কৃষিজাগরন ডেস্কঃ শণ (Crotalaria juncea L.) একটি অর্থকারি ফসল যা শিম্বগোত্রৌয় (leguminoaceae বা fabaceae) শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত এবং প্রাকৃতিক তন্তুর উৎস৷ এই গাছের ইংরেজী নাম ‘সানহেম্প’ (sunnhemp), ‘ইন্ডিয়ান হেম্প’ (Indian-hemp), ‘মাদ্রাজ হেম্প’ (madras-hemp) এবং ‘ব্রাউন হেম্প’(brown hemp)৷ শণের তন্তু তথা বাস্ট ফাইবার হলুদ, মোটা, শক্তিশালী এবং টেকসই যা দড়ি, সুতো, মাছ ধরার জাল, বিশেষ প্রকারের কাপড় ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়৷
উচ্চ সেলুলোজ, কম লিগনিন এবং নগণ্য ছাইজাতীয় সামগ্রীর কারণে এই ফসলটিকে নোট ছাপার কাগজ, ‘টিস্যু পেপার’ এবং সাধারণ কাগজ তৈরির জন্য দেশীয় কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করা হয়৷ এটি পাট এবং মেস্তার পরিবর্তে চিত্রপট এবং পর্দা তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে৷ এই গাছের গড় উচ্চতা ২.৫ থেকে ৩ মিটার এবং ফুলের রঙ হলুদ৷ এর উৎপত্তি অনিশ্চিত হলেও অনেকে মনে করেন ভারত ও পাকিস্তান থেকেই এটি উৎপত্তি লাভ করেছে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ ও ব্রাজিল এই ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে৷ ভারতের মধ্যে মহারাষ্ট্র, ওডিশা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গ এই ফসল উৎপাদনে অগ্রগণ্য৷
আরও পড়ুনঃ মৌমাছির প্রজাতি
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদা ও নদীয়া জেলায় এই ফসল চাষ করা হয়ে থাকে৷ অনান্য শিম্বগোত্রৌয় ফসলের তুলনায় শণের নাইট্রোজেন আবদ্ধ করার ক্ষমতা সবথেকে বেশি (প্রতি হেক্টরে ৫০ থেকে ৬০ কেজি), তাই এটি একটি উৎকৃষ্ট সবুজ সার জাতীয় ফসল হিসাবেও ব্যবহৃত হয়৷ সেই কারণে, ভাল মানের তন্তু পাওয়ার আশায় এবং সবুজ সারের দিকে চাষীদের ঝোঁক বাড়ায় দিনদিন এই ফসলের চাহিদা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে৷ কিন্তু প্রথাগত পদ্ধতি অনুযায়ী সামান্য কিছু বীজ পাওয়ার আশায় চাষীরা সাধারণত বাজরা, রাগি এবং জোয়ারের জমির চারিদিকে অথবা ধানের জমির বাঁধে এই গাছ লাগানো হয় যা এই বীজের চাহিদার যোগান দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়৷
শনের উন্নত কিছু জাত
কিছু উল্লেখযোগ্য শণের জাত নিম্নরূপঃ
প্রাঙ্কুর (JRJ-৬১০), কালো (K-১২), হলুদ (K-১২), নালন্দা সান্নি, M-১৯, M-৩৫, D-IX, ST-৫৫, শৈলেশ (SH-4), স্বস্তিক (Suin-053), অঙ্কুর (Suin-037) ইত্যাদি ।
বীজের হার ও শোধন: সাধারণত বীজ উৎপাদনের জন্য প্রতি হেক্টরে ২০ থেকে ২৫ কেজি বীজের প্রয়োজন হয়ে থাকে৷ ম্যানকোজেব বা কার্বেন্ডাজিম (৫০ ডব্লিউ. পি.) প্রতি কেজিতে ২ থেকে ৩ গ্রাম মিশিয়ে দিয়ে বীজ শোধন করা উচিত, যাতে ছত্রাকঘটিত রোগের প্রবণতা কমে৷
বীজবপনের দুরত্ব ও গভীরতা: ফসল সাধারণত ২৫ থেকে ৩০ সেমি × ৫ থেকে ১০ সেমি ব্যবধানে চাষ করা যায়, তবে পর্যাপ্ত পরিমাণ বীজ উৎপাদনের জন্য ৩০ × ১০ সেমি দুরত্ব বজায় রেখে ২ থেকে ৩ সেমি গভীরতায় বীজ বপন করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়৷
আরও পড়ুনঃ শণ চাষে লক্ষী লাভ,শিখে নিন চাষের পদ্ধতি
রোগ ও পোকা দমন:
রোগ |
রোগের কারণ |
লক্ষণ |
প্রতিকার |
ঢলে পড়া (Wilt) |
Fusarium udum spp. |
এটি মুলত অল্প বয়স্ক উদ্ভিদকে আক্রমণ করে এবং পাতাগুলি প্রথমে হলুদ দেখায় যা শেষ পর্যন্ত শুকিয়ে যায়৷ মূল ও কাণ্ডের জলপ্রবাহী নালীকাগুলি কালো বর্ণ ধারণ করে৷ |
পর্যাপ্ত জল নিষ্কাশন, ফসল পরিবর্তন, পরিষ্কার চাষ এবং কার্বেন্ডাজিম ২ গ্রাম/কেজি বীজ দিয়ে বা কার্বেন্ডাজিম ২ গ্রাম/লিটার জলে স্প্রে করা কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা৷ K-12 হলুদ জাতটি কিছুটা হলেও সহনশীলতা দেখায়৷ |
কালো ক্ষত (Anthracnose) |
Colletotrichum curvatum |
পাতায় বিক্ষিপ্ত এবং বাদামী দাগ যা প্রায়ই পাতার শিরা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়৷ |
প্রাথমিকভাবে রোপণ, কার্বেন্ডাজিম দিয়ে বীজ শোধন এবং রোগের তীব্রতা অনুযায়ী কার্বেন্ডাজিম স্প্রে করার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ |
মরচে (Rust) |
Uromyces decoratus |
পাতার গায়ের উপর বা নীচের দিকে হলুদ এবং সাদা রঙের উঁচু দাগ৷ |
বীজ রোপণের আগে কার্বেন্ডাজিম প্রতি কেজি তে ২ থেকে ৩ গ্রাম দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে৷ |
পাউডারি মিলডিউ |
Oidium sp. |
শুধুমাত্র পুরানো ফসলে আক্রমণ করে৷ |
আক্রান্ত গাছ উপড়ে ফেলে এবং পুড়িয়ে ফেলতে হবে৷ |
ফাইলোডি |
Mycoplasma |
গাছের ডগার দিক ফুল দেওয়ার পরিবর্তে ছোটো ছোটো পাতায় ভরে যায় এবং ঐ গাছের পাতা ছোটো ও ফ্যাকাসে হয় ৷ গাছ পার্শ্বশাখার বৃদ্ধি ঘটিয়ে ঝোপের আকৃতি সৃষ্টি করে৷ |
আক্রান্ত গাছ তুলে ফেলা উচিত৷ |
পোকা |
বিজ্ঞানসম্মত নাম |
প্রভাব |
প্রতিকার |
সাদা মাছি |
Bemisia tabaci |
শণে পাতার মোজাইক, পাতা কুঁচকে যাওয়া এবং দুর্বল ডালপালা সৃষ্টিকারী ভাইরাস ছড়ায়৷ |
অ্যাসিটামিপ্রিড বা ইমিডাক্লোপ্রিড @ ০.২ গ্রাম/লিটার এবং থায়ামেথক্সাম @ ০.১ গ্রাম/লিটার স্প্রে করে এটি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে৷ |
কাণ্ড ছিদ্রকারী |
Laspeyresia tricentra |
শাখা ও কাণ্ডের অংশ ফুলে ওঠে৷ |
আক্রান্ত গাছে প্রতি লিটার জলে ০.৭৫ গ্রাম আ্যসিফেট গুলে স্প্রে করতে হবে৷ |
শুঁয়োপোকা |
Utethesia pulchella |
এই পোকা পাতার নীচে ডিম পাড়ে৷ গাছের পাতা খেয়ে ফেলে, গাছের পাতা কমিয়ে দেয়৷ |
১)ডিমের সাদা ও বাচ্চার গাদা যুক্ত পাতা সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেলতে হবে৷ ২)একর প্রতি ১০ কেজি ক্লোরোপাইরিফস ১.৫% ডাস্ট জমিতে ছড়াতে হবে৷ |
আগাছা নিয়ন্ত্রণ
সাধারণত শণের জমিতে আগাছা দমনের প্রয়োজন পড়ে না, তবে বর্ষার আগে শণ চাষ করলে জমিতে আগাছার প্রচুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেই কারণে জমির আগাছা দমনের দিকে নজর দিতে হবে। সাধারণত ২ বার যথাক্রমে বপনের ১৫-২০ দিন ও ৩০-৪০ দিনের মাথায় নিড়ানি করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়৷ এছাড়াও, আগাছানাশক হিসেবে পেন্ডিমিথালিন বা Stomp ২ থেকে ৪ দিনের মাথায় এবং কুইজালোফপ বা Targa Super, ডিক্লফপ বা Oneshot ২০ থেকে ২৫ দিনের মাথায় ব্যবহার করা যেতে পারে৷
Share your comments