
ভারতবর্ষে ১৯৬৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টের উভয় সভায় কীটনাশক বিল পাশের মাধ্যমে লাগু হয় ‘কীটনাশক আইন ১৯৬৮’। কীটনাশক আইনের মূল উদ্দেশ্যই হল কৃষকের স্বার্থ অক্ষুন্ন রেখে কৃষিতে ব্যবহৃত কীটনাশক থেকে মানুষ, পশুপাখী ও পরিবেশের ক্ষতির মাত্রা কমানো। কৃষক, যাঁরা কীটনাশক নিয়ে ব্যবসায় নিযুক্ত, কীটনাশক পরিদর্শক ও কৃষি আধিকারিকদের সুবিধার্থে ২০১৮ সাল অবধি প্রকাশিত সংশোধনী ও সংযোজনী অনুযায়ী কিছু কীটনাশক আইনের নিয়মকানুন কৃষি জাগরণের এই সুসংহত কৃষিশত্রু নিয়ন্ত্রণ সংখ্যায় প্রকাশিত হল –
কীটনাশক আইন ১৩(১) অনুসারে কোনো ব্যক্তি কীটনাশকের ব্যবসা করতে চাইলে লাইসেন্স আধিকারিকের কাছে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হবে। কীটনাশকের ব্যবসার জন্য তিন ধরনের লাইসেন্স দেওয়া হয় – (ক)তৈরি, (খ) বিক্রি, মজুদ বা প্রদর্শন এবং (গ) বাণিজ্যিক ভাবে বসতি এলাকায় কীটশত্রু যেমন : মশা, মাছি, আরশোলা, উইপোকা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের কাজ
কীটনাশক আইনের ১২ নং ধারা অনুসারে রাজ্য সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দেবে যে কোন কোন আধিকারিকের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে এবং ওই বিজ্ঞপ্তিতে তাঁদের নিজ নিজ এলাকাও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে।
কীটনাশক নিয়ম, ১৯৭১ এবং সর্বশেষ সংযোজনী ও সংশোধনী ২০১৮ অনুযায়ী –
III নং অধ্যায়ের ৬-৮ নং নিয়ম অনুযায়ী কোনো ধরনের কীটনাশক প্রস্তুত করার পূর্বে কেন্দ্রীয় কীটনাশক বোর্ড ও শংসিতকরণ কমিটি (সি. আই. বি. আর. সি) এর কাছে কীটনাশক কিভাবে নথিভুক্ত করাতে হবে সে বিষয়ে বিশদে আলোচনা করা হয়েছে। বাজারে বিক্রিত প্রতিটি কীটনাশকের লেবেলে সি আই আর নম্বর (রেজিস্ট্রেশন নং) লেখা থাকা বাধ্যতামূলক। রেজিস্ট্রেশন নং ছাড়া কোনো কীটনাশক বাজারে বিক্রি করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ।
IV নং অধ্যায়ের ১০ নং নিয়ম
১(ক) উপনিয়ম অনুযায়ী যে ব্যক্তি কীটনাশক মজুত বা প্রদর্শনের লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আবেদন করবেন তাঁর নিম্নলিখিত যে কোন একটি যোগ্যতামান থাকতে হবে অথবা ওই যোগ্যতামানসম্পন্ন কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ করতে হবে। যোগ্যতামানগুলি নিম্নরূপ –
কৃষিবিজ্ঞান/জৈব রসায়ন/জৈবপ্রযুক্তি/জীববিজ্ঞান/উদ্ভিদবিদ্যা বা প্রণীবিদ্যা বা রসায়ন নিয়ে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি কিংবা কৃষিতে/উদ্যানপালনে ১ বছরের ডিপ্লোমা ডিগ্রি থাকতে হবে।
২ নং উপনিয়ম অনুযায়ী শহরাঞ্চলে (পৌর এলাকা/কর্পোরেশন) প্রতিটি কীটনাশকের জন্য ৫০০ টাকা লাইসেন্স ফি ধার্য করা হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ লাইসেন্স ফি ৭৫০০ টাকা স্থির করা হয়েছে।
গ্রামীণ এলাকার জন্য লাইসেন্স ফি উপরোক্ত ফি-র এক-পঞ্চমাংশ করা হয়েছে।
৩ নং উপনিয়ম অনুযায়ী -
- পৃথক পৃথক জায়গার জন্য পৃথক পৃথক লাইসেন্স নিতে হবে।
- কমার্শিয়াল পেস্ট কন্ট্রোল অপারেশনের লাইসেন্স ফি ১০০০ টাকা এবং এই লাইসেন্সের মেয়াদ পাঁচ বছর (অর্থাৎ ৫ বছর পর পর নবীকরণ প্রয়োজন) এই লাইসেন্স III নং ফর্মে দেওয়া হয়।
- কমার্শিয়াল পেস্ট কন্ট্রোল অপারেশনের লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে নিজেকে ন্যূনতম কৃষিস্নাতক হতে হবে। অন্যথায় রসায়ন নিয়ে বিজ্ঞান স্নাতক হলেও চলবে। উভয় ক্ষেত্রেই সঙ্গে এন. আই. পি. এইচ. এম. হায়দ্রাবাদ/কেন্দ্রীয় খাদ্য প্রযুক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মহীশূর/ আই. জি. এস. আই. হাপুর থেকে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণের শংসাপত্র জমা করতে হবে।
- কমার্শিয়াল পেস্ট কন্ট্রোল অপারেশনের লাইসেন্স নিয়ে ধূমায়নের কাজ করতে হলে কেন্দ্রীয় সরকারের শস্য সুরক্ষা উপদেষ্টার অনুমোদন প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের পদ্ধতি ও গাইডলাইন মেনে ধূমায়নের কাজ করতে হবে।
৪ নং উপনিয়ম অনুযায়ী – কীটনাশক বিক্রি, মজুত বা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে –
- জনসাধারণের চোখে পড়ে দোকানের এমন কোনো জায়গায় লাইসেন্স প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
- লাইসেন্স প্রদানকারী আধিকারিকের যদি মনে হয়, কোনো কীটনাশক, মানুষ, পশুপাখী বা পরিবেশের ক্ষতি করছে তবে তিনি কারণ দেখিয়ে ৩০ দিনের জন্য অথবা কীটনাশক বিশ্লেষকের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত বিক্রি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিতে পারেন।
- কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আবেদন করলে আবেদনের সঙ্গে তাঁকে, কীটনাশক কোম্পানীর প্রিন্সিপাল সর্টিফিকেট সঠিক বয়ানে সঠিকভাবে পূরণ করে জমা করতে হবে।
প্রিন্সিপাল সর্টিফিকেট সঠিক কিনা তা যাচাই করার জন্য ওই সর্টিফিকেটে যে ব্যক্তির স্বাক্ষর থাকবে বলে কোম্পানী ঠিক করেছে সেই ব্যক্তির নমুনা সাক্ষর পর্যাপ্ত সংখ্যায় রাজ্যস্তরের লাইসেন্স প্রদানকারী আধিকারিকের নিকট কোম্পানীর পক্ষ থেকে জমা দিতে হবে।
VI নং অধ্যায়ের ২৯ নং আইন অনুযায়ী কীটনাশক ব্যবসায়ীগণ নিম্নলিখিত যে কোন ধরনের অপরাধ করলে যেমন – লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করলে; কীটনাশক পরিদর্শককে তাঁর কাজে বাধা দিলে; কীটনাশকের প্যাকেটের লেবেলে যা লেখা আছে তা যদি মিথ্যা হয়; লেবেলে সঠিক সতর্কবার্তা লেখা না থাকলে; যদি কীটনাশকে এমন কিছু পদার্থ পাওয়া যায় যা রেজিস্ট্রেশন করার দরকার ছিল কিন্তু রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি; রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কোনো কীটনাশক বিক্রি করলে; সরকার কর্তৃক ঘোষিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী মানুষের স্বাস্থ্য তথা পরিবেশের কথা বিবেচনা করে সাময়িকভাবে ৬০ দিনের জন্য বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও যদি তা বিক্রি হতে দেখা যায় –
তাহলে প্রথমবার অপরাধের জন্য ২ বছরের জেল অথবা ১০-৫০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে অথবা জেল ও জরিমানা দুটোই হতে পারে।
দ্বিতীয়বার অপরাধে ৩ বছরের জেল অথবা ১৫-৭৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা জেল ও জরিমানা দুটোই হতে পারে।
VI নং অধ্যায়ের ৩৫ নং নিয়ম অনুযায়ী খাদ্যবস্তু ও কীটনাশক যেন একসঙ্গে পরিবাহিত না হয়। ভারতীয় রেল কীটনাশককে ‘রেড টেরিফ’ এর অন্তর্ভুক্ত করেছে।
- ৩৮ নং নিয়ম অনুযায়ী কীটনাশক ব্যবসাস্থলে প্রথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৩৯ নং নিয়মে গ্লাভস, মাস্ক ইত্যাদি ব্যবহার করে সুরক্ষিত থাকার কথা বলা হয়েছে।
- ৪১ নং নিয়মে প্রস্তুতকারক সংস্থায় উপযুক্ত পরিমাণে অ্যান্টিডোট ও প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ রাখার উপর গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে।
- ৪১ নং নিয়মে কর্মীদের সুরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করবে সকল ধরনের কীটনাশক ব্যবসায়ীগণ
- ৪৪ নং নিয়মে ব্যবহৃত কীটনাশকের প্যাকেট, অতিরিক্ত কীটনাশক, কীটনাশক ধোয়া জল, মেয়াদ উত্তীর্ণ কীটনাশক ইত্যাদি পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিতে লোকালয় থেকে দূরে যাতে জল, পরিবেশ দূষিত না হয় সেসমস্ত নষ্ট করে ফেলার দায়ীত্ব প্রস্তুতকারী সংস্থার এবং অপারেটরদের।
তথ্যসূত্র : ‘সহজকথায় কীটনাশক আইন ও নিয়মকানুন’ (শস্য সুরক্ষা ও মান নিয়ন্ত্রণ শাখা), পশ্চিমবঙ্গ।
রুনা নাথ(runa@krishijagran.com)
Share your comments