশন) করা যাবে। এই পদ্ধতি সম্ভব না হলে ঝারির সাহায্যে সেচ দিতে হবে।
ছায়ার মাত্রা-
স্থান, চাষের ঋতু, ফসলের প্রকৃতি (যেমন, মাঠের ফসল, শাকজাতীয়, ফুল ইত্যাদি) এবং কোন উদ্দেশ্যে এই কাঠামো ব্যবহার করা হচ্ছে, সেইসব বিষয়ের উপরে নির্ভর করে কত শতাংশ ছায়ার চাদর ব্যবহার করা হবে। ৫০% থেকে ৭৫% শতাংশ শেডনেট ব্যবহারের প্রচলনই বেশি দেখা যায়। যেমন টমাটো, লঙ্কা, ক্যাপসিকাম, শশা ও অন্যান্য কুমড়ো গোত্রের ফসল, গোলাপ ও স্ট্রবেরি চাষের জন্য ৫০% শেডনেট ব্যবহার করা হয়। শাকজাতীয় ফসল, আদা, অ্যানথুরিয়াম প্রভৃতি ছায়া পছন্দকারী ফসল চাষের ক্ষেত্রে ৭৫% পর্যন্ত শেড ব্যবহার করা হয়ে থাকে। চারার হার্ডনিং-এর জন্য ৫০-৭৫% শেডনেট ব্যবহার করা হয়। ঘরে রাখার উপযোগী বাহারি গাছ (ইনডোর প্ল্যান্টস) এবং অর্কিডের জন্য চাই ৭৫% শেডনেট।
নেটের রঙ নির্বাচন -
আমরা প্রধানত সবুজ রঙের শেডনেটই সচরাচর দেখে থাকি। এই রঙ প্রায় সবরকম ফসলের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যায়। পলি-হাউসের ভিতরেও রোদের তীব্রতা কমাতে এই বর্ণের শেডনেট ব্যবহার করা হয়। খরা সইতে পারে না, এরকম ফসল গ্রীষ্মে চাষ করার ক্ষেত্রে সবুজ শেডনেট বিশেষ উপযোগী। অঙ্গজ বৃদ্ধি যেসব ফসলে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, যেমন শাকপাতা বা শাখা-প্রশাখা এবং ফুল চাষের ক্ষেত্রে (বাজারের চাহিদা অনুযায়ী) দেরিতে ফুল চয়ন করতে চাইলে নীল রঙের নেট ব্যাবহার করা যেতে পারে। লাল রঙের ছায়াজালে ফুল চাষ করলে গাছে জলদি ফুল আসে, উৎপাদিত ফুলের গুণমান বজায় থাকে ।
পরিকাঠামো তৈরিতে সম্ভাব্য খরচ-
শেডেনেট বিছানোর জন্য যে ঘরটি তৈরি করা হবে, সেটি নির্ভর করবে কৃষকের শস্য পরিকল্পনা ও আর্থিক সামর্থের উপর। কাঠ, বাঁশ প্রভৃতি স্থানীয়ভাবে লভ্য বস্তু দিয়ে যদি কাঠামো তৈরি করা হয়, তাহলে প্রতি এক হাজার বর্গমিটারের জন্য ব্যয় হয় প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা এবং এর জীবনকাল হয় প্রায় বছর পাঁচেক। কিন্তু লোহার তৈরি জি.আই.পাইপের পরিকাঠামোর জন্য এক-হাজার বর্গ মিটারের জন্য খরচ হবে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার কিছু কমবেশি। এক্ষেত্রে ঘরের স্থায়িত্ব হবে প্রায় ৩০ বছর। শুধু আট-দশ বছর অন্তর কেবল ছায়াজাল পাল্টাতে হবে।
আরও পড়ুন - Farming In Shade Net – শেড নেটে কেন চাষ করবেন? কি কি সুবিধা রয়েছে এতে? চাষে লাভের সহজ উপায় ছায়াজাল
ছায়াজালের ঘর তৈরি করার জন্য এখন বিভিন্ন সরকারি আর্থিক অনুদানের সুবিধা মিলছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শেডনেট প্রযুক্তির প্রয়োগ ক্রমশ বাড়ছে। বর্তমানে পশিমবঙ্গের অনেক জায়গায় শেডনেটের বরজে পান চাষ করে কৃষক বন্ধুরা যথেষ্ট লাভবান হচ্ছেন।
আরও পড়ুন - Orchid Farming: আধুনিক পদ্ধতিতে উপযুক্ত পরিচর্যার মাধ্যমে অর্কিডের চাষ
Share your comments