বাঙালী মৎস্যপ্রিয়। শুধু অনুষ্ঠানেই নয়, দৈনন্দিন জীবনেও আমাদের বাঙালীদের মাছ ছাড়া প্রায় চলেই না। আমাদের দেশে মৎস্য চাষীভাইদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। নারী ও পুরুষ মিলিয়ে অনেকেই এই পেশায় যুক্ত আছেন। কিন্তু অনেক সময় সঠিক তথ্যের অভাবে মৎস্যচাষে তাদের লাভ করা তো দূরের কথা, বরং তাঁরা সম্মুখীন হন বিভিন্ন সমস্যার, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার তাঁরা অনেকেই চাষ করতে গিয়ে লোকসানও করেন। ফলে তারা মাছ চাষ করতে শঙ্কাবোধ করেন, এর থেকে বিরত থাকতে চান।
তবে এই মৎস্য চাষীদের (Fish Framer) কথা স্মরণে রেখে, নেওটিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. প্রতাপ কুমার মুখোপাধ্যায় আলোচনা রেছেন, মৎস্য চাষ বিষয়ক কিছু জরুরী প্রশ্ন এবং তার উত্তর সম্পর্কে। গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্যগুলির সহায়তায় মৎস্য চাষীরা হবেন অনেকটাই লাভবান।
এই প্রশ্ন এবং উত্তরগুলি নিম্নে আলোচনা করা হল -
১) প্র. মাছ চাষে জলের গুণমান ঠিক কেমন হওয়া উচিৎ?
উ. দ্রবীভূত অক্সিজেন সাধারণত পুকুরের জলে ৫-৭ মিলিগ্রাম (লিটার প্রতি) থাকা উচিৎ, একটু কম থাকলেও তেমন অসুবিধা নেই। তবে ৩ মিলিগ্রাম-এর কম হলেই মাছ খাবি খেতে আরম্ভ করে। এই সরল উপায় তা বোঝার কৌশল আর বুঝতে পারলে সেই মুহূর্তে করণীয় অন্তত একটি বিষয় – খাবার দেওয়া বন্ধ রাখা। জলে তৎক্ষণাৎ অক্সিজেন সরবরাহের জন্য প্রয়োজন কোনভাবে ফোয়ারা বা ঢেউ সৃষ্টি করা অথবা পুকুরে সাঁতার কাটলেও হবে।
জল যদি ঈষৎ ক্ষারকীয় হয়, অর্থাৎ পিএইচ (pH) ৭.৩-৭.৮ পর্যন্ত থাকলে মাছ বেশ সাবলীল থাকে। খুব সহজেই নামমাত্র খরচে পিএইচ পেপারের সাহায্যে এটি দেখে নিতে পারেন। না হলে সহজ টোটকা উপায়ও আছে। যদি কোনভাবে জল একটু আম্লিক হয়ে পড়ে, অর্থাৎ পিএইচ ৭- এর নীচে চলে যায়, তাহলে পরিমাপ মতো চুন প্রয়োগ করতে হবে, আর যদি বেশী হয়ে যায়, তাহলে তেঁতুল, আমড়া, চালতা প্রভৃতি গাছের ডালপালা ছড়িয়ে সমস্যা মেটানো যায়।
জলের স্বচ্ছতা –
খুব স্বচ্ছ পানীয় জলের মতো নয়, আবার কাদা গোলা ঘোলা জলও নয়। এটা এক মাঝারি স্বচ্ছতা। মাপের বিচারে (ঘরের তৈরী সেক্চি ডিস্কের) স্বচ্ছতা ৩০-৪০ সেমি. হল এক আদর্শ স্বচ্ছতা, যা থেকে আমরা জৈব সার, খাবার কতটা দিতে হবে, তার আন্দাজ করতে পারি।
২) প্র. জলে উদ্ভিদকণা ও প্রাণীকণার ভারসাম্য আছে কিনা বোঝার সহজ উপায় কি?
উ. উদ্ভিদকণার পরিমাণ বেড়ে গেলে বা সে কারণে স্বচ্ছতা কম হলে জলের ওপরে হালকা সবুজ সর পড়তে পারে। আবার প্রাণীকণা যদি খুব বেশী হয়, বা জলের বাদামী বর্ণটি যদি চোখে পড়ে, অর্থাৎ উদ্ভিদকণা কম হয়ে যায়, তাহলে জলে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন তৈরী হতে পারে না। উভয়ের সামঞ্জস্য থাকা এই কারণে দরকার, যাতে অক্সিজেনেরও ঘাটতি না হয়, আবার প্রাণীকণার পরিমাণও ঠিকঠাক থাকে। সেক্চি ডিস্ক দিয়ে মাপা যায় জলের স্বচ্ছতা, আর প্ল্যাঙ্কটন নেট দিয়ে পরিমাপ করা হয় প্রাণীকণার। সাধারণত স্বচ্ছতা ৩০-৪০ সেমি. ও প্রাণীকণা ৫০ লিটার জলে ১.৫ মিলি. থাকলে খুব ভালো হয়।
৩) প্র. পুকুরে মাছের চারা পোনা মজুতের পরিমাণ কেমন হলে সবকিছুর ভারসাম্য (মূলত খাদ্যকণা ও অক্সিজেন) বজায় থাকে?
উ. যেহেতু পুকুরে সব মাছেদেরই পছন্দের কিছু জায়গা এবং পৃথক কিছু প্রিয় খাবার থাকে, তাই খাদ্যের নিরিখে মাছ নির্বাচন করাটাই সাধারণ প্রথা। যেমন- কাতলা খায় প্রাণীকণা, থাকে জলের ওপরের স্তরে। রুই খায় সবুজকণা, থাকে জলের মধ্য স্তরে। মৃগেল থাকে পুকুরের নীচের স্তরে, খায় নীচের দিকে পড়ে থাকা আধপচা সার, পাতা ইত্যাদি। তাই ১০ টি মাছ ছাড়লে ওপরে (কাতলা সিল্ভার কার্প উদ্ভিদকণা খেতে অভ্যস্ত) চার, মাঝে (রুই) তিন, নীচে (মৃগেল, বাটা, কালবোস ইত্যাদি) তিন – এভাবে ছাড়তে হবে। এক শতকে (৫২ শতক = ১ বিঘা) সর্বাধিক ৪০ টি, মোট ওজন প্রায় ৫ কেজি, মাছ ছাড়া যাবে। মাছ ছাড়ার সময় মার্চ-এপ্রিল।
৪) প্র. মাছ থাকাকালীন পুকুরের পরিচর্যা কিরকম হওয়া উচিৎ?
উ. প্রথমত, প্রতি মাসে একবার করে পরিমিত হলেও জৈব সার বা জৈব জুস দেওয়া দরকার। এতে খাদ্যকণার যোগান অব্যাহত থাকে এবং মাছের ফলনও ভালো হয়। এছাড়া বিঘা প্রতি জলে ৫ কেজি হারে চুন (আগের দিন রাত্রিবেলা ২৫ লিটার জলে চুন ভিজিয়ে রাখতে হবে) এবং ২ মাসে একবার পুকুরের তলায় মাটি রেকারের সাহায্যে আঁচড়ে দিতে হবে, এতে পুকুরের তলদেশের জমা গ্যাস বেরিয়ে যাবে। এর ফলে পুকুরে কখনও প্রাকৃতিক খাদ্যের ঘাটতি হবে না। মাসে অন্তত একবার জাল টানবেন, এতে জলের গ্যাস দূষণ কিছুটা কমে আর মাছের ব্যায়ামও হয় এবং এই কারণে মাছের বাড়ও ভালো হয়।
৫) প্র. পরিপূরক খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা কতটা?
উ. অল্প পরিমাণে হলেও বাইরে থেকে নিয়মিত কিছু খাবার মাছকে দেওয়া দরকার। সহজলভ্য কিছু উপাদান যেমন- সরষে খোল, বাদাম খোল, তিল খোল, চিঁড়ের গুঁড়ো, চালের পালিশ কুঁড়ো, ভুট্টা গুঁড়ো, সয়াবিন গুঁড়ো – এর মধ্যে যে কোন একটি তৈল বীজের খোল ও সেই সঙ্গে চাল/চিঁড়ে/ভুট্টা- এর যে কোন একটি মিশিয়ে, সঙ্গে খুব সামান্য খাবার লবণ, চিটে গুড় এবং সুগন্ধিজাত একটি উপাদান, যেমন- একাঙ্গি ও মেথি ভাজা গুঁড়ো (খুবই অল্প পরিমাণে) মিশিয়ে অল্প গরম জল সহযোগে মেখে বল আকারে তৈরী করে, তারপরে সিমাই তৈরী মেশিনের সাহায্যে চাউমিন আকারে বানিয়ে শুকনো করে দিতে পারলে ভালো হয়। মেশিনটি অপরিহার্য নয়। ছোট ছোট বল আকারে বাঁশের তৈরী ঝুলন্ত ট্রে-এর সাহায্যে দেওয়া যেতে পারে।
৬) প্র. বিশেষ ভাবে প্রস্তুত কোন পরিপূরক খাবারের প্রয়োজন আছে কি?
উ. হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আছে। আগে উল্লিখিত পরিপূরক খাদ্যের সাথে কয়েকটি ভেষজ উপাদান, যেমন- নিম্পাতা, কাঁচা হলুদ, রসুন বাটা, তুলসী পাতা (প্রতি ১০০ গ্রামে ২৫ গ্রাম করে প্রত্যেকটি উপাদান দিতে হবে) মেশাতে হবে। মোট ১০০ গ্রামের ওই ভেষজ উপাদানগুলি ৫ কেজি পরিপূরক খাদ্যের সাথে মিশিয়ে আলাদা একটি বস্তায় ‘মেডিকেটেড খাদ্য’ হিসাবে সংগ্রহ করতে হবে।প্রতি মাসের এক বা দুই নির্দিষ্ট দিনে ওই ‘মেডিকেটেড খাদ্য’ মাছকে দিন। মাছের রোগ হোক বা না হোক, এতে মাছ সুস্থ-সবল থাকবে এবং জলের দূষিত হওয়ার সম্ভবনাও কমবে।
৭) প্র. জলের গুণাগুণ পরখ করবার সহজ উপায় কি?
উ. যে কোন মাছ চাষীর পুকুর লিজ নেওয়া, মাছের খাবার তৈরী করা, প্রয়োজনে মাছের ওষুধ দেওয়া ইত্যাদিতে অনেক টাকা খরচ হয়। এছাড়া অনেক আনুষাঙ্গিক ঝুঁকিও আছে। তাই মাছ চাষ সুচারুভাবে পরিচালনা করতে হাতের কাছে ন্যূনতম কয়েকটি সরঞ্জাম বা উপকরণ দরকারী। যেমন- pH পেপার, সেক্চি ডিস্ক, প্ল্যাঙ্কটন নেট, অ্যামোনিয়া টেস্ট কিট ইত্যাদি। এই পরিচর্যাগুলি না করলে হঠাৎ বড় কোন ক্ষতির আশঙ্কা থাকতে পারে।
৮) কয়েকটি (১০ টি) জরুরি তথ্য, মাছ চাষে যা অবশ্যই জানা দরকার – সেগুলি কি কি?
উ. ক) জলাশয়ে জলের ঠিকঠাক গভীরতা ও বিশুদ্ধতা।
খ) স্বাস্থ্যবান চারাপোনা নির্বাচন।
গ) পর্যাপ্ত খাবার ও জৈব সারের সঠিক প্রয়োগ।
ঘ) মাছের সঠিক প্রজাতি নির্বাচন, উপযুক্ত সংখ্যা, অনুপাত ও সাইজ নির্ধারণ।
ঙ) মাসে একবার করে পুকুরে জাল টানা, অতিরিক্ত পাঁক থাকলে রেকিং পদ্ধতিতে পরিষ্কার করা ও মাছের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।
চ) পর্যায়ক্রমে মাছ ধরা ও ছাড়া।
ছ) রোগ ও শত্রুর হাত থেকে মাছকে রক্ষা করা।
জ) নিয়মিত তদারকি, যথাযথ পরিচর্যা।
ঝ) পোনা মাছের মিশ্র চাষে মাঝে মাঝে জলের মধ্যে বায়ু সঞ্চালন এবং দু একটি প্রযুক্তির প্রয়োগ, এরেটারের ব্যবহার বা পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেটের হালকা দ্রবণ সঠিক পরিমাণে জলে গুলে পুকুরে প্রয়োগ করতে হবে বা পাম্পের সাহায্যে জলে ফোয়ারা সৃষ্টি করতে পারেন।
ঞ) সঠিক সময় ও পরিমাণে চুন প্রয়োগ (অবশ্যই জলের pH দেখে নিতে হবে) এবং পরিমাণ মতো জৈব সার / জুস প্রয়োগ করা।
৯) প্র. পোনা মাছ চাষের বিভিন্ন উপায়গুলি কি কি?
উ. মাছ চাষের বিভিন্ন পর্যায় –
সাধারণত মাছ চাষের তিনটি পর্যায় / ধাপ আছে। যথা –
প্রথম পর্যায় –
ডিম পোনা (রেণু) (৩-৪ দিন বয়স, লম্বা ৮ মি.মি. পর্যন্ত) থেকে ধানী পোনা (ফ্রাই) (১৫-৩০ দিন বয়স, দৈর্ঘ্য ৮-৪০ মি.মি.) = আঁতুড় পুকুর পরিচর্যা ।
দ্বিতীয় পর্যায় -
ধানী পোনা (১৫-৩০ দিন বয়স) থেকে চারা পোনা (২-৩ মাস বয়স, ৪১-৮০ মি.মি. লম্বা) = পালন পুক্লুর পরিচর্যা।
তৃতীয় পর্যায় –
চারা পোনা (২-৩ মাস বয়স) থেকে টেবিল সাইজ (৬-১২ মাস বয়স, ৮১-১৫০ মি.মি এবং তার বেশী লম্বা) = মজুত পুকুর পরিচর্যা।
Share your comments