
বায়োপেস্টিসাইড (Bio pesticide) বলতে আমরা বুঝি কিছু কিছু জৈব কীটনাশক পদার্থকে যা উদ্ভিদজাত এবং জীবাণুজাত হতে পারে এবং এই সমস্ত পদার্থ জৈবিক উপায়ে গাছের রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণ করে।
এই জৈবিক পদ্ধতিতে ‘ ব্যাকটেরিয়া’ ঘটিত জীবাণু, ছত্রাক ঘটিত জীবাণু, ভাইরাস ঘটিত জীবাণু ও উদ্ভিদজাত পদার্থ ( যেমন নীম) ব্যবহৃত হয়। Bio মানে জৈব। জৈব উপায়ে কীত-রোগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এই সমস্ত পদার্থকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
(ক) মাইক্রোবায়াল কীটনাশক (Microbial Pesticides) -
জীবাণুর মাধ্যমে রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ -
এই ধরণের জৈব কীটনাশক পদার্থে যে যে জীবাণুকে কাজে লাগানো হয়, তারা হলো ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, ভাইরাস,প্রোটোজোয়া, নেমাটোড বা তাদের derivative( ) যা শস্যের রোগ ও পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।
(খ) বোটানিক্যাল কীটনাশক (Botanical Pesticides) -
ভেষজ উদ্ভিদজাত পদার্থের মাধ্যমে রোগ পোকা নিয়ন্ত্রণ -
এই জৈব কীটনাশক পদার্থগুলি সাধারণতঃ উদ্ভিদজাত হয় যার মাধ্যমে বিভিন্ন শস্যের রোগ ও কীটশত্রু নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
বায়োপেস্টিসাইডের বর্তমান অবস্থাঃ
বাজারে অনেক বায়োপেস্টিসাইড বা জৈব কীটনাশক পদার্থ পাওয়া যায় যা সহজেই কৃষকেরা পেতে পারে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে ১৭৫ টি রেজিস্টার্ড (নিবেদিত) জৈব কীটনাশক পদার্থ ঘটিত সক্রিয় উপাদান রয়েছে এবং তার উপর ভিত্তি করে ৭০০ টির বেশী পণ্য বর্তমান। ভারতে মাত্র ১২ টি নিবন্ধিত বায়োপেস্টিসাইড রয়েছে যার মধ্যে পাঁচটি হলো ব্যাকটেরিয়া ঘটিত (৪ টি ব্যাসিলাস প্রজাতি এবং ১টি সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স), তিনটি
ছত্রাক ঘটিত ( দুটি ট্রাইকোডার্মা এবং ১ টি বিউভেরিয়া প্রজাতি), দুটি ভাইরাস ঘটিত প্রজাতি ( হেলিকোভার্দা ও স্পোডপ্টেরা) এবং দুটি ভেষজজাত [ যেমন নীম এবং সিমবোপোগন (cymbopogon)]। বায়োপেস্টিসাইড হিসেবে এই সমস্ত উদ্ভিদজাত ও জীবাণু ঘটিত কীটনাশকদের গুরুত্ব অপরিসীম।
ক) মাইক্রোবায়াল (জীবাণুঘটিত) কীটনাশক পদার্থঃ
১) ব্যাকটেরিয়া ঘটিত-
১.১ ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস(Bacillus Thuringiensis) (BT)
ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস ( কায়স্টাকি উপপ্রজাতি) বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে সফল, জৈব কীটনাশক পদার্থ।লেপিডোপ্টেরা (Lepidopteran) গোষ্ঠীর কীট নিয়ন্ত্রণে ( যেমন- তুলোর বোলওয়ার্ম, ক্যাস্টরের সেমিলুপার,তামাকের ক্যাটারপিলার(ল্যাদাপোকা), কারির হীরকপৃষ্ঠ মথ, ধানের কাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা এবং বিভিন্ন শস্যেরHeliothis amigera) ভীষণ কার্য্যকরী। স্প্রে করার জন্য অনুমোদিত মাত্রা হ’ল প্রতি লিটার জলে ১ থেকে ১.৫ মিলি মেশানো। এর প্রয়োগ বিকেলের দিকে এবং ঠান্ডা আভাওয়ায় খুব কাজ দেয়।
১.২ ব্যাসিলাস পপিলি ( Bacillus Popilliae)
এই জীবাণু Chafer grub এর লার্ভাতে এক ধরণের রোগ তৈরী করে( শরীরের fluid এর মধ্যে টার্বিডিটি তৈরি করা)। তুলোর মাটি বাহিত রোগ নিয়ন্ত্রনে ব্যাসিলাস সাবটিলিস খুবই কার্য্যকরী।
১.৩ সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স (Pseudomonus Fluoroscens)
এটি একটি মূল্যবান Biofungicide বা জৈবিক ছত্রাকনাশক। বিভিন্ন কৃষিজাত বা উদ্যানজাত ফসলের রোগজীবাণু যেমন পিথিয়াম, ফিউজারিয়াম, রাইজোকটোনিয়া সোলানি, সফ্লেরোসিয়াম রলফসি, বট্রাইটিস সিনেরিয়া ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়, ট্যালক পাউডারে মিশ্রিত করে
একে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা হয়। প্রতি কেজি বীজে ৪ গ্রাম করে মিশিয়ে (Seed treatment) প্রয়োগ করা হয়,যদি মাটিতে প্রয়োগ করতে হয় তবে তা হেক্টর প্রতি ২-৩ কেজি (সঙ্গে জৈব সার থাকা দরকার) বীজ বোনার আগে ব্যবহার করতে হবে। বীজবাহিত, মাটিবাহিত রোগের ক্ষেত্রে প্রতি লিটারে ১০ গ্রাম করে পাতায় স্প্রে করা যেতে পারে,এতে Rice blast, গোড়া পচা/শেকড় পচা, ব্রাউন স্পট ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ছত্রাক ঘটিত জীবাণু -
বিগত কয়েক বছরে বেশ কিছু entomopathogenic ছত্রাকের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যার মাধ্যমে উদ্ভিদের ক্ষতিকর ছত্রাক আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
ট্রাইকোডার্মা স্পিসিস -
ট্রাইকোডার্মা হ’ল কৃষিতে এক উল্লেখযোগ্য মাটিতে বসবাসকারী জীবাণু। ট্রাইকোডার্মা প্রজাতি মাটিতে এবং শেকড়ের পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলে যেখানে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশী, সেখানে স্বাধীনভাবে থাকে। ট্রাইকোডার্মার ৩৫ টি প্রজাতির মধ্যে বিশেষভাবে স্বীকৃত হল ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি (Trichoderma Viride), ট্রাইকোডার্মা হারজিয়েনাম (Trichoderma Harzianum), ট্রাইকোডার্মা ভিরেন্স (Trichoderma Virens) খুবই উল্লেখযোগ্য যা ছত্রাকনাশক জইব-পেস্টিসাইড (Biopesticide) হিসেবে পরিচিত।
তুলো, লঙ্কা, বাদাম, কলাই, মুগ, ছোলা ইত্যাদির শস্যে রাইজোকটনিয়া, পাইথিয়াম, স্ক্লেরোটিনা, স্কেটেরোটিয়াম,ফিউজেরিয়াম, ম্যাক্রোফমিনা, বট্রাইটিস প্রভৃতি জীবাণুর জন্য ড্যাম্পিং অফ(গোড়া পচা), রুট রট ( শেকড় পচা),উইল্ট(ঢলে পড়া), গ্রে মোল্ড, শিথ ব্লাইট, ওয়েব ব্লাইট নামক যে সব রোগ হয়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ট্রাইকোডার্মা প্রজাতিকে কখনও বীজশোধক, কখনও মাটিতে প্রয়োগ, কখনও স্প্রে করার জন্য সুপারিশ করা হ’য়ে থাকে। সাধারণতঃ এই সব বায়ো-ফাঙ্গিসাইড বাজারে ট্যাল্ক পাউডারে মিশ্রিত কনিডিয়া ও মাইসেলিয়াম ফ্র্যাগমেন্ট(২x১০CFU/প্রতি গ্রাম ট্রাইকোডার্মা প্রজাতি) পদার্থ হিসেবে পাওয়া যায়। বীজ শোধনের সুপারিশ করা মাত্রা হ’ল প্রতি কিলো বীজে ৪ গ্রাম, মাটিতে প্রতি হেক্টরে ২-৩ কিলোগ্রাম(জৈব পদার্থ সহ) (বীজ বোনার আগে) প্রয়োগ করতে হয়।
ছত্রাকনাশক প্রয়োগ -
অ্যাসপারজিলাস নাইজার (Aspergillus niger) -
এই ছত্রাকটি শস্যের বিভিন্ন অপকারী ছত্রাক জীবাণুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং উল্লেখযোগ্য বায়োপেস্টিসাইড হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ধান, ভুট্টা, যব, ডালশস্য, তৈলবীজ, কলা, আঁখ, নানারকমের ফল ও সব্জি, টিউবার ফসল, অর্নামেন্টাল গাছ, গোখাদ্য ও তন্তু জাতীয় ফসলে বিভিন্ন জীবাণু (Fusarium, Pythium, Macrophomina, Sclerotinia ইত্যাদি) যে সব রোগ (যেমন- Wilt, root rot,damping off) নিয়ে আসে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে অ্যাসপারজিলাস নাইজার অত্যন্ত সক্রিয় বায়োপেস্টিসাইড। ধানের (sheath blight) দমন করার জন্য অ্যাসপারজিলাস নাইজার AN27 জীবাণু প্রতি কিলোগ্রাম বীজে ৮ গ্রাম হিসেবে প্রয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়ে থাকে।
অ্যাম্পিলোমাইসিস কুইসকোয়ালিস (Ampelomyces quisqualis) -
একরা, লঙ্কা, টোমাটো, আঙুর, আলু ইত্যাদি ফসলে যে milded রোগ দেখা যায় (Brasilomyces, Erysiphe, Leveillule, Micresphaera, Phyllactinia প্রভৃতি জীবাণুর দ্বারা) তা ঠিক করতে এই ধরণের জৈব ছত্রাকনাশক পদার্থ (ট্যালক পাউডার মিশ্রিত ১x১০৮CFS/প্রতি গ্রাম স্পোর) প্রতি লিটার জলে ৫ গ্রাম মিশিয়ে স্প্রে করা যেতে পারে।
মেটারহিজিয়াম অ্যানিসপ্লাই ( Metarrhizium anisopliae) -
এটি এক ধরণের কীটদমনকারী ছত্রাক যা বিভিন্ন শস্যকীট ( তাতে মাটির কীট, শোষক পোকা, চিরুনী পোকা,ছিদ্রকারী পোকা ইত্যাদি দমন করতে কার্য্যকরী। এই জৈব – পেস্টিসাইড বাজারে ট্যাল্ক পাউডারে ছত্রাকের স্পোর/মাইসেলিয়াল ফ্র্যাগমেন্ট(@১x১০ CFU/প্রতি গ্রাম M.anisopliae) পাওয়া যায়। এই কীটনাশক ছত্রাক জীবাণুকে প্রতি লিটার জলে ৫ গ্রাম হিসেবে ( অর্থাৎ হেক্টর প্রতি ২.৫ কিলোগ্রাম) বিকেলের দিকে স্প্রে করার সুপারিশ আছে।
বিউভেরিয়া ব্যাসিয়ানা (Beauveria bassiana) -
যেহেতু এই জীবাণু entomopathogenic ছত্রাক, একে তাই শস্য সুরক্ষার জন্য জৈব কীট নিয়ন্ত্রক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
নমুরিয়া রিলেই (Nemuraea Rileyi) -
বাদাম, শারগাম, ছোলার প্রভৃতি শস্যে যখন ল্যাদাপোকা (Helicoverpa amigera), পাতা ছিদ্রকারী পোকা(Spodoptera litura) বিরুদ্ধে নমুরিয়া রিলেই entomopathogenic ছত্রাক হিসেবে ভালো রকমের জৈব নিয়ন্ত্রক পদার্থ।
ভার্টিসিলিয়াম লেকানী (Verticillium lecanii) -
জাবপোকা, সাদামাছি, থ্রিপস, চোষী পোকা ইত্যাদি কীটের বিরুদ্ধে ভার্টিসিলিয়াম লেকানী হল কার্য্যকরী বায়োপেস্টিসাইড।
পেসিলোমাইসেস লিলাসিনাস (Paecilomyces Lilacinus)
এই ছত্রাকটি নামাটিসাইড(Nematicide) বা কৃমিনাশক হিসেবে কার্য্যকরী। বহু কৃমির (যেমন root-knot ইত্যাদির)ডিম, জুভেনাইল, ইয়ং ন্যাডাল্টস মেরে এই ছত্রাকের মাধ্যমে কৃমি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
ভাইরাল জীবাণু -
ব্যাকুলোভাইরাস (Baculoviruses)
ব্যাকুলোরাইডি পরিবারে থাকা জীবাণু ভাইরাস একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ফসলের কীটপতঙ্গ সংক্রমিত ও ধ্বংস করতে পারে। তারা তুলা, চাল, ও সব্জি চাষের লেপাইড্রাপরাল কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে বিশেষভাবে কার্য্যকর।
প্রোটোজোয়া ( Protozoa) -
অধিকাংশ প্রজাতির এন্টোমপ্যাথিক প্রোটোজোয়া তাদের হেক্টর আক্রান্ত করে দুর্বল করে দেয়, কিন্তু হত্যা করে না। এই কারণে Biocontrol এজেন্ট হিসেবে এই প্রাণীর গুরুত্ব আছে। Grasshopper কে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য Nosema Locustae বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদন করে বাজারজাত করা হয়েছে।
প্যারাসাইটিক নেমাটোড ( Parasitic nematodes) -
সাধারণভাবে মর্মিথিড নেমাটোড বিভিন্ন ধরণের পোকামাকড়কে সংক্রমিত করার জন্য পরিচিত। Memis, Agamermis, Hexameris, Geomeris ইত্যাদি ৪০ টি প্রজাতির পোকা মাকড়ের সাথে যুক্ত এবং বেশীরভাগই লেপিডোপরিয়ালকে আক্রান্ত করে।
আরও পড়ুন - Farming In Shade Net – শেড নেটে কেন চাষ করবেন? কি কি সুবিধা রয়েছে এতে? চাষে লাভের সহজ উপায় ছায়াজাল
বোটানিক্যাল কীটনাশক ( Botanical Pesticide)
নিম -
সমস্ত ভেষজজাত ( Botanical) কীটনাশকের মধ্যে নীম ( Azadirachta indica) নিয়ে ব্যপক গবেষণা হয়েছে এবং দেখা গিয়েছে যে এই উদ্ভিদজাত পদার্থ ফসলের বহু কীট ও রোগ দমন করতে পারে। ভারতে বহু শতাব্দী ধরে নীম গাছের পাতা, বীজ, কার্নেল বিভিন্ন ফসলের কীটশত্রু ও রোগ দমন করতে কার্য্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
Share your comments