কচুরিপানা (Weed Hyacinth) অতি অল্প দিনে এই উদ্ভিদ দ্রুত বংশ বিস্তার করে। বিশ্বব্যাপী এই উদ্ভিদটি ছড়িয়ে রয়েছে। সাধারণত অনেকেই এই কচুরিপানাকে আগাছা বলেই মনে করেন। কারণ জলে এটির আধিক্যে যেমন প্রবহমান জলের স্রোত বন্ধ হয়ে নৌ চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়, তেমনই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের টার্বাইনে জড়িয়ে তা রুদ্ধপ্রাপ্ত হতে পারে। তা ছাড়া বদ্ধ জলে কচুরিপানার জন্য সাপ এবং বিভিন্ন পতঙ্গের উপদ্রব দেখা যায়। এই কারণে এই উদ্ভিদটিকে সাধারণত আগাছা বলেই মনে করা হয়। কিন্তু কচুরিপানার মূল পচে যাতে পতঙ্গের বৃদ্ধি না ঘটে, তার আগেই সরিয়ে তাদের সার রূপে কাজে লাগানো যায়।
জল দূষণমুক্তকরণ (Water Purification) -
সাম্প্রতিককালে কয়েকজন বিজ্ঞানী কচুরিপানা নিয়ে গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, এটি আসলে এক অমূল্য সম্পদ। আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী সত্তরের দশকে দেখিয়েছিলেন, কলকারখানার দূষিত জল থেকে কচুরিপানার শিকড় এক দিনের মধ্যেই শুষে নিতে পারে নিকেল এবং ক্যাডমিয়ামের শতকরা ৯৭ ভাগ। দূষিত জল থেকে নানা ভারী ধাতু কিংবা ফেনলের মতো বহু জৈবিক অপদ্রব্য নিষ্কাশন করে, সেই জলকে অন্তত ৭৫-৮০ ভাগ দূষণমুক্ত করতে পারে কচুরিপানা।
কৃষিতে কচুরিপানার ব্যবহার নানা দেশে নানা ভাবে হয়ে আসছে। আফ্রিকা মহাদেশের লেক ভিক্টোরিয়ার পার্শ্ববর্তী কয়েকটি দেশের অনেক মানুষ এর উপর নির্ভরশীল। সেখানকার চাষীরা স্বেচ্ছায় কচুরিপানা তুলে নিয়ে জৈব সার তৈরি করে সবজি চাষ করছেন। কৃষি গবেষকরা বলছেন, এই সারে নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম ও ফসফরাস যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। আর এই সার প্রয়োগে মাটির অনুজীবদের কোনও ক্ষতি হয় না এবং মাটির আর্দ্রতাও বজায় থাকে। ত্রিপুরাতে চা বাগানে কিছু জায়গায় কচুরিপানা বিছিয়ে সেচ প্রয়োগ করে আর্দ্রতা বজায় রাখা হয়। কচুরিপানা পচিয়ে যে শতকরা ৬০-৮০ শতাংশ মিথেন গ্যাস পাওয়া যায়, তা থেকে জ্বালানি গ্যাসও উৎপাদন করা যাবে।
প্রফেসরদের বক্তব্য অনুযায়ী, ভার্মি কম্পোস্টের জন্য অন্যান্য কৃষিবর্জ্য থেকে জৈবসার হতে যেখানে ৭০ দিন সময় লাগে, সেখানে কচুরিপানা থেকে কম্পোস্ট ৫৫ দিনের মধ্যে হয়ে যায়। এছাড়া বিভিন্ন উদ্যান ফসলের জন্য যেখানে হেক্টর প্রতি ১০ থেকে ১৫ টন জৈবসার লাগে, সেখানে কচুরিপানার কম্পোস্ট লাগে মাত্র আড়াই থেকে তিন টন। তবে কচুরিপানার মূল নির্যাস ধানের কাণ্ডের বৃদ্ধির সহায়ক হলেও, ধানের মূলের বৃদ্ধির প্রতিরোধক। কচুরিপানার নির্যাস জিব্বেরেলিন অ্যাসিড (গ্রোথ হরমোন) পাট, টমেটো, পালং ইত্যাদির উপর প্রয়োগ করে আশাতীত সাফল্য লাভ দেখা গিয়েছিল। এতে পাটের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটে এবং আঁশের পরিমাণ অনেক বেশী হয়। প্রয়োগের সাত দিনের মধ্যেই এই প্রতিক্রিয়া দৃশ্যমান হয়। পালংয়ের পাতা, ডালিয়া ফুলের আকৃতি পূর্বের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পায়। এছাড়া গো-খাদ্য হিসেবে ও টার্কি মুরগির খাবারের সঙ্গে এক-চতুর্থাংশ কচুরিপানা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়।
আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন ছোট-বড় শহরগুলিতে কলকারখানার বর্জ্য, নর্দমার বা খাটালের পূতিগন্ধময় দূষিত জল সরাসরি গঙ্গায় বা অন্যান্য ছোট নদীতে পড়ে সে জলও বিষিয়ে দিচ্ছে। সেই জন্য সব নদীতে মাছের পরিমাণ ক্রমহ্রাসমান। কিন্তু এই দূষিত জল কচুরিপানা সমেত কোনও সংরক্ষিত জলাশয়ে কিছু দিন রেখে, দূষণমুক্ত করে, তার পর নদীতে প্রবাহিত করলে তার জল থাকবে অনেকটা নির্মল।
Share your comments