জলের অভাবের জন্য খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে বিশ্বজুড়ে, বলছে একটি সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন। রাষ্ট্রপুঞ্জ বাহান্নটি দেশের একশো আট জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে গড়েছিল জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক উপদেষ্টামণ্ডলী। প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এই প্রথম পৃথিবীর প্রধান খাদ্য উৎপাদক দেশগুলিতে একসঙ্গে জলাভাব হতে চলেছে। ফলে বিশ্বব্যাপী খ্যাদাভাব দেখা দিতে পারে। কোপ পড়বে গরিবের উপরেই বেশি। তবে এখনই যদি সব দেশ পূর্ণ উদ্যমে সচেষ্ট হয়, তবে জলসংকট রোখা যেতে পারে।
বিদ্যুতে অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার করতে আজ থেকে প্রাণপণ চেষ্টা করলেও কাজ হতে সময় লাগবে। অথচ ভারত-সহ সতেরোটি দেশে জলসংকট এখনই শুরু হয়ে গিয়েছে। অনেকে মনে করেন, ভারতের হাতে পাঁচ বছরের বেশি সময় নেই। যে কাজগুলো এখনই করতে হবে তা হল জলের সঞ্চয়, অপচয় থামানো, জলসৃজন ও ন্যায্য জলবণ্টন।
পশ্চিমবঙ্গে মোট বৃষ্টিপাতের ৮০-৯০ শতাংশ হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর এই ৪ মাসের মধ্যে। উদ্ধৃত বৃষ্টির জল জমির ঢাল বেয়ে ও অজস্র নদী নালার মাধ্যমে বয়ে চলে যায়। ভূগর্ভে যাওয়া জলের পরিমাণ সেই তুলনায় অনেক কম। এই জলকে ধরে রাখতে পারলে একদিকে যেমন ভূগর্ভের জলস্তর বাড়বে তেমনই খরিফের পরবর্তী দুই মরসুমে স্বচ্ছন্দে চাষের জন্য জলের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব।
উঁচু নীচু জমিগুলিতে কিছু জল সংরক্ষণ পদ্ধতির কথা আলোচনা করা হল -
১) ঢালু জমির চারিদিকের আলকে মজবুত করে বেঁধে ঢাল বেয়ে জমিতে জল ঢোকা ও বেরিয়ে যাওয়ার পথকে সোজাসুজি না রেখে যথা সম্ভব দূরে রাখার ব্যবস্থা করা, যাতে জমিতে জলের অবস্থান দীর্ঘতর হয়। এর ফলে একদিকে যেমন আর্থিক সময় ধরে মাটি ভেজার অবকাশ পাবে অপরদিকে তেমনই প্রবেশ স্তর দিয়ে জল ভূগর্ভে প্রবেশের সুযোগ বাড়বে এর ফলে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের সমৃদ্ধি ঘটবে।
২) বন্ধুর ভূপ্রকৃতি ও যেখানে মাটিতে জল ভূগর্ভস্থ স্তরে সহজে প্রবেশ করে না, সেখানে প্রতিটি প্লেটের এক দশমাংশ জমিতে জল ধরে রাখার জন্য ছোট ছোট ডোবা বা জলাধার তৈরি করে রাখতে হবে। যাতে বৃষ্টির জল কিংবা জমির ওপর দিয়ে গড়িয়ে আসা জল ঐ সমস্ত প্লটের ফসলকে আপৎকালীন অবস্থায় জলসেচ সরবরাহ করবে সাথে সাথে ভূগর্ভস্থ জলস্তরেরও নবীকরণ সম্ভবপর হবে।
৩) পুরানো জলাধার সংস্কার ও নতুন জলাধার নির্মাণ - প্রতিটি এলাকাতেই ছড়িয়ে আছে অসংখ্য প্রাকৃতিক জলাশয়। বৃষ্টির অতিরিক্ত জল ধরে রাখার জন্য সামাজিকভাবে এগুলি তৈরি। এই জলাশয়গুলিকে পুনঃসংস্কারের মাধ্যমে জল সংরক্ষণ সম্ভব। এছাড়াও জমির ঢালকে ব্যবহার করে এবং জল নির্গমনের অপেক্ষাকৃত সঙ্কীর্ণ পথে বাঁধ দিয়ে জল আটকে খুব সহজেই অনেক বেশী জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করা সম্ভব।
৪) এলাকা ও জলবায়ু উপযোগী শস্য এবং জাত নির্বাচন, বোরো ধানের চাষ থেকে যথা সম্ভব বিরত থাকা, অনুসেচের ব্যবহার, ভাসিয়ে জলসেচ না করার মাধ্যমে আমরা জল সংরক্ষণে ব্রতী হতে পারি। বৈচিত্র্যময় কৃষি, ডালশষ্যের চাষ, ফসলের সংকটময় অবস্থায় সেচ এই কাজে খুব সহায়ক হতে পারে। বণভূমিকে সংস্কার ও নিবিড় করার ক্ষেত্রে সেই সব গাছ লাগানোর উপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ বিজ্ঞান সম্মত ব্যবহার এই ভাবেই যে কোন অঞ্চলের সুসংহত উন্নতি সম্ভবপর হবে।
আরও পড়ুন - এই মরসুমে চিনেবাদাম চাষ করে আয় করুন অতিরিক্ত অর্থ
দীর্ঘমেয়াদি উপায় –
জল সংরক্ষণের কয়েকটা দীর্ঘমেয়াদি উপায় আছে, যেমন গাছ লাগানো। একটা-দুটো নয়, এক লক্ষ কোটি গাছ। বৃষ্টির জল সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে যেমন শিল্প এলাকাগুলিতে এবং নতুন তৈরি পাকাবাড়ীগুলিতে বৃষ্টির জল সংগ্রহের পরিকাঠামো বাধ্যতামূলক করতে হবে। পুকুর, হৃদ ও অন্যান্য জলাশয়ে জলসঞ্চয়ের যথাযথ ব্যবস্থা করতে হবে। জনগনকে সচেতন করাতে হবে ভুগর্ভস্থ জল সমস্যার আসন্ন বিপদগুলি সম্বন্ধে। প্রতিটি এলাকার জলস্তরের কথা চিন্তা করে নলকূপ বসানো বা কূপ খোঁড়ার অনুমতি সরকারকে দিতে হবে। পৃথিবীতে নোনাজলই বেশি। মিষ্টি জল মাত্র দুই শতাংশ, তারও বেশি খানিকটা দুই মেরুতে বরফ হয়ে আছে। স্রেফ ০.৫ শতাংশ ব্যবহারের যোগ্য। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জল বাড়ছে, মিষ্টি জলের অনুপাত কমছে। তাই নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমুদ্রের জল নুনমুক্ত করে মিষ্টি জল বানাতে পারলে অভাব অনেকটা মেটে।
ভারত সহ বেশ কিছু দেশে এই প্রযুক্তি আরম্ভ হয়েছে যেমন ইজরায়েল সৌরশক্তিতে জলের কারখানা চালায় এবং তা থেকে কৃষিকাজ সম্পন্ন হয়। জল সমস্যা সমাধানের প্রকল্পগুলি সবই ব্যয়সাপেক্ষ এবং পানীয় জলের জোগান বজায় রেখে যাওয়ার আর্থিক চাপ বহন করতে হবে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল নগরবাসীদের, যাতে গরিবরাও জল পান।
আরও পড়ুন - সব্জি ফসলের কৃমির আক্রমণের সুসংহত প্রতিকার পদ্ধতি সম্পর্কে বিশদ আলোচনা
Share your comments