আর্থ-সামাজিক উন্নয়ণে সিসল নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা

ভারতের আদিবাসী (উপজাতি তালিকাভূক্ত জনসমাজ) সম্প্রদায়ের বেশির ভাগের বাস সাধারণত দুটি অঞ্চলে বেশি দেখা যায়।

KJ Staff
KJ Staff
প্রতীকি ছবি।

কৃষিজাগরন ডেস্কঃ ভারতের আদিবাসী (উপজাতি তালিকাভূক্ত জনসমাজ) সম্প্রদায়ের বেশির ভাগের বাস সাধারণত দুটি অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। প্রথমত উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে এবং দ্বিতীয়ত মধ্যভারতীয় মালভূমি অঞ্চলে। মধ্যভারতের এই রাজ্যগুলি হলো- ঝাড়খন্ড, ছত্রিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা (পশ্চিমাঞ্চল) এবং পশ্চিমবঙ্গ (পশ্চিমাঞ্চল)। একথা অনস্বীকার্য যে স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি বেশ কিছুটা হলেও আশানুরূপ হয়নি। ছত্রিশগড়, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ এবং ওড়িশার গ্রামীণ জনসংখ্যার বড় অংশ (২৫.৭ থেকে ৩৬.৯ শতাংশ) অদিবাসী (সারণি-১)। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশে ১৯ টি, ওড়িশায় ১৪ টি এবং ঝাড়খন্ড ও ছত্রিশগড়ের ১৩ টি করে জেলায় আদিবাসীদের জনসংখ্যা শতকরা ২৫ ভাগের বেশি।

এই রাজ্যগুলির আদিবাসীদের গড় শিক্ষার হার এখনো সর্বসাধারণের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। অর্থনৈতিক বিচারে দেখা যাবে আদিবাসীদের মূখ্য অংশ এখনো দারিদ্র সীমার নীচে। দারিদ্র সীমার নীচে থাকা আদিবাসীদের শতকরা সংখ্যা ওড়িশায় সবথেকে বেশি (৭৫.৬ ভাগ), তারপরে মধ্যপ্রদেশে ৫৮.৬ ভাগ, ছত্রিশগড়ে ৫৪.৭ ভাগ, ঝাড়খন্ডে ৫৪.২ ভাগ এবং পশ্চিমবঙ্গে ৪২.৪ ভাগ - যা কিনা পিছিয়ে পড়া অবস্থাই দেখায়। জোতের মাপ অনুযায়ী এই মালভূমি অঞ্চলের গ্রামীণ আদিবাসী কৃষকদের বেশিরভাগই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষি (সারণি-২)। এই অদিবাসীরা যারা কৃষির সঙ্গে যুক্ত তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই প্রকৃত কৃষক। বাকি বেশির ভাগই কৃষিশ্রমিক হিসাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। গ্রামীণ অঞ্চলে মোট কর্মসংস্থানের সিংহভাগই কৃষিশ্রম থেকে আসে। এই কৃষিশ্রমের দ্বারা কর্মসংস্থানের পরিমান ছত্রিশগড়ে ৭৩.৪ ভাগ, মধ্যপ্রদেশে ৬৮.৭ ভাগ, ওড়িশায় ৬৪.৯ ভাগ, ঝাড়খন্ডে ৬১.১ ভাগ ও পশ্চিমবঙ্গে ৫৮.৮ ভাগ।

আরও পড়ুনঃ আপনি এভাবে ঘরেই বসেই চেরি টমেটো চাষ করতে পারেন

আদিবাসীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নয়ণ না হওয়ার পিছনে অন্যান্য কারণের সঙ্গে কৃষিতে নিম্ন উৎপাদনশীলতা বিশেষ ভাবে দায়ী। এই অঞ্চলে সেচ-সেবিত জমির পরিমান কম এবং বৃষ্টি-নির্ভর খরিফ খন্দে প্রচলিত এবং অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কেবলমাত্র ধান বা ঐ জাতীয় তন্ডুল শস্যের চাষ করার ফলে ফলন অনেকটাই কম। তাছাড়া জলবায়ুর ক্রম পরিবর্তন, অন্যান্য অঞ্চলের মতোই (বা কিছু ক্ষেত্রে বেশি প্রকট) এই অঞ্চলকেও বেশি উষ্ণ করে তুলেছে। সেই সঙ্গে বৃষ্টিপাতও ক্রমশ অনিয়মিত হবার প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। প্রায়ই লক্ষ্য করা গেছে, বৃষ্টিহীন টানা বেশ কিছুদিন চলার পরে, অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রচুর পারিমানে বৃষ্টি হচ্ছে। এই অঞ্চলের মাটি এবং আঞ্চলিক ঢাল অল্প সময়ের মধ্যে হওয়া বৃষ্টির জলকে মাটির গভীরে প্রবেশ করানোর উপযুক্ত নয়। ফলে সেই বৃষ্টিপাতের বেশির ভাগটাই ভূগর্ভস্থ জলস্তরে পৌঁছতে পারে না বা সহজে বলা যায় কোনো কাজে লাগে না, বরং মাটি ক্ষয়ের বা ভূমি ধ্বসের কারণ হয়। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ দিনের জলবায়ুর বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন যে ভারতে তাপমাত্রার গড় বৃদ্ধি ২০২০ সালে ১.৮১ ডিগ্রি, ২০৫০ সালে ২.৮৭ ডিগ্রি এবং ২০৮০ সালে ৫.৫৫ ডিগ্রি বা তারও বেশি হবে।

আরও পড়ুনঃ Zero Tillage: উত্তর দিনাজপুর কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রে নয়া পদ্ধতিতে গমের চাষ

তাপমাত্রার এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির প্রভাব সারা দেশের সঙ্গে এই মধ্য মালভূমি অঞ্চলে আরো বেশি করে প্রকট হবে এবং এর কুপ্রভাবে কৃষির ফলন কমবে ও চাষ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। মধ্যভারতের মালভূমি অঞ্চলের আদিবাসীরা ইতিমধ্যেই আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে আছে তাছাড়া পরিবর্তিত জলবায়ুতে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার আরো অবনতি হবার আশঙ্কা থাকছে। গ্রামীণ আদিবাসীদের প্রচলিত কৃষিতে সময়োপযোগী বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার এবং তার সঙ্গে  অপ্রচলিত ফসলের গ্রহনযোগ্যতা বাড়াতে হবে, যা কিনা পরিবর্তিত জলবায়ুতে খাপ খাইয়ে যথেষ্ট উৎপাদন দেবে এবং চাষিদের মুনাফা বাড়বে। এই ধরনের নতুন পদ্ধতির এবং নতুন ফসলের চাষ ভিন্ন গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থার অবনতি রোধ করা যাবে না। ফলস্বরূপ আদিবাসীরা অর্থনৈতিক ভাবে ক্রম অবনতির দিকে যাবে, অর্থনৈতিক অসাম্য সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। এই অনভিপ্রেত পরিস্থিতি থেকে মধ্যভারতীয় মালভূমি অঞ্চলের আদিবাসীদের বাঁচাতে পরিবর্তিত জলবায়ুতে এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে সিসল চাষ এবং সিসল তত্ত্ব উৎপাদনের কথা ভাবা যেতে পারে। প্রকৃত অর্থে সিসল এই অঞ্চলের জন্য নতুন কোনো উদ্ভিদ নয়। এই অঞ্চলে বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে সিসল প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেঁচে আছে এবং এখানকার চাষিরা এর চাষ ও করেন। তবে এই ফসলের চাষ পুরোপুরি ভাবে অযত্নে ও অবহেলায় করা হয়। এখানে সিসলের পরিচয় সম্মন্ধে দু'একটা কথা বলা দরকার। সিসল-এসপ্যারাগাছি উদ্ভিদ পরিবার ভুক্ত, বহুবর্ষজীবী মরু উদ্ভিদ, যার তলোয়ারের মতো শক্ত লম্বা পাতা থেকে তন্ত্র নিষ্কাশন করা হয়। ভারতে বিভিন্ন ধরনের সিসল পাওয়া যায়, তবে এ্যাগেভ সিসলানা, এ্যাগেভ ক্যান্টালা ইত্যাদি প্রধান। স্থানীয় ভাষায় সিসলের বিভিন্ন নাম চালু আছে। ওড়িয়া ভাষায় সিসলকে 'মোরবা' বা 'মোরাব্বা' বা 'হাতিবেড়া'; দক্ষিণ ভারতীয় ভাষায় 'কাট্টালাই' বা' কাখাড়া'; উত্তর ভারতে 'রামবাঁশ' এত্যাদি নাম প্রচলিত আছে। পরিবর্তিত ও উষ্ণ জলবায়ুতে সিসল সহজেই চাষ করা যায় এবং উৎপাদনশীলতা বজায় থাকে। সিসল যথেষ্ট গরম আবহাওয়া সহ্য করতে পারে, চাষ করতে কোনো জলসেচের প্রয়োজন হয় না (বৃষ্টি নির্ভর চাষ), এই চাষে পুরো জমিতে লাঙ্গল দিয়ে মাটি আলগা করতে হয় না (ছোট ছোট গর্ত করে চারা লাগানো হয়) ফলে মাটি ক্ষয়ের আশঙ্কা নেই, বরং লাইন করে সিসল লাগালে জমিতে বৃষ্টির জলের স্রোতের দ্বারা সৃষ্ট মাটির ক্ষয় রোধ করে এবং বৃষ্টির জল মাটির গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। সিসল চাষের জন্য উর্বর জমির প্রয়োজন হয় না বরং অনেক ক্ষেত্রেই পতিত এবং অন্য ফসলের চাষের অনুপযুক্ত জমিতেও সিসল সাফল্যের সঙ্গে চাষ করা যায়। সিসলের পাতায় মোম জাতীয় জৈব পদার্থের স্বাভাবিক প্রলেপ থাকার ফলে এই ফসল কীটশত্রু ও রোগ দ্বারা বেশি আক্রান্ত হয় না। সেজন্য এই চাষে কৃষিবিষের ব্যবহার হয় না বা নগন্য, তাই বলা যায় এই ফসলের চাষ প্রকৃতিকে দূষিত করেনা।

লেখকঃ কেন্দ্রীয় পাট ও সহযোগী তত্ত্ব অনুসন্ধান সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী (শস্য বিজ্ঞান) ডঃ সিতাংশু সরকার

Published On: 27 November 2023, 12:38 PM English Summary: Sisal dependent agriculture system in socio-economic development

Like this article?

Hey! I am KJ Staff . Did you liked this article and have suggestions to improve this article? Mail me your suggestions and feedback.

Share your comments

আমাদের নিউজলেটার অপশনটি সাবস্ক্রাইব করুন আর আপনার আগ্রহের বিষয়গুলি বেছে নিন। আমরা আপনার পছন্দ অনুসারে খবর এবং সর্বশেষ আপডেটগুলি প্রেরণ করব।

Subscribe Newsletters