অতি সম্প্রতি একটি সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, আমাদের দেশে সবজীর উৎপাদন সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় আগাছার কারণে (৪৫%), যা সমগ্র ক্ষতির এক তৃতীয়াংশের বেশী (বাকি ক্ষতির পরিমান:- ক্ষতিকারক পোকা/পেস্ট-৩০%, রোগ-২০% ও অন্যান্য-৫%)। মরসুম নির্বিশেষে প্রায় প্রতিটি সবজীর ক্ষেতেই কমবেশী বিভিন্ন প্রজাতির আগাছার দেখা মেলে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে আজকাল নতুন নতুন বিভিন্ন প্রজাতির আগাছারও দেখা মিলছে আমাদের দেশে, যা আগে দেখা যেত না বা দেখা গেলেও তাদের দ্বারা ক্ষতির পরিমাণ ছিল নগণ্য। প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এরা খুব সহজেই মানিয়ে নিতে পারে ও মূল ফসলের সাথে বিভিন্ন মৌলিক প্রয়োজনীয় উপাদানগুলির জন্য অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় (Crop weed unhealthy competition ) লিপ্ত হয়। এতে ফলন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আগাছা কী ?
যে কোন অবাঞ্ছিত, সমস্যা সৃষ্টিকারী বা অনিষ্টকারী উদ্ভিদ যা বিনা বপনেই অতিমাত্রায় নিজে থেকে জন্মায়, তাকেই আগাছা বলা যেতে পারে। এরা সাধারণত প্রতিযোগী ও অদম্য স্বভাবের এবং অল্প সময়ে অধিক বংশবিস্তারে সক্ষম। সাধারণত এঁদের জীবনচক্র স্বল্পমেয়াদী, তবে এর ব্যতিক্রমও আছে। আগাছা প্রজাতির প্রায় এক তৃতীয়াংশ একবীজপত্রী উদ্ভিদ আর বাকিগুলি দ্বিবীজপত্রী।
আগাছার ক্ষতিকর প্রভাব –
১) প্রতিযোগীতামূলক ও অদম্য স্বভাব – আগাছা মূল সবজী ফসলের সাথে খাদ্য, জল, আলো ও স্থানের জন্য প্রতিযোগিতা করে। এতে ফলন আশাপ্রদ হয় না ও কৃষকবন্ধুরা ক্ষতির সম্মুখীন হন।
২) চাষের খরচ বৃদ্ধি – আগাছা দূরীকরণের জন্য কৃষকবন্ধুদের বিভিন্ন দমনমূলক পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়, এতে চাষের খরচ উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পায়।
৩) রোগ সৃষ্টিকারী – শিয়ালকাঁটা (Argemone mexicana), গাজরঘাস (Parthenium sp), হাতিশুঁড় (Heliotropium indicum) ইত্যাদি কিছু আগাছা অ্যালার্জি বা চর্মরোগ জাতীয় শারীরিক অসুস্থতার কারণ হিসাবে পরিগণিত হয়। আবার লজ্জাবতী (Mimosa pudica), গোক্ষুর (Tribulus terrestris), হাঁচুটে (Centipeda minima) বা ধুতুরা (Datura stramonium) ইত্যাদি আগাছার সংস্পর্শে আসলে অনেকের মাথাধরা, হাঁচি, মাথাঘোরা, বমি বমি ভাব জাতীয় লক্ষণ প্রকাশ পায়।
৪) রোগ ও পোকার আশ্রয়স্থল – আগাছা ফসলের বিভিন্ন রোগ জীবাণু ও পোকার আশ্রয়স্থলের (Host) ভূমিকা পালন করে। এতে রোগ ও পোকার আক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় ও বহুলাংশে ফলন মার খায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কাঁটানটে (Amaranthus spinosus), জাবপোকা (Aphids), সাদা মাছি (White Fly) ও চোষী পোকার (Thrips) আশ্রয়দাতা হিসাবে অতি পরিচিত।
৫) জাতের বিশুদ্ধতা নষ্ট – ইতর পরাগযোগের (Cross Pollination) কারণে আগাছা বিভিন্ন ফসলের নির্দিষ্ট জাতের (variety) বিশুদ্ধতা নষ্ট করে।
৬) বীজের অঙ্কুরোদগমে বাধা – পার্থেনিয়াম জাতীয় কিছু আগাছা পরিবেশে কিছু বিষাক্ত ও রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে, এতে বীজের অঙ্কুরোদগম ও পরবর্তীতে চারা গাছের বৃদ্ধি ব্যহত হয়।
আগাছা যে সবসময় ক্ষতিকর তা কিন্তু নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আগাছার কিছু উপকারী প্রভাবও আছে। যেমন-
ক) কিছু কিছু আগাছা ভূমিক্ষয় রোধ করে।
খ) মাটিতে মিশে ও পচে গিয়ে মাটিতে পরিপোষকের পরিমাণ বাড়ায়।
গ) অনেক আগাছা ঔষধিগুণে ভরপুর, তাই এগুলি আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বহুল পরিচিত ও ব্যবহৃত।
ঘ) শিয়ালকাঁটা, দূর্বাঘাস ইত্যাদি কিছু আগাছা মাটির ক্ষারত্ব (Alkalinity) কমাতে সাহায্য করে।
ঙ) কিছু জলজ আগাছা যেমন, কচুরিপানা (Eichhornia crassipes) ভারী ধাতু ও জলাশয়ের বিভিন্ন বিষাক্ত পদার্থ শোষণ করে ও জলের বিশুদ্ধতা বজায় রাখে। এছাড়া এখন ব্যবসায়িক ভিত্তিতে কচুরিপানা পচিয়ে জৈব সারও তৈরী হচ্ছে।
চ) শিম্বী গোত্রীয় কিছু আগাছা বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেন মাটিতে নিবদ্ধীকরণে সহায়তা করে।
ছ) বথুয়া (Chenopodium album), কাঁটানটে ইত্যাদি আগাছাগুলি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ হওয়ায় আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় গুরুত্বপূর্ণ শাকজাতীয় সবজী (Leafy vegetables) হিসেবে স্থান পায়।
আগাছার প্রকারভেদ–
পোয়েসি (Poaceae) পরিবারভুক্ত যে কোন আগাছাই ‘ঘাস’ (Grass) হিসাবে পরিচিত। আবার সাইপেরেসি (Cypereceae) পরিবারভুক্ত আগাছাদের ‘সেজ’ (Sedge) বলা হয়। এগুলি ছাড়া বাকি সমস্ত দ্বিবীজপত্রী আগাছাই চওড়া পাতার।
সঠিক সময়ে ফসলে আগাছানাশক স্প্রে করে পান ফসলের দ্বিগুণ উৎপাদন (Herbicides on crops) গুরুত্বপূর্ণ কিছু সবজী ফসলের আগাছানাশক স্প্রে করার সময়সূচী
জীবনচক্রের উপর ভিত্তি করে আগাছার শ্রেণীবিভাগ –
ক) একবর্ষজীবী (Annual) – এই শ্রেণীভুক্ত আগাছারা এক বছরের মধ্যে এঁদের জীবনচক্র সমাপ্ত করে। এরা সাধারণত বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। আবার প্রাদুর্ভাবের সময় অনুযায়ী বার্ষিক আগাছাগুলিকে তিনভাগে বিভক্ত করা যায় –
১) বর্ষাকালীন/ খারিফ মরসুম আগাছা (Kharif season weeds) – এরা খারিফ মরসুমে (জুন থেকে অক্টোবর) জন্মায় ও জীবনচক্র সম্পন্ন করে।
উদাহরণ – কুলফা/শ্বেত পুণর্নবা (Trianthema portulacastrum), কাঁটানটে (Amaranthus spinosus), বড় দুধিয়া (Euphorbia hirta), ছোট দুধিয়া (Euphorbia parviflora), বড় শ্যামা ঘাস (Echinochloa crus-galli), ছোট শ্যামা (Echinochloa colona), শ্বেত দ্রোণ (Leucas aspera), উচুন্টি (Ageratum conyzoides), কালোকেশী (Eclipta alba), নুনিয়া শাক (Portulaca oleracea), মুথা ঘাস (Cyperus rotundus), দূর্বা ঘাস (Cyanodon dactylon) , হুরহুরে (Cleome viscosa) ইত্যাদি।
২) শীতকালীন রবি মরসুম আগাছা (Rabi season weeds) - এরা রবি মরসুমে (অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী) জন্মায় ও জীবনচক্র সম্পন্ন করে।
উদাহরণ – বৃক্ষনীল (Anagalis arvensis), হরিণখুড়ি/ মেঠোবিন্দ (Convolvulus arvensis), পেঁয়াজি (Asphodelus tenuifolius), বথুয়া (Chenopodium album), বন-মেথী (Melilotus alba), কালীলতা (Desmodium triflorum)।
৩) খারিফ পূর্ববর্তী/গ্রীষ্মকালীন (Pre kharif season weeds) - এরা খারিফ পূর্ববর্তী/গ্রীষ্মকালীন মরসুমে (ফেব্রুয়ারী থেকে জুন) জন্মায় ও জীবনচক্র সমাপন করে।
উদাহরণ - নুনিয়া শাক, শিয়ালকাঁটা, বিষকাঁটালি (Polygonum barbatum), দূর্বাঘাস, বন-সালফা (Fumaria officinalis), ভাট/ঘেঁটু (Clerodendrum viscosum), ক্ষুদি-ওকরা (Chrozophora pilacata), পার্থেনিয়াম।
আবার কিছু কিছু আগাছা আলো ও তাপ অসংবেদনশীল হওয়ার কারণে বছরের যে কোন সময়ে জন্মায় ও জীবনচক্র সম্পন্ন করে।
যেমন – আঙ্গুলি ঘাস (Digitaria sanguinalis), ভুঁই আমলা (Phyllanthus niruri), আপাং (Achyranthus aspera), বন-ঝাল/বনতুলসী (Croton bonplandianus), চটপটি (Ruellia tuberosa), প্রেম কাঁটা (Chrysopogon aciculatus) ইত্যাদি।
খ) দ্বিবর্ষজীবী আগাছা (Biennial weeds) – এরা সাধারণত দুই বছরে তাদের জীবনচক্র সম্পন্ন করে। এরা বীজ দিয়ে বা অঙ্গজ জনন (Vegetative propagation) দুই মাধ্যমেই বংশবিস্তার করে থাকে।
যেমন – কাক- সিম (Blumea sp), বন-আদা (Zingiber cassumunar)
গ) বহুবর্ষজীবী আগাছা (Perennial weeds) – এরা এদের সমগ্র জীবনচক্রে একের অধিক বার বীজ উৎপাদন করে এবং তিন বা তার বেশী সময় অবধি বেঁচে থাকে।
উদাহরণ – ভূত ভৈরব/পুটুস (Lantana camara), বেহায়া ফুল/ দুধ কলমি/ঢোল কলমি (Ipomea carnea)।
ফসলের আগাছা নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন নিম্নে প্রদত্ত লিঙ্কে - (Management of weeds) সুসংগত উপায়ে ফসলের আগাছা নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি
বিভিন্ন সবজি ফসলের অতি পরিচিত কিছু আগাছা –
ক) ফুলকপি ও বাঁধাকপি – বথুয়া, বৃক্ষনীল, বনসালফা, শাক-নটে, বিষ কাঁটালি, বন-পালং (Rumex crispus), বন মেথি, তিতা বেগুন (Solanum torvum), নুনিয়া শাক।
খ) ভিন্ডি – গ্রীষ্মকালীন – শ্যামা ঘাস, মুথা।
বর্ষাকালীন – জংলী জোয়ার (Sorghum halepense), উচুন্টি, গোক্ষুর, ক্ষুদি ওকরা।
গ) পেঁয়াজ ও রসুন – মুথা ঘাস, দূর্বা ঘাস, শ্যামা ঘাস, নটে শ্বেত পুণর্নবা, নুনিয়া।
ঘ) আলু – বথুয়া, আঙ্গুলি ঘাস, বন তামাক (Nicotinia plumbaginifloia), শ্যামা ঘাস, বৃক্ষনীল, বন-পালং, সবুজ শিয়াল লেজা (Setaria viridis), বনকাঁটালি, ছাপড়া (Eleusine indica), জংলী ধনিয়া (Spergula arvensis), আমরুল (Oxalis corniculata), পট্যাটো উইড/গ্যালান্ট সোলজার (Galinsoga parviflora)।
ঙ) ক্যাপসিকাম - মুথা ঘাস, দূর্বা ঘাস, কানাইবাঁশি/ কানশিরা (Commelina benghalensis), জংলী পাট (Corchorus acutangulas), বনটেপারী/পটকা (Physalis minima)।
চ) মেথি – শ্বেত হুরহুরে, মুথা ঘাস, দূর্বা ঘাস, বনমেথি।
ছ) মটর ও শিম্বগোত্রীয় সবজী – বন সালফা, বন মুসুর (Vicia sativa), লজ্জাবতী, জংলী ধনিয়া, পার্থেনিয়াম।
জ) টম্যাটো ও বেগুন – ছোট দুধিয়া, বড় দুধিয়া, শ্যামা ঘাস, বন মেথি, বথুয়া, বৃক্ষনীল, উচুন্টি, পার্থেনিয়াম, পটকা।
ফসল সবজীর জীবনচক্রে ‘ফসল আগাছা’ প্রতিযোগিতার সংকটাপন্ন দশা (Critical stages of crop weed competition in the crop life cycle) –
ফসল |
সংকটাপন্ন দশা |
ফসলের বৃদ্ধি দশা |
পেঁয়াজ ও রসুন |
মূল জমিতে চারা প্রতিস্থাপনের ৩০ দিন পর থেকে ৭৫ দিন অবধি |
কন্দের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি দশা |
ফুলকপি ও বাঁধাকপি |
মূল জমিতে চারা প্রতিস্থাপনের ৩০ দিন পর থেকে ৪৫ দিন অবধি |
ফুলকপির ‘ফুল’ (Curd) ও বাঁধাকপির ‘মাথা’ (Head) গঠনের প্রারম্ভে |
ভেন্ডি |
বীজ বপনের ১৫ দিন পর থেকে ৩০ দিন অবধি |
গাছের উচ্চতা ১০-১৫ সেমি. হলে |
টম্যাটো, লঙ্কা |
মূল জমিতে চারা প্রতিস্থাপনের ৩০ দিন পর থেকে ৪৫ দিন অবধি |
গাছের উচ্চতা ২০-৩৩ সেমি. হলে (টম্যাটোর ক্ষেত্রে) |
বেগুন |
মূল জমিতে প্রতিস্থাপনের ৩০ দিন পর থেকে ৪৫ দিন অবধি |
- |
বিনস্, বরবটি |
- |
অঙ্কুরোদগমের পর থেকে ফুল আসার আগে পর্যন্ত |
আলু, মুলো |
বীজ বপনের ২৫ - ৩০ দিন পর থেকে সম্পূর্ণ জীবদ্দশায় |
- |
গাজর |
বীজ বপনের ১৫ – ২০ দিন পর থেকে |
চারাগাছ ৭-১০ সেমি. লম্বা হলে |
নিবন্ধ - শুভ্রজ্যোতি চ্যাটার্জ্জী (গবেষক, সবজী বিজ্ঞান বিভাগ, উদ্যান পালন অনুষদ, বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মোহনপুর, নদীয়া )
Image source - Google
(Reduce diesel cost in tractors) ট্র্যাক্টরে ডিজেলের ব্যয় হ্রাস করতে চান? অনুসরণ করুন এই পদ্ধতির
Share your comments