শুধু যে চাষী তা তো নয়, আসলে মানুষের প্রবৃত্তিই হল চটজলদি লাভ। লোভ হয় একরাত্রে বড়লোক হয়ে যাওয়ার। যখন দেরি হয় আমরা ভাবি ইচ্ছে করে ফাঁকি দিচ্ছে বুঝি কেউ! ভাবি হাঁসের পেটে আছে অনেকগুলো সোনার ডিম ব্যাটা ইচ্ছে করে ধোঁকা দিচ্ছে। একটা করে সোনার ডিম পাড়াটা ওর বদমায়েশি! অমনি তার পেট কেটে ফেলে একবারেই সবকটা ডিম পাওয়ার জন্য ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠি। সোনার ডিম তো দূর মাঝখান থেকে হাঁসটাই যায় মরে।
‘সবুজ বিপ্লবে’র ধারণা অনেকটা ওই একঝটকায় বড় লোক করার প্রকল্প হয়ে যায়। বেশি সার, বেশি কীটনাশক মানেই বেশি ফলন। তত্ত্বটি একবারে সোনার ডিমের মতোই। চাষী দেখল সত্যি সত্যিই এইগুলি বেশি করে প্রয়োগ করলে ফলনের আশাতীত বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। তারও মনে বাসনা তৈরি হল আরো আরো সার মানে আরো আরো উৎপাদন মানেই আরো আরো মুনাফা। এই করতে গিয়ে মাটি হারালো তার স্বাভাবিক চরিত্র। অব্যবহৃত অতিরিক্ত সার জলে ধুয়ে ধুয়ে গিয়ে পড়তে লাগলো কাছেরই কোনো জলাশয়ে, সেখানে গিয়ে বাড়িয়ে তুললো শৈবালের বংশ অথবা কচুরিপানার মতো জলজ আগাছার সংসার। তাদের বাড়বাড়ন্ত জলের অক্সিজেন চুরি করে ডেকে আনলো মাছেদের মৃত্যু। হারিয়ে যেতে লাগলো ন্যাদোশ, সড়পুঁটির মতো মাছেরা।
আরও পড়ুনঃ বহু নারীর অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন আনেছা বেগম, সংসার চলে চিনা মুরগী পালনে
ক্ষতির শেষ এখানেই থামলো না। কীটনাশকের অতি ব্যবহার পঙ্গপালকে যেমন মারলো তেমনি কিছু বন্ধু পোকামাকড় যারা ফুলে ফুলে ঘুরে পরাগসংযোগ ঘটিয়ে ফুল থেকে ফল আনতো অথবা তারতম্য ঘটাতো উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যের তাদের অকালমৃত্যু ঘনিয়ে এলো অচিরেই। মানুষ দ্রুত ফসলের বৃদ্ধির আশায় সাময়িক লাভ দেখতে গিয়ে ভবিষ্যতের কথা ভুলে গেল। নরম্যান বোরলগ ছিলেন জাদুকর আর তাঁর ‘সবুজ বিপ্লবে’র তত্ত্ব ছিল জাদু! ফসলের উৎপাদন রাতারাতি দ্বিগুণ তিনগুণ হয়ে গেল। তাঁর উচ্চ ফলনশীল জাতের গমের আবিষ্কার বা দেখাদেখি অন্যান্য ফসলের সংকরায়ণ নিঃসন্দেহে লাভজনক হল কিন্তু সেখানেও কোনো নির্দিষ্টতা থাকল না। সংকরায়ণের মাধ্যমে দুটি জাতের ভালো গুণাগুণ যেমন একজায়গায় আনা যায় তেমন তাদের খারাপ বৈশিষ্ট্যও চলে আসতে লাগলো। আর জাদু দেখে মুগ্ধ এই আমরা নতুন জাতের চাষ করতে গিয়ে আঞ্চলিক বা প্রচলিত আদি জাতগুলির চাষবাস বন্ধ করে দিলাম। তাদের বীজ গুদামে পড়ে থাকতে থাকতে হারাতে লাগলো অঙ্কুরোদগমের ক্ষমতা এবং তাদের বিলুপ্তিও নিশ্চিত হল।
কৃষিক্ষেত্রে ‘যোগান’ বাড়ালে ‘উৎপাদন’ বাড়বে এই কথাতে আপাতভাবে ভুল নেই কোনো। যদি উল্লেখ করে দেওয়া যেত কতটা জমিতে কতটা সার প্রয়োগ করতে হবে, কতটা জমিতে কতটা কীটনাশক ছড়াতে হবে তবে অনেকটা বিপদ এড়ানো যেত। উচ্চ ফলনশীল সংকর জাতের পাশাপাশি প্রচলিত জাতের চাষ চালিয়ে যেতে হবে এমন কথাও যদি বলা থাকতো তবে ভালো হত। অনেকক্ষেত্রেই সংকরায়ণ জাত জাতটির মধ্যে সঞ্চারিত বৈশিষ্ট্যের স্থায়িত্ব থাকে না। প্রথমবারের চাষে ভালো ফলাফল দিলেও পরেরবার ফসল উৎপাদন ব্যাপক হ্রাস পায়। পরিমাণগত এবং গুণগত উভয় ক্ষেত্রেই এই ঘটনা অতি স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ক্রমে আমরা বুঝেছি। রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়েছি অথবা নিয়ন্ত্রণ করেছি। এখন অর্গ্যানিক ফার্মিং এর সময় এসেছে। জৈব সার, জৈব কীটনাশক। সংকর জাত তৈরির পরেও তার ক্রমাগত পরীক্ষা করে তবেই সেটিকে বাজারে আনা হচ্ছে বা স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। চাষীরাও অনেক সাবধানী হয়েছেন। জমির ব্যবহারে অনেক বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিচ্ছেন। নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চাষ চালিয়ে যেতে প্রাকৃতিক সম্পদকেই সুষ্ঠু ব্যবহারের যে বিকল্প নেই, তা পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিখে নিয়েছেন তাঁরা। জৈব প্রযুক্তি বিদ্যাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে এইসব বিষয়ে। যে বৈশিষ্ট্যটি আমরা চাইছি একটি চাষযোগ্য উদ্ভিদদেহে শুধুমাত্র সেই বৈশিষ্ট্যের জিনটি প্রবেশ করাতে পারলে সংকরায়ণের মতো অনির্দিষ্টতা তৈরি হয় না।
আরও পড়ুনঃ আখ চাষে পাচ্ছেন না উপযুক্ত পারিশ্রমিক,চিন্তায় মুর্শিদাবাদের কৃষকরা
একটি নতুন দিগন্ত খুলেছে গবেষণা ক্ষেত্রে সেটি হল ঔষধি গাছের গুণাগুণগুলির প্রয়োগে চাষযোগ্য ফসলের উন্নতি। কালমেঘ, হলুদ, বাসক, তুলসী প্রভৃতির নির্যাস নিয়ে তার মধ্যে চাষযোগ্য ফসলটির বীজ ভিজিয়ে নিয়ে অঙ্কুরিত করলে অথবা চারা অবস্থা থেকে শুরু করে বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায়ে সেই ঔষধি গাছের নির্যাস ছড়িয়ে দিতে থাকলে উদ্ভিদের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়ার ক্ষমতা বা কীট সংক্রমণ থেকে বাঁচার ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পায়। নোনা জমিতে, রুক্ষ জমিতে কম জল ব্যবহার করে গাছ এগিয়ে যায় ভালো উৎপাদনের দিকে। ধানের ক্ষেত্রে অতিবর্ষণে আধডোবা হয়েও গুছি শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা বাড়তে দেখা যাচ্ছে। এমনকি গাছের বৃদ্ধির হার ও উৎপাদনও বাড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। নির্দিষ্ট ঔষধি গাছটির কতটা পরিমাণ মূল বা কান্ড বা পাতা বা প্রয়োজনে পুরো দেহটা নিয়ে নির্যাস নিতে হবে তার পরীক্ষা জারি আছে। নির্যাসটি জলের সাহায্যে সিক্ত করে নিলে ভালো হয় নাকি অ্যালকোহল মাধ্যমে নিয়ে তারপর জলে মেশালে সে বিষয়েও গবেষণা চলছে। আরো একটি বিষয় হল নির্যাসটির সঠিক ঘনত্ব নিরূপণ।
এই বিষয়টির ওপর আরো অনেক গবেষণা করার সম্ভাবনা আছে, যা আগামী দিনে কৃষক-সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। সাসটেইনেবল বা দীর্ঘমেয়াদি কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলতে এমনই সম্ভাবনাময় বিভিন্ন ক্ষেত্রের সন্ধান কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষকদের পাথেয় হবে আগামীদিনে।
Share your comments