ইলিশের বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয় হতে পারে মিল্ক ফিশ বা ‘দুধ মাছ’। ফিলিপিন্সের এই মাছটি ইতিমধ্যে এ রাজ্যে সরকারি উদ্যোগে চাষ শুরু হয়েছে। দক্ষিণ ভারতেও প্রচুর ‘দুধ মাছ’ মেলে। অনেকে এদের ডেকান হিলসা বা দাক্ষিণাত্যের ইলিশ বলে থাকেন। ইলিশের আচরণের সঙ্গে এদের বেশকিছু মিল রয়েছে। এরাও ঝাঁক বেঁধে ঘোরে। ডিম পাড়ার সময় মোহনার দিকে আসে। অল্প নোনা জলের পাশাপাশি মিষ্টি জলেও মিল্ক ফিশ চাষ করা যায়। দুধ মাছের আঁশ চকচকে রূপোলি। কাঁটাযুক্ত। ইলিশের চেয়ে এদের পেটের দিকটা কম চওড়া। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাশাপাশি পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী এলাকায় মিল্ক ফিশ চাষের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য বিশেষজ্ঞরা।
এদের খাদ্যগুণ বেশ ভালোই। এরা শাকাহারি। মূলত জলাশয়ের নীচে জন্মানো শৈবাল খেয়ে থাকে। সহনশীলতা বেশি হওয়ায় জলে লবণের মাত্রা কম-বেশি হলেও এরা সহ্য করতে পারে। ৬ মাসে মিল্ক ফিশের ওজন হয় প্রায় ৫০০ গ্রাম। ঠিকমতো চাষ করতে পারলে এক হেক্টরে চার থেকে সাড়ে চার টন মাছ উৎপাদন হয়।
এ রাজ্যে ভেড়ি সহ নোনা জলাশয়ে মিল্ক ফিশ খুব ভালোভাবে চাষ করা যেতে পারে বলে জানাচ্ছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। হলদিয়া মৎস্য দপ্তরের উদ্যোগে চলতি বছরের জুন মাসে চেন্নাইয়ের সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট অফ ব্রাকিশওয়াটার অ্যাকোয়াকালচার থেকে মিল্ক ফিশের ধানিপোনা নিয়ে আসা হয়েছে। হলদিয়া ব্লক মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক সুমনকুমার সাহু জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে মিল্ক ফিশের আট হাজার ধানিপোনা নতুন ধরনের এই মাছ চাষের প্রসারে মৎস্যচাষিদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। অল্প নোনা জলের পাশাপাশি মিষ্টি জলেও এই মাছটি চাষ করা যায়। তবে, মিষ্টি জলে চাষ করলে মাছের সাইজ ছোট হয়। তবে, বাজারে বিক্রি হওয়া প্যাকেটের খাবারও দেওয়া যেতে পারে।
চার-পাঁচ সপ্তাহে ৫-৮ সেমি হয় মিল্ক ফিশের পোনা। সেইসময় বড় পুকুরে ছাড়া যায়। ইউরিয়া ও সিঙ্গল সুপার ফসফেট ২০ কেজি হেক্টর প্রতি পুকুরে প্রয়োগ করলে জলাশয়ে প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মাতে সাহায্য করে। ফলে মাছের খাবারের অভাব হয় না। সাধারণত নোনা জলের ভেড়িতে ৭-১৫ সেন্টিমিটারের মিল্ক ফিশ প্রতি একরে এক থেকে দেড় হাজার ছাড়া যেতে পারে। নিবিড় পদ্ধতিতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষ করলে ৭-১৫ সেমির মিল্ক ফিশ একরে গড়ে চার হাজার ছাড়া যায়। বছরে ফসল তোলা যায় দু’বার। টানা জাল বা ফাঁস জাল দিয়ে ধরতে হয় মিল্ক ফিশ।
উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদের ফিশারি ফিল্ড অ্যাসিন্ট্যান্ট ধ্রুবজ্যোতি সেন জানিয়েছেন, গত বছর হাসনাবাদের ভবানিপুর এক গ্রাম পঞ্চায়েতের শুলকুনি গ্রামের প্রগতিশীল মাছচাষি কাশীনাথ দাস তাঁর ভেড়িতে চিংড়ির সঙ্গে মিল্ক ফিশ চাষ করেছিলেন। তামিলনাড়ু থেকে দশ হাজার ধানিপোনা এনেছিলেন তিনি। চার মাসেই তাঁর জলাশয়ে মিল্ক ফিশ ৩৫০-৪০০ গ্রাম ওজনের হয়েছিল। স্থানীয় মার্কেটে প্রথম কয়েকদিন একটু কম দাম পেলেও পরে ১৮০-২০০ টাকা কেজি দরে মিল্ক ফিশ বিক্রি করেছেন তিনি। এবছরও মিল্ক ফিশের চাহিদা ছিল। কিন্তু, বাইরে থেকে সিড আনতে হওয়ায় খানিকটা সমস্যা রয়ে গিয়েছে। মিল্ক ফিশের চারা না পেয়ে অনেকে নোনা ট্যাংরা চাষ করছেন। মৎস্য দপ্তরের পক্ষ থেকে চাষের প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করা হচ্ছে মৎস্যচাষিদের। সেন্ট্রাল ইন্সটিটিউট অফ ফিশারিজ এডুকেশনের বিজ্ঞানী বি কে মহাপাত্র বলেছেন, আমাদের রাজ্যে বিশেষ করে উপকূলবর্তী অঞ্চলে মিল্ক ফিশ চাষের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। সংখ্যায় কম হলেও অতীতে সুন্দরবন অঞ্চলে এই মাছের দেখা মিলত। কিন্তু, তখন মূলত রুই-কাতলা নির্ভর মাছ চাষ হওয়ায় এটিকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে, এখন এর চাষ শুরু হয়েছে। হলদিয়ার পাশাপাশি সুন্দরবন এলাকাতেও মিল্ক ফিশের কম-বেশি চাষ হচ্ছে। ফিলিপিন্সে এই মাছের প্রচুর উৎপাদন। ইন্দোনেশিয়া, তাইওয়ানেও প্রচুর পরিমাণে চাষ হচ্ছে।
- Sushmita Kundu
Share your comments