বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান মশলা হল জাফরান। জাফরান আসলে একটি ফুলের শুকনো রেণু। ফুল গাছটির নাম ক্রোকাস স্যাটিভাস। মূল্যবান হওয়ার জন্য জাফরানের আরেক নাম লাল সোনা।
ক্রোকাস স্যাটিভাস বিশ্বের যে কোন জায়গায় হতে পারে। এই গাছকে বড় করা কোনও কষ্টসাধ্য নয়। যেটা কষ্টসাধ্য সেটা হল ফুল থেকে রেণুগুলিকে সরিয়ে নেওয়া। এই কাজ করার জন্য প্রচুর শ্রমিকের দরকার। কারণ একটা একটা করে ফুলের রেণু সংগ্রহ করতে হয়। আর এই কাজটির জন্যই জাফরানের এত মূল্য।
ক্রোকাস স্যাটিভাসকে বলে স্যাফরন ক্রোকাস বা স্যাফরন বাল্বস। এই বাল্বগুলি তৈরি হয় করম থেকে। প্রত্যেকটি করম একটি করে নতুন বাল্বের জন্ম দেয়। স্যাফরনের ফুল শরৎকালে ফোটে এবং লাল রঙের রেণু জন্মায়। যেখান থেকে এই মশলা বেরোয়। প্রত্যেকটা ফুলে তিনটি করে রেণু থাকে লাল রঙের এবং এই তিনটি রেণুকে খুব সাবধানে হাত দিয়ে তুলতে হয়।
স্যাফরন ক্রোকাস ইরান, ভারত, আফগানিস্তান, ইতালি, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, পেনসিলভ্যানিয়া, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিস এবং মরক্কোতে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় হওয়ায় চাষের পদ্ধতিও আলাদা হয়। মাটির ধরন, বীজ বপনের গভীরতা, পরিবেশের তারতম্য বা করম বপনের ফারাকের ওপরও জাফরানের বিশিষ্টতা নির্ভর করে।
মাটি
বিঙিন্ন ধরনের মাটিতে জন্মাতে পারে স্যাফরন ক্রোকাস। তবে সবচেয়ে ভালো হয় ভালো মতো জল ঝরে যাওয়া মাটি হলে। শুকনো বা আধা শুকনো মাটিতেও জন্মাতে পারে স্যাফরন ক্রোকাস। তবে মাথায় রাখতে হবে, খুব শুকনো মাটিতে শরৎকাল বা বসন্তকালে জমিতে সেচের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যদি স্যাফরন করম ভিজে বা আধা ভিজে মাটিতে পোঁতা হয়, তাহলে জমি থেকে যাতে জল ঝরে যায়, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। নয়তো করম জল জমে পচে যেতে পারে।
তাপমাত্রা
স্যাফরন ফলনের ক্ষেত্রে কখনোই তাপমাত্রা গরমকালে ৩৫ ডিগ্রি বা ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি হলে চলবে না, আবার শীতকালে -১৫ ডিগ্রি বা -২০ ডিগ্রির কম হলে চলবে না। তাই চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় স্যাফরন ভালো হয় না। খুব বেশি ঠান্ডায় পাতাগুলি শুকিয়ে যেতে পারে, ফুলও ঠিক মতো ফোটে না এবং গেরুয়া রঙও ঠিক মতো ধরে না। যদি হঠাতই খুব ঠান্ডা পড়ে যায়, তাহলে খড় দিয়ে বা ফাইবারের কাপড় দিয়ে গোটা জায়গাটাকে ঢেকে ফেলতে হবে। আর যদি খুব গরম পড়ে যায়, তাহলে বসন্তকালে একবার সেচের ব্যবস্থা করতেই হয়। তবে যদি এই সময় বৃষ্টিপাত খুব ভালো হয়, তাহলে তো কথাই নেই। এর চাইতে ভালো আর কিছুই হতে পারে না ফুল ফোটার ব্যাপারে।
বপন
স্যাফরন করম বপনের সময় মাথায় রাখতে হবে সেখানে যেন আগে কখনো স্যাফরন করম বপন না করা হয়ে থাকে। প্রায় ১০ বছর হলে সবচেয়ে ভালো হয়। বপনের সময় মাটিতে প্রায় ২০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার গর্ত খুঁড়তে হবে। যাতে করম দেওয়ার পরেও ভালো করে হাওয়া বাতাস খেলতে পারে। সঙ্গে দিতে হবে অর্গানিক সার। সেচ বা জল ঝড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। করম থেকে যখন পাতা বেরোবে তখন একবার অন্তত সেচ খুব প্রয়োজন। জুলাই, অগস্ট বা সেপ্টেম্বরে করম পুঁতলে অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের মাঝামাঝি ফলন শুরু হয়। বপনের আট সপ্তাহ পর থেকে। স্যাফরন ক্রোকাস সূর্যালোকে ফুটতে বেশি পছন্দ করে, ঢাকা জায়গার তুলনায়। করম সাধারণত ৭-১৫ সেন্টিমিটার গভীরে পোঁতা হয়। মনে রাখতে হবে যত বেশি গভীরে পোঁতা হবে করম, গুণমানে তত বেশি সমৃদ্ধ হবে স্যাফরন।
সিডবেড ব্যবস্থা
শ্রেণি বিন্যাসের মাধ্যমে করম পুঁততে হবে। প্রতিটি শ্রেণির মধ্যে ১৫ থেকে ২০ সেন্টিমিটার দূরত্ব থাকবে। এতে ড্রেনেজ এবং ভেন্টিলেশন দুটোরই সুবিধা থাকবে। দুটো শ্রেণির মাঝখান দিয়ে যদি হাঁটার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে প্রতিটি গাছকে আলাদা করে পরিচর্যাও করা যাবে। দুটো করমের মধ্যে কতখানি দূরত্ব থাকবে তা পুরোটা নির্ভর করে করমের মাপের ওপরে। গড়ে দুটি করমের মাঝখানে ৫-১০ সন্টিমিটার দূরত্ব থাকে এবং বড়গুলির ক্ষেত্রে ১০-২০ সেন্টিমিটার।
সঠিক পরিচর্যা হলে স্যাফরন ক্রোকাস চার বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। পঞ্চম বছরে তাকে নির্মূল করা যেতে পারে। স্যাফরন ক্রোকাসের গোড়ায় আগাছা জন্মানো একেবারেই উচিৎ নয়। কীটনাশকও ব্যবহার করতে হবে বুঝে। বিশেষ করে খরগোশের হাত থেকে সাবধান।
ফুল ফোটা
অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ফুল ফুটতে থাকে এবং তা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে থাকে। ফুল সাধারণত রাতে ফোটে। পরেরদিন ভোরেই সেই ফুল তুলে ফেলা ভালো। দুপুর পর্যন্ত গড়ালে আবার পাঁপড়ি ঝরে যেতে পারে।
রেণু আলাদা করা
ফুলগুলিকে তুলে নিয়ে এক জায়গায় জড়ো করা হয়, তারপর একটা একটা করে ফুল থেকে লাল রেণু আলাদা করা হয়। সাদা বা হলুদ অংশটি নয়। এরপর রেণুগুলোকে শুকতো দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে ৬০ ডিগ্রি তাপমাত্রার চেয়ে বেশি যেন না হয় এবং প্রত্যেকটা রেণু যেন খুব ভালো করে শোকানো হয়। শুকিয়ে যাওয়ার পর ওজন এবং মাপ দুটিই কমে যায় প্রায় ৮০ শতাংশ। যেমন পাঁচ কিলো রেণু শুকিয়ে যাওয়ার পর মাপ এক কিলো হবে কী না সন্দেহ। গরম কয়লার ওপর বা ওভেনেও এই শুকনো করার কাজটা করা যায়। যতক্ষণ না পর্যন্ত কালচে লাল রঙ ধারণ করে রেণুগুলি।
শুকিয়ে গেলে এগুলিকে পাত্রে নিয়ে অন্তত ৩০ দিন পর্যন্ত ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হয়। তারপর পরিমাণ মতো সেগুলিকে ব্যবহারের জন্য পাঠানো হয়।
ত্রয়ী মুখার্জী
Share your comments